প্লাটফর্ম কর্মীদের নিয়ে ভাববার সময় কি এসেছে?
বিশ্বজুড়ে তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ প্লাটফর্ম অর্থনীতির পরিধিটা বেশ বড়ো ও বিস্তৃত করে দিয়েছে। অনলাইন মার্কেটপ্লেস, ফুড ডেলিভারী সার্ভিস, রাইড শেয়ারিং এর মতো সেবাগুলো প্লাটফর্ম ইকোনমির ডিজিটাল বিকাশের উদারহণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন প্লাটফর্ম ধাঁচের অর্থনীতি গোটা এসএমই বিজনেস এর ধরণও বদলে দিতে পারে। প্লাটফর্ম অর্থনীতির যে কাঠামো সেখানেও আমূল পরিবর্তন এসেছে।
বলা হয়ে থাকে, দুটি বিরোধপূর্ণ শক্তি বিশ্ব বাণিজ্যের ভবিষ্যত গঠন করছে। একদিকে রয়েছে সুরক্ষাবাদ (protectionism), দেখা যায় যে, ব্রেক্সিট এবং ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের প্রত্যাহারের মতো ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে, ডিজিটাল প্রযুক্তি জাতীয় সীমানাকে আর বর্ডার লাইসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছেনা এবং বৃহত্তর আন্তঃদেশীয় প্রবাহকে উৎসাহিত করছে।
বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো বড়ো বড়ো প্লাটফর্মের মধ্য দিয়ে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সাথে সাথে ডিজিটাল ফ্রিল্যান্সার কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। ডেস্কজব এর ডিজিটাল স্কিল এর আউটসোর্সিং দ্বারা যেমন কাজ ও কর্মী দুয়ের মেলবন্ধন ঘটছে তেমনি, পণ্য ডেলিভারী ও রাইড শেয়ারের মতো সেবার বন্টনে ডিজিটাল প্লাটফর্মের ব্যবহার নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
যেকোনো খাতের শুরুর আগে এক ধরনের সমস্যা থাকে। শুরুতে সমস্যাগুলো ভিন্নতর হয়। বিকাশ পরবর্তী সমস্যাগুলো আবার আলাদা। বাংলাদেশে প্লাটফর্ম সেবা বিকাশে জনজীবন যেমনি সহজ হয়েছে তেমনি তৈরী হয়েছে কর্মসংস্থান। ব্যাপক সংখ্যক তরুন জনগোষ্ঠির ভার লাগব করতে যা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে দেশে উৎপাদনশীল খাতের বিকাশ না হওয়া ও দক্ষ জনগোষ্ঠি তৈরী না হওয়ায় এই কর্মসংস্থানের উপর আমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। তাই এই খাতকে বিকাশ ও উন্নয়নে কাজ করা আমাদের প্রয়োজন রয়েছে বৈকি?
সম্প্রতি এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। ফেয়ারওয়ার্ক বাংলাদেশ রেটিং 2023 প্রকাশিত সমীক্ষায় বাংলাদেশের ১১টি ডিজিটাল প্লাটফর্মের উপর একটি ফল প্রকাশিত হয়। সমীক্ষা পরিচালনাকারী সংস্থা বলছে এটি তৃতীয় প্রতিবেদন যা তাদের বিগত ২০২২ সালের আগের অবস্থা থেকে উন্নতি নির্দেশ করছে। ২০২২ সালে মোট দশটি প্লাটফমের্মের মধ্যে তিনটি, তিনটি প্ল্যাটফর্ম (চালডাল, হ্যালোটাস্ক এবং সেবা) সর্বোচ্চ স্কোর করেছে। ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ স্কোর ১১টির মধ্যে পাঁচটি তাদের শীর্ষমান দেখাতে পেরেছে। নতুন যুক্ত হয়েছে দারাজ ও সেবা।
দেশে যত রাইড শেয়ার, ই-কমার্স ডেলিভারী, মার্কেটপ্লেস ও সার্ভিস প্লাটফর্ম রয়েছে মানের বিচারে সবার স্কোরিং বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার ব্যত্যয় থাকতে পারে কিন্তু প্লাটফর্ম অর্থনীতির যে বিস্তার তার দ্বারা কর্সংস্থান ও সেবার বহুমুখীতা এবং ডিজিটাল অর্থনীতির ট্রেন সামনের স্টেশনগুলোতে যেতে চলেছে সেটা নিশ্চই আর অস্বীকার করা যাবেনা।
কথা উঠেছে ই-কমার্স ডেলিভারী, ফুড ডেলিভারী সেবা, রাইড শেয়ার বিশেষ করে যেসব প্লাটফর্মে কর্মী, ডেলিভারী পার্সন, রাইডার, শেয়ার ড্রাইভারদের পেশার স্বীকৃতি, সম্মান ও উপযুক্তপারিশ্রমিক পাচ্ছে কিনা? দারাজ, চালডাল, ফুডপান্ডা, পাঠাও ও উবারে যেসব স্বাধীন কর্মী কাজ করেন যারা বেতনভূক্ত নন তাদের জীবন যাত্রার উপর নজর দিয়ে বিষয়টি উপলব্দি করে যেতে পারে যে, তারা যে শর্তে কাজ করে তা অপরাপর মানবসম্পদ নীতি ও সময়োপোযোগী কিনা?
