বাংলাভাষীদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে পারে এআই : শামীম

এআই-এর ভাষা দক্ষতা ও মানবিক আবেগের সংমিশ্রণে যুবকের জীবন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি
স্কুল জীবন কেটেছে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় । এরপর ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক। এরপর মেডিকেল ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে ভর্তি হন। এমন করেই জীবনকে খেলাচ্ছলেই দেখেন ড. মাহফুজ শামীম। এরপর সাহিত্যে অধ্যায়নের ফুসরতে সারাদিন পড়ে থাকবেন তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে! পিএইচডি করেছেন প্রকল্প ব্যবস্থাপনা নিয়ে; বিশেষভাবে তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প। এক যুগেরও বেশি সময় কাজ করছেন দক্ষতা উন্নয়ন নিয়ে। অধ্যাপনা, প্রশাসন, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, বিশ্বব্যাংক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্তৃপক্ষ, সরকারের বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প… মধ্য বয়স পেরোনোর আগেই কোথায় কাজ করেননি তিনি! জীবনের মতো অন্য সব কিছু নিয়েও নিরীক্ষা করাই তাঁর খেলা। দেশি-বিদেশী কুড়িটিরও বেশি গবেষণা জার্নালের প্রধান সম্পাদক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে লেখা জার্নাল আর্টিকেলের পৃথিবীতে প্রথম প্রকাশক তিনি; যা আমেরিকার লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস স্বীকৃত। তবুও যেন তিনি সন্তান ইশান-আয়ানের মতোই সরল আর নিরীক্ষা প্রিয়। বাংলাভাষায় এআই গ্রন্থিত প্রথম উপন্যাস যুবক যেখানে যেমন বই প্রকাশের পর নতুন নতুন প্রিয়দের কাতারে যুক্ত হয়েছেন তিনি। এবার তারই মুখোমুখি হন ডিজিবাংলাটেক নির্বাহী সম্পাদক ইমদাদুল হক।
প্রশ্ন: আপনার উপন্যাসের মূল উপজীব্য কি? কাহিনী সক্ষেপে যদি বলতেন..
উত্তর: ‘যুবক যেখানে যেমন’ বাংলা ভাষার প্রথম এআই রচিত উপন্যাস, যা বাস্তব ও কল্পনার সীমানায় দাঁড়িয়ে মানুষের মানসিক জটিলতা, সামাজিক টানাপোড়েন ও আত্মঅনুসন্ধানের গল্প বলে। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র অনিক নামীয় এক যুবক, যার জীবন প্রবাহে নানাবিধ পরিবর্তন আসে, পরিচিত ও অচেনা পথের বাঁকে। তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যেন একধরনের ধাঁধার মতো জট পাকিয়ে আছে। সমাজের প্রচলিত নিয়ম, সম্পর্কের জটিলতা ও নিজস্ব অস্তিত্বের প্রশ্ন তার চিন্তার জগতে এক নতুন আলোড়ন তোলে। সে কখনো নিজের পরিচয়ের অনুসন্ধানে, কখনো বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়াতে চায়, আবার কখনো এক নতুন জীবনের সন্ধানে অগ্রসর হয়।
এই উপন্যাসে এআই-এর ভাষাগত দক্ষতা ও মানবিক আবেগের সংমিশ্রণে এক নতুন সাহিত্যধারা ফুটে উঠেছে। গল্পটি মানুষের মনস্তত্ত্ব, সম্পর্কের গভীরতা এবং বাস্তব ও কল্পনার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা একজন যুবকের জীবন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।
প্রশ্ন: উপন্যাসটি লিখতে কতদিন সময় লেগেছে…
উত্তর: মাত্র ৫ দিন মোট ৮ ঘণ্টায়।
প্রশ্ন: সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ কখন থেকে?
উত্তর: ছাত্র জীবন থেকেই। বলা যায়, স্কুল জীবন থেকে। উচ্চ মাধ্যমিকের পর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েও শুধু সাহিত্যে অনুরাগের কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হই । বাংলা সাহিত্যে সম্মান ও মাস্টার্সে পড়াশুনা করি ১৯৯৮-২০০৩ সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ২০০০ সালে আমার প্রথম উপন্যাস নিউরোনিক শূন্যতা এবং ২০০২ সালে একটি মহাপ্রলয়ের ভূমিকাংশ অথবা প্রবাস্তবতার উপাখ্যান প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্ন: এআই উপন্যাসে কতগুলো চরিত্র আছে? চরিত্রগুলো কি বাংলাদেশের কোনো বিশেষ অঞ্চল বা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেছে?
উত্তর: না। একটা কমন ২২-৩০ বছর বয়সের যুবক যে প্রতিদিনই পারিবারিক সামাজিক চাপে জর্জরিত। সে মূলত পুরো উপন্যাস জুড়েই জীবনের অর্থ খুঁজছে। সে যে কোনও বাঙালি যুবক । প্রধান চরিত্র একটিই। বাকি সবই তার পরিবার আর বন্ধু। কোনো নায়িকা চরিত্র বা প্রেম এখানে আসেনি।
প্রশ্ন: প্রযুক্তির সঙ্গে সাহিত্যের মেলবন্ধনের চিন্তাটা কবে থেকে শুরু?
উত্তর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ার সময় আমাদের সমন্বিত বিষয় ছিল কম্পিউটার বিজ্ঞান। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তখন থেকেই সাহিত্যে প্রযুক্তির অন্তর্ভূক্তির চিন্তাটা মাথায় আসে। সেটা ২০০২ সালের কথা। তখন সম্মান তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ার সময় প্রোগ্রামিং শিখি। মনে হতো, প্রোগ্রামিং দিয়ে কী কী করা সম্ভব আর বাংলা ভাষায় বা সেটা কীভাবে কাজে লাগানো যায়! যা হোক, তখন তো আর এআই ছিল না । বলতে পারেন, অনেকটা পরীক্ষামূলকভাবে এ লেখার চিন্তা।
প্রশ্ন: কবে থেকে এআই ব্যবহার শুরু করেন? চ্যাটজিপিটি ছাড়া আর কি কি ব্যবহার করেন?
উত্তর: ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে চ্যাট জিপিটি ব্যবহার করছি। এখন এর পাশাপাশি জেমিনি ও কো-পাইলট ব্যবহার করছি।
প্রশ্ন: এআই কতটা মুন্সিয়ানার সঙ্গে বাংলাভাষীদের মানসপটকে চিত্রিত করতে পারছে?
উত্তর: এটি আসলে সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এআই মডেল সমৃদ্ধ হতেও সময় লাগে। শুরুর সময় হিসেবে এটি বেশ ভালোভাবেই বাংলাভাষীদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে পারে ; তবে সবই নির্ভর করে আপনার প্রম্পটের ওপর। তাই প্রতিটি উত্তর পড়ে তার ভিত্তিতে পরবর্তী প্রম্পট দেয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: বাংলা সাহিত্য পড়াটা পারিবারিক ভাবে সাধারণত ভালোভাবে নেয়া হয় না। মেডিকেলে না