ঘিবলি ট্রেন্ডে নিরাপদ থাকবেন কিভাবে?

সোশ্যাল হ্যান্ডেল ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম খুললেই পরিচিতদের অথবা বন্ধুর ‘কার্টুন অবতার’ চোখে পড়ে। মেসি থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প; জনপ্রিয় তারকা থেকে শুরু করে ফ্রেন্ডলিস্টের সাধারণ সদস্য কোনোকিছুই বাদ পড়ছে না। নেটদুনিয়া ঘিরে নতুন ট্রেন্ড এই ‘ঘিবলি’ (ghibli) স্টাইলের ছবি। চ্যাটজিপিটি আর গ্রক থ্রি ব্যবহার করে তৈরি করা ছবি মুহূর্তের মধ্যে এই ডিজিটাল ছবি তৈরির হিরিক পড়েছে চারদিকে। ঘিবলি মূলতঃ একটি জাপানি অ্যানিমেশন স্টুডিও যা ১৯৮৫ সালে টোকিওতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি জাপানের কিংবদন্তি অ্যানিমে নির্মাতা হায়াও মিয়াজাকির হাতে গড়া। ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’ বা ‘মাই নেবার টটোরো’—এই ধরনের কাল্পনিক অ্যানিমেশনগুলির মাধ্যমে ঘিবলি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিশোর-তরুণদের মধ্যেই এই ট্রেন্ডটা হালে তুঙ্গে উঠেছে।
তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌলতে আপনার সাধারণ ছবি নিমেষের মধ্যে কার্টুন ছবিতে পরিণত করার এই প্রযুক্তি নিয়ে সতর্ক করেছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা। এর মাধ্যমে ডিপফেইক, ফেইক পর্নোগ্রাফি এমনকি ডার্ক ওয়েবেও ব্যক্তিগত ছবি বিক্রির শঙ্কা করছেন তারা। ধারণা করা হচ্ছে অগোচরেই ব্যবহারকারী যে কোনও মুহূর্তে সাইবার অপরাধের শিকার হতে পারেন। সেক্ষেত্রে পুলিশ বা প্রশাসনের দ্বারস্থ হলেও সেভাবে সুরাহা হবে না বলেই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
ঘিবলি’র ঝুঁকি কি?
ঘিবলি একটি সুপ্ত ডেটা বোম। কেননা, ঘিবলি আর্ট এর সার্ভার আমেরিকায় থাকলেও এই বিপুল পরিমাণ ছবি বা তথ্য কোন সার্ভারে জমা হচ্ছে তা এখনও অজানা। ফলে অজান্তেই ব্যক্তিগত তথ্য চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে অন্য কারো হাতে। এছাড়াও এই বট প্রযুক্তিটির ধর্ম হলো- প্রথমে বিষয়টি সম্পর্কে ধীরে ধীরে তথ্য সংগ্রহ করে এরপর বিষয়টি নিয়ে অ্যানালাইসিস করে। এই যেমন ছবির ব্যক্তি কোথায় থাকেন, পরিবারে কে কে আছেন ইত্যাদি। এরপর এসব তথ্য স্থানান্তর করে ইঞ্জিনে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে এই ছবি জেনারেট হয়।
সঙ্গতকারণেই সামনে এসেছে ঘিবলি অজানা ঝুঁকি কি, কেন এবং কীভাবে এই ‘ঘিবলি শিল্প’ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে- সেই বিষয়টি। সম্প্রতি ওপেনএআই চ্যাটজিপিটি ফোর এবং ইমেজ জেনারেশন মডেল চালু করার পর থেকে স্টুডিও ঘিবলিi স্টাইলের ছবি ভাইরাল হয়ে যায়। ওপেনএআই-এর সিইও স্যাম অল্টম্যান জানিয়েছেন, চ্যাটজিপিটির জনপ্রিয়তা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে এবং মাত্র এক ঘণ্টায় ১০ লাখ নতুন ব্যবহারকারী যুক্ত হয়েছে। তবে তার সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি সম্পর্কিত সতর্কবার্তা রয়েছে।
ঘিবলি ট্রেন্ডে চ্যাটজিপিটি
ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি মডেল ব্যবহারকারীদের তাদের ছবি ঘিবলি অ্যানিমেশন স্টাইলে রূপান্তর করার সুযোগ প্রদান করছে। এর ফলে এই প্রযুক্তি এবং ঘিবলি ছবি তৈরি করা দ্রুত একটি ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে। স্যাম অল্টম্যান জানিয়ে দিয়েছেন যে, চ্যাটজিপিটির গ্রাফিক প্রসেসিং ইউনিট (GPU) এই ট্রেন্ডের চাহিদা সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তবে এটি তাদের উদ্দেশ্য সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে।
কেন ঘিবলি জনপ্রিয়?