রাইড শেয়ার প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে রাইডারদের কমিশন অংশ কমিয়ে দেয়ার। মানে আগের চেয়ে সেটা কমাচ্ছে প্লাটফর্মগুলো। এর প্রধান কারণ শুরুতে সংযুক্তি ও প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এখন কোম্পানীগুলোকে লাভের চিন্তার করতে হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে ঘোড়ার ঘাসকাটার কোনো মানে নেই। এই খাতে প্রবৃদ্ধি ভাল হলেও বৈশ্বিক স্টার্টআপ সংস্কৃতির অনুসরণ এবং এখনো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মোট খুচরা বাজারের খুব ছোট অংশই ই-কমার্সের সাথে জড়িত ফলে ইন্ডাস্ট্রির প্রবৃদ্ধির সাথে নিজেদের উন্নতির কথাও ভাবতে হয়।
সাম্প্রতিক বাইকারদের একটি প্রবণতা পুরো খাতকে ঝুঁকিতে ফেলছে। সেটা হচ্ছে অ্যাপ ব্যবহার না করে রাস্তা থেকে ডেকে ডেকে যাত্রী তোলা। যেটাকে তারা ‘‘খ্যাপ’’ বলে থাকে। এই খ্যাপের কারণে প্লাটফর্মগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কারণ প্রতিটি প্লাটফর্ম শুরুর দিকে সেবাকে জনপ্রিয় করা ও বাইকারদের প্রশিক্ষণ দেয়াতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে।
যদিও এক্ষেত্রে সরকারের রেগুলেটরি কতৃপক্ষের নিরবতা উদ্যোক্তাদের কাছে হতাশার। কারণ সরকার রাইড শেয়ার সেবাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নীতিমালা করতে যতটা উদগ্রীব তাদের জন্য ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টির ব্যপারে ততটা গাফেল।
যেমন, রাইড শেয়ারিয় এর জন্য লাইসেন্স শর্ত ও কিছু বিধি বিধান দিয়েছে। প্লাটফর্মগুলো একদিকে লিমিডেট কোম্পানী ফরম্যাটে নিবন্ধিত অন্যদিকে ডিজিটাল সিস্টেমে পরিচালিত হয়। সরাসরি রাইডার ও যাত্রীর সেবায় যুক্ত থাকে তাই তারা কোনো অনিয়ম চিন্তা করতে পারে না।
রাইডাররা যখন অ্যাপকে এড়িয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সেবা দিচ্ছে তখন তারা শুধু ঝুঁকি তৈরী কিংবা সেবা খাতের ক্ষতি করছেনা তারা পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে নষ্ট করছে। একইভাবে ক্রেতাদেরও বিভ্রান্ত করছে। সরকার যেখানে দায়িত্ব নিয়ে নীতিমালা ও লাইসেন্স এর বাধ্য-বাধকতা দিয়েছে। সেখানে সরকার রাজস্ব হারানো সত্বেও নিরবতা ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হয়েছে। বিষ্যতে এ ধরনের ব্যবসা করার জন্য উদ্যোক্তাদের অন্তত কয়েকবার ভাবতে শেখাবে। কারণ কোনো কোম্পানী চাইলে লাইসেন্স ছাড়া বা কোনো বিধি বিধান প্রতিপালন ব্যতিরেকে এই ব্যবসা করতে পারে না অন্যদিকে কোনো রাইডার চাইলেই অ্যাপ বন্ধ করে ‘‘যাবেন নাকি’’ মডেলে যাত্রী সেবা দিতে পারে। এজন্য কোনো কর দিতে হয় না এবং জবাবদিহি করতে হয় না।
অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে আমরা ওয়াকীবহাল আছি বৈকি?
