ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে নেটদুনিয়ায় বাড়ছে অপতথ্য

৮ মে, ২০২৫  
৮ মে, ২০২৫  
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে নেটদুনিয়ায় বাড়ছে অপতথ্য

ভারতের দাবি, গত ৬ মে দিনগত রাতে ৯টি স্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানের। এরপর ভারতে পাল্টা হামলা চালায় পাকিস্তানও। দেশটির প্রতিরক্ষাপ্রধান ৫টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেন। এই পাল্টাপাল্টি আক্রমণে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের ২৬ জন এবং ভারতের ১০ নাগরিক নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। পাল্টাপাল্টি হামলা ও সংঘাতের ঘটনার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে। সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে সোশ্যাল হ্যান্ডেলে চলছে অপতথ্যের বাড়-বাড়ন্ত।

সামাজিক মাধ্যমের পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া দাবিযুক্ত ছবি-ভিডিও। এগুলোর মধ্যে আছে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও। এসব তথ্য অনেক সময় পুরোনো বা ভিন্ন প্রেক্ষাপটের হলেও সেগুলোকে বর্তমান পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে প্রচার করা হচ্ছে।  

ছড়িয়ে পড়া বেশকিছু অপতথ্য এবং বিভ্রান্তিকর ছবি-ভিডিও সনাক্ত করে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরেছে স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং অরাজনৈতিক অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্লাটফর্ম ডিসমিসল্যাব। তাৎক্ষণিক ৮টি  অপতথ্য ‘ডিসমিসড’ করে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে এ সম্পর্কিত আরও তথ্য যাচাই করা হলে পর্যায়ক্রমে সেগুলো প্রকাশ করা হবে।

ডিসমিসল্যাবের পর্যবেক্ষণ বলছে, অপতথ্য ছাড়ানো একটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে “ভারতের যুদ্ধবিমান ভুপাতিত করার দৃশ্য। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ভারতীয় পাঁচটা যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে পাকিস্তান।কয়েকজন ভারতীয় পাইলট আটক করেছে পাকিস্তান।” ভিডিওতে বিস্ফোরণের পর একটি বাড়িতে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে।

যাচাইয়ে দেখা যায় এটি সাম্প্রতিক কোনো ভিডিও নয়। সামাজিক মাধ্যম ইউটিউবে একই ভিডিওটি পাওয়া যায় যা ২০২৪ সালের ১১ মার্চ আপলোড করা হয়েছিল। এটির সঙ্গে চলমান ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনার কোনো সম্পর্ক নেই।

আরেকটি ভিডিও পোস্ট হতে দেখা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে। ভিডিওতে মিসাইল ছুড়ে একটি বিমানকে ভূপাতিত করার দৃশ্য দেখা যায়। এটিকেও ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দৃশ্য বলে প্রচার করে হচ্ছে

ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, এটি ৬ মে দিবাগত রাতে পাকিস্তান কর্তৃক ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার ভিডিও নয়। অন্তত ৯ দিন আগেও ভিডিওটি ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছিল।

ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার সংবাদে ছবিটি ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমে। ছবিটিতে একটি বিধ্বস্ত বিমানে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। কিছু গণমাধ্যম ফটোকার্ডে এই ছবিটি ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে সরিয়ে নিয়েছে।

যাচাইয়ে দেখা যায় এটি ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের রাজস্থানে বিধ্বস্ত হওয়া একটি যুদ্ধবিমানের ছবি। প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে প্রশিক্ষণের সময় ভারতীয় বিমান বাহিনীর মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হয়। এটির সঙ্গে চলমান ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কোনো সম্পর্ক নেই।

“আল্লাহু আকবার✊পাকিস্তান জিন্দাবাদ???????? এভাবেই ভারতের পাঁচটা বিমান ভূপাতিত করেছে। আলহামদুলিল্লাহ”- এই ক্যাপশনসহ ভিডিওটি পোস্ট হতে দেখা যাচ্ছে ফেসবুকে। সেখানে দেখা যাচ্ছে এক ব্যক্তি মিসাইল ছুড়ে একটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছে।

ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, এটি একটি ভিডিও গেমের দৃশ্য। চলতি বছরের ৩১ মার্চ ইউটিউবে আপলোড হওয়া এই ভিডিওটির শিরোনাম ছিল “অন টারগেট! গ্রোজনিতে মার্কিন জেভেলিন রাশিয়ান হেলিকপ্টার ধ্বংস করেছে! #আরমা৩”। আরমা ৩ হলো একটি ভিডিও গেম। ভিডিওর বিবরণেও এটিকে গেমের দৃশ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এমন দাবিযুক্ত ফেসবুক পোস্টে ভিডিও যুক্ত করা হচ্ছে যেখানে একটি এলাকায় মিসাইল হামলা হতে দেখা যাচ্ছে। ভিডিওটির ডানদিকে উপরের প্রান্তে ‘ইন্ডিয়া’ লেখাটি দেখা যায়। 

যাচাইয়ে দেখা যায়, ভিডিওটি ভারত বা পাকিস্তানের নয়। অন্তত সাত মাস পুরোনো ভিডিওটি পোস্ট করতে দেখা যায় ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরান ন্যাশনাল নিউজ এজেন্সিতে (ইরনা)। ২০২৪ সালের অক্টোবরে ইরনা তাদের অফিসিয়াল টুইটার হ্যান্ডেলে ভিডিওটি শেয়ার করেছিল। তারা এটিকে ‘উত্তর তেল আবিবের হারজেলিয়ায় ইরানি মিসাইল হামলার দৃশ্য’ বলে উল্লেখ করে।

“আবারও পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে ভারত”- এমন দাবিতে একটি ভিডিও পোস্ট হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে। ভিডিওতে একটি এলাকায় সেনা মহড়া দিতে দেখা যাচ্ছে। বেশকিছু ট্যাংক থেকে গোলা নিক্ষেপ করতেও দেখা যায়।

ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে ভিডিওটির প্রায় ৫ বছর পুরোনো সূত্র সামনে আসে। ‘ডিফেন্স দিল্লি রিভিউ’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারিতে পোস্ট করা হয়। ভিডিওর শিরোনাম ছিল, “দেবলালি রেঞ্জে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১২২ মিমি ‘আপগ্রেডেড’ গ্র্যাড মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চারের গুলিবর্ষণ।” অর্থাৎ, এই ভিডিওর সাথেও চলমান সংঘাতের কোন সম্পর্ক নেই।

পাকিস্তানে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা দাবি করে একটি ভিডিও পোস্ট হচ্ছে ফেসবুকে। ভিডিওতে একটি এলাকায় বোমা হামলা হওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। হামলার সাথে সাথে তাঁবু থেকে কিছু মানুষকে দৌঁড়াতে দেখা যায়।

যাচাইয়ে দেখা যায় এই ভিডিওটি মূলত ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলার। ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার একটি ভিডিও প্রতিবেদনে এই দৃশ্যটি দেখা যায়। ভিডিওর শিরোনাম ছিল, “গাজার ইন্দোনেশিয়ার হাসপাতালে আহতদের খবর পাওয়া যাচ্ছে”। ভিডিওর ৫ মিনিট ৭ সেকেন্ড থেকে ভুল দাবিতে ছড়ানো ভিডিওর দৃশ্যের সাথে হুবহু মিল পাওয়া যায়। অর্থাৎ এটি পাকিস্তান-ভারত সংঘাতের সাথে সম্পর্কিত নয়।

“ভারতের যুদ্ধবিমান বোপাদিত করেছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং ভারতীয় বিমান সেনাকে আটক করেছে পাকিস্তানি ক্ষুব্ধ জনতা যা পরবর্তীতে পাকিস্তানি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে।”- এমন ক্যাপশনে ভিডিও প্রচার হতে দেখা যাচ্ছে ফেসবুকে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে একটি বিধ্বস্ত বিমানে আগুন জ্বলছে এবং কয়েকজন ব্যক্তি আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে।

ভিডিওটির সূত্র যাচাইয়ে দেখা যায় এটি চলতি বছরের এপ্রিলের একটি ঘটনার দৃশ্য। গত ১৬ এপ্রিল প্রকাশিত পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য ডনের এক প্রতিবেদনে এটিকে পাকিস্তানের একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার দৃশ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ভিডিওর ১৪ সেকেন্ড থেকে অপর একটি ঘটনার দৃশ্য যোগ করা হয়েছে। যাচাইয়ে দেখা গেছে সেটিও পুরোনো একটি ঘটনার ভিডিও। ভারতের মধ্য প্রদেশে গত ৬ ফেব্রুয়ারি সেদেশের বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা এটি।