ঘিবলির তৈরি অ্যানিমেশনগুলি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক জনপ্রিয়। ২২টি সিনেমা এবং ৩টি টেলিভিশন বিশেষ ছাড়াও, ঘিবলি অস্কার, গোল্ডেন বিয়ার, বাফটা, এবং গোল্ডেন গ্লোবসহ একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে। ২০২৪ সালে ঘিবলি স্টুডিওর ‘দ্য বয় অ্যান্ড দ্য হেরন’ অ্যানিমেশনটি সেরা অ্যানিমেশন ছবির শিরোনাম লাভ করেছে। পরিসংখ্যান বলছে এই কার্টুন ইমেজ তৈরির জন্য মাত্র ৩০ ঘণ্টায় ১ কোটি ছবি আপলোড করা হয়েছে সার্ভারে। খুব সহজে এবং স্বল্পতম সময়েই ঘিবলি স্টাইলের ছবি তৈরি করে নিজের অবতার তৈরি করতে পারার সুযোগের মধ্যেই রয়েছে এই জনপ্রিয়তা। এজন্য চ্যাটজিপিটি ফোর এবং গ্রক থ্রি সহ অন্যান্য এআই টুল ব্যবহার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রথমে ছবিটি প্ল্যাটফর্মে আপলোড করা হয়। তারপর ‘ঘিবলি অ্যানিমেশন স্টাইল’ নির্বাচন করলেই সেকেন্ডে এআই আপনার ছবি তৈরি করে এবং আপনি সেটি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করতে পারবেন। অথচ সব ছবিতেই ঘিবলি স্টাইল কিন্তু প্রায় একই।
ঘিবলির নিরপত্তা ঝুঁকি কি?
এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে ছবি তৈরি করার প্রক্রিয়া একদিকে যেমন মজাদার, তেমনি এর পেছনে রয়েছে কিছু সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই ইমেজ জেনারেটরগুলো ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহে ব্যবহৃত হতে পারে। এটি পরিচয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে এবং সহজেই জাল নথি তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এআই টেক প্রাইভেসির সহ-প্রতিষ্ঠাতা লুইজা জারভস্কি এক্স-এ সতর্ক করেছেন যে, চ্যাটজিপিটি ও অন্যান্য এআই ইমেজ জেনারেটর সস্তা এবং সহজভাবে জাল প্রমাণ তৈরি করতে পারে। এটি সাইবার অপরাধীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে যারা খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন।
নিরাপদ থাকবেন কিভাবে?
নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে নিজেকে গুটিয়ে রাখার চেয়ে সতর্ক ও নিরাপদে সেগুলো ব্যবহারের বিকল্প নেই। তাই ঘিবলি স্টাইলের ছবি তৈরি করার ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় কিছু সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হলো-
-
হাই-রেজল্যুশন ছবি এআই ট্রেনিংয়ের জন্য ব্যবহার হতে পারে, তাই সাবধানে ছবি আপলোড করুন।
-
আপনার ছবি আপলোড করার আগে প্ল্যাটফর্মের গোপনীয়তা নীতি ভালোভাবে যাচাই করুন।
-
অ্যাপ ডাউনলোডের সময় ক্যামেরা ও গ্যালারির অ্যাক্সেস বন্ধ রাখুন।
-
রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখুন আপনার ছবি অপব্যবহার হচ্ছে কিনা।
-
অবগত থাকুন যে, কীভাবে এবং কোথায় আপনার ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে।
অবশ্য সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সচেতন থাকলে ঘিবলি প্রযুক্তিতে আপাতত কোনো বড় ঝুঁকি দেখছেন না সাইবার ৭১-এর পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাবের। তবে প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন শেয়ার করা এবং অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের সময় একে অপরের প্রোফাইল দেখার বিষয়টি নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে বলে আশঙ্কা তার। একইভাবে সাইবার নিরাপত্তা এবং তথ্যপ্রযুক্তি সুরক্ষা নিয়ে সচেতন থাকলে ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি শেয়ারে সবসময়ই সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সাইবার সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা এবং সাইবার ক্রাইম অ্যাওরনেস ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা মেহেদী হাসান।