অন্যদিকে প্লাটফর্ম কর্মীরাও তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছে। প্লাটফর্ম কর্মীদের বেতনের বিষয়ে সমীক্ষায় বলা হয়েছে, চালডাল এবং দারাজ একটি মাসিক বেতন দেয় যদিও কর্মক্ষমতার উপর ভিত্তি করে একটি পরিবর্তনশীল হয় এবং বাড়তি আয়ের সুযোগ রয়েছে। অন্যদের ক্ষেত্রে দেখা যায় শ্রমের সময়, দক্ষতা এবং শারিরীক সুস্থ্যতার তার সাথে কোম্পানীর সেবার চাহিদার উপর ভরসা করে একজন প্লাটফর্ম কর্মীকে দিনের রোজগার ঠিক করতে হয়।
জরিপকারী প্রতিষ্ঠানটি শতাধিক প্লাটফর্ম কর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তারা কমপক্ষে 20টি চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। এরমধ্যে পণ্য ডেলিভারির সময় অনিচ্ছাকৃত পণ্যের ক্ষতির দায় কর্মীদের বহন করার ঘটনা ঘটেছিল এখনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। প্রথমত, এই দায় বহন করার ক্ষেত্রে কর্মীদের উপর একটি মানসিক চাপ তৈরী হয় দ্বিতীয়ত, কর্মীরা এটা দিতে চায়না। তারা একে অযৌক্তিক মনে করে।
আরেকটি প্রদান চ্যালেঞ্জ হলো, কর্মীদের উপার্জন নিয়ে তারা সন্তুষ্ঠ নয়। প্লাটফর্ম কর্মীদের উপার্জনের বিষয়ে তাদের এসোসিয়েশনগুলো কাজ করছে। আপাত দৃষ্টিতে তাদের দাবী কমিশনে তাদের অংশ বৃদ্ধি করা এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা। যেমন স্বাস্থ্যবীমা, দূর্ঘটনায় আর্থিক সহযোগিতা ইত্যাদি। কারণ তারা রাস্তায় ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিয়ে থাকেন।
এই ঝুঁকি যেহেতু পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশী। সেজন্য তারা প্রত্যাশা করেন ভালো কিছুর।
অ্যাপ-বেইজড্ ট্রান্সপোর্ট ইউনিয়ন এর সভাপতি বেলাল আহমেদ আমার সাথে ব্যক্তিগত আলাপ চারিতায় এ সংক্রান্ত একটি হিসেব দিয়েছেন। তার মতে, একজন উবার বা কার শেয়ার ড্রাইভারের দৈনিক সেবা দিতে পারেন গড়ে ৩,০০০ টাকার। এর মধ্যে কমিশন ৭৫০ টাকা, জ্বালানী ১৫০০ টাকা, দুপুরের খাবার ও মোবাইল বিল ২৫০ টাকা দেয়ার পর থাকে মাত্র ১২৫০ টাকা। মাসে ২৫ দিনে আয় হয় ৩১,২৫০ টাকা।
প্রতিমাসে গাড়ির ব্যয় আছে কমপক্ষে ২৫০০ টাকা, গ্যারেজ ভাড়া ২০০০ টাকা, মেরামত খরচ ৪০০০ টাকা। এসব বাদ দিলে মাসিক আয় দাড়ায় ২২,৭৫০ টাকা। প্রতিবছর গাড়ির পেছনে যে খরচ যেমন চাকা, ব্যাটারি, এসির কাজ ও ইঞ্জিন ওভারহোলিং মিলিয়ে খরচ ৩০,০০০ টাকা। প্রতিবছর গাড়ির ডকুমেন্ট আপডেট করতে ব্যয় হয় ৩৩,০০০ টাকা নিয়ে মোট ব্যয় হয় ৬৩,০০০ টাকা। যা প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকার বেশী। এই খরচ সমন্বয় করলে মাসিক যে আয় দাঁড়ায় ১৭,৫০০ টাকা । গাড়ি প্রতি ১২ থেকে ১৪ লাখ বিনিয়োগ করে নিজের পরিশ্রম দিয়ে এই টাকা অযৌক্তিক আয় বলে মনে করেন তিনি। তিনি আরো মনে করেন, এই টাকায় ৪ সদস্যের একটি পরিবার স্বাভাবিক ভরনপোষন চলে না। তাই তাদের প্রথম দাবী হলো প্লাটফর্মের কমিশন শেয়ার ১০% এ আনা। তা না হলে দিন দিন গাড়ির সংখ্যা কমতে থাকবে এবং গাড়ির মালিকেরা নিজেদের গাড়ি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হবে বলেও তিনি মনে করেন। কিছু ব্যবহারকারী মনে করেন এই কারণে গাড়ির সংখ্যা ক্রমশ কমতে চলেছে। নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কারণে অনেকে তাদের গাড়ি উবার, পাঠাও আর ওভাই থেকে সরিয়ে নিজেরা চালাচ্ছেন কিংবা রেন্ট এ কারে দিচ্ছেন।
এই অবস্থায় কর্মীরা মনে করেন তাদের পারিশ্রমিক এর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ থাকা উচিৎ। এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার বিষয়ে সরকারের নীতিমালা ও হস্তক্ষেপ থাকা উচিৎ।
এটা এই সময় বাস্তবসম্মত নয় মনে করেন প্লাটফর্ম উদ্যোক্তারা । প্রথমত, এখনো কোনো প্রতিষ্ঠান লাভের মুখ দেখেনি। দ্বিতীয়ত, বাইকারদের খ্যাপ মারার কারণে প্লাটফর্ম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তাছাড়া এই সময়ে কমিশন সংক্রান্ত কারণে যদি ভাড়া বৃদ্ধি পায় তাহলে যাত্রীরাও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।
সার্বিক দিক বিবেচনা করলে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্খার একটি ভারসাম্যহীনতা দৃশ্যমান হচ্ছে। একটা বিষয় স্পষ্ঠ হয়ে উঠলো যে, সেবার দাম না বাড়ালে পোষানোর মতো কমিশন ও আয় করা সম্ভব নয় আবার সেবার মান বাড়ালে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সেবাগ্রহীতারা এই সেবা গ্রহণ করতে আর্থিক সমস্যায় পড়বে।
প্রসঙ্গত, চলেই আসে যে, আমাদের অর্থ ও বাজার ব্যবস্থায় যেভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে সেভাবে আয় বাড়ানো সম্ভব হয় না। বিশেষ করে বিধিবদ্ধ সেবার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে ক্রেতারা হয়তো নিন্মমানের বা কমদামী পণ্য ভোগ করতে পারে। বড় বাসা ছেড়ে দিয়ে ছোট ও কম ভাড়ার বাসায় গিয়ে উঠতে পারে। প্লাটফর্ম সেবার ক্ষেত্রে কিন্তু খরচ কমানোর সুযোগ নেই। ঢাকার যানজটের কারণে সে খরচ বরং বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষ হয়তো প্লাটফর্ম সেবা না নিয়ে পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করে খরচ সাশ্রয় করতে পারে। প্লাটফর্ম কর্মীদের কিন্তু যাওয়ার জায়গা নেই। দেশের কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা তাদের নিদেন দামে সেবা বিক্রি করতে বাধ্য করছে। তারা নিজেদের জীবন যাত্রাকে উচুমানের করার সুযোগ না পেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকার সুযোগ খুঁজতে ব্যস্ত।
আমাদের অর্থনীতির গতিশীলতা, মূল্যস্ফ্রীতি রোধ করা, টাকা পাচার বন্ধ করা, দূর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ কতিপয় লোকের নিকট কুক্ষিগত করার সুযোগ বন্ধ করা এগুলোর উপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। তা না হলে কমিশন কমানোর এই দাবী ও হিসেব কখনোই শেষ হবে না।
কিছু ভাল ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। নামকরা প্লাটফর্মগুলোর কর্মীরা চিকিৎসা সহায়তা, অসুস্থতা ছুটি, এবং কখনও কখনও অসুস্থতায় এবং দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অসুস্থ অবস্থায় বেতন এবং আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। যেমন চালডাল ও দারাজ। এছাড়া ফুডপান্ডা, পাঠাও এবং উবারের তাদের কর্মীদের জন্য বীমা পলিসি রয়েছে।
দারাজের কর্মীরা জানিয়েছে তারা প্ল্যাটফর্মের সাথে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছে। অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের জন্য, কিছু কর্মী একটি অ্যাপ বা ফোন কথোপকথনের মাধ্যমে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করা বা একটি প্ল্যাটফর্মের শর্তাবলী গ্রহণ করা প্রত্যাহার করতে পারে।
দেশের বর্তমান শ্রম আইন নিয়ে এখাতের প্লাটফর্ম কতৃপক্ষের কথা আছে। শ্রম আইনের শর্ত অনুসারে শ্রমিকের সংখ্যানুপাতে কর্মক্ষেত্র বা অফিসের পরিমাপ নির্ভর করবে। প্লাটফর্মের ক্ষেত্রে যেহেতু কর্মীদের কর্মস্থল ফ্যাক্টরী বা অফিস নয়। তাই সে অনুপাতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের স্টোর বা ফুলফিলমেন্ট সেন্টারের পরিমাপ হবে না। কিন্তু কখনো কখনো সরকারী পরিদর্শকেরা পরিদর্শনে গিয়ে এই বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করেন। যা অনাকাংখিক। এজন্য শ্রম আইনে পরিবর্তন প্রয়োজন আছে।
এই মুহুর্তে সরকারের একটি কৌশলগত অবস্থান এই খাতে বৈপ্লবিক নতুন সূচনা করতে পারে।
প্রথমত, সরকার প্লাটফর্ম কর্মীদের জন্য বাই-সাইকেল, মোটর বাইক, কার, ভ্যান ক্রয় করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্যাকেজে ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণসেবা চালু করতে পারে। সরাসরি টাকা না দিয়ে দেশীয় উৎপাদক থেকে পণ্যগুলো উপকারভোগীর ঘরে পৌঁছে দিতে পারে। এতে তরুনদের বড়ো একটা অংশ স্বাধীন কর্মসংস্থান এর সুযোগ পাবে।
দ্বিতীয়ত, যেসব প্লাটফর্ম ভিত্তিক উদ্যোগ রয়েছে। তাদের পাশেও দাড়াতে পারে কারণ ব্যবসা ও সেবার পাশাপাশি তারা কিন্তু কর্মসংস্থান তৈরীতে ভূমিকা রাখছে। তাদেরকে সরকার তহবিল দিতে পারে। এই তহবিল এর পরিমাণ হবে মূলত কর্মীরা সংখ্যানুপাতে।
তৃতীয়ত, প্লাটফর্মের সহায়তা নিয়েও কিস্তিতে যান কেনার জন্য ঋণ দিতে পারে। এতে কিস্তি টাকা শোধ হবে কর্মীর আয়ের অংশ থেকে।
চতুর্থত, ভারতের ন্যায় সরকার কিছু সময়ের জন্য এই প্রক্রিয়াতে ‘‘কর্মসৃজন’’ ভাতা চালু করতে পারে। এর মাধ্যমে যেসব কর্মী প্লাটফর্ম এ যুক্ত হয়ে সামাজিক সেবা, নিত্যপণ্য সেবা, ঔষধ বিতরণ সেবা, সরকারী বিলি সেবা ইত্যাদি দিয়ে থাকে তাদের বেতনের একটা অংশ ৬ মাস যাবত ভাতা আকারে সরকার থেকে প্রদান করা।
পঞ্চমত, কোম্পানীগুলোর সুরক্ষার জন্য পুলিশকে এই ক্ষমতা দেয়া যে, তারা সিএনজি মিটার দেখার চেয়ে বাইক রাইডিং সেবায় অ্যাপ ব্যবহার হচ্ছে কিনা তাও দেখবে। মনে রাখতে হবে, এতে শুধু ইন্ডাস্ট্রি ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তা নয় বরং সরকার রাজস্বও হারাচ্ছে।
সর্বশেষ এই খাত সংক্রান্ত মানবসম্পদ নীতিমালা ও ন্যূনতম মজুরি ঠিক করার বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকে এটির পক্ষে নেই। কারণ প্রথমত সরকার নীতিমালা তৈরী করে দায় সেরে থাকে এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমতার নীতি মেনে চলে না এবং কোনো খাত উন্নয়নের আগে নীতিমালা তৈরী হলে সেটি যথাযথ নাও হতে পারে। এছাড়া নূনতম মুজুরীর ক্ষেত্রে চাপটা গিয়ে পড়বে প্রান্তিক ভোক্তার উপর। ভোক্তারা বর্তমান যে বহুমুখী চাপের মধ্যে রয়েছে সেখানে এই চাপ কতটা সহনীয় হবে। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উদ্ধগতি সে সীমাকে খুব সহজে যখন অতিক্রম করবে তখন কর্মীরা এর সুফল নাও পেতে পারে। তবে ইন্ডাস্ট্রিকে একটি ভাল অবস্থায় নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ পরবর্তী কর্মী ও পেশাজীবিদের জন্য মজবুত ভিত্তি রচনার দিকেও মনোনিবেশ করতে হবে বৈ কি?
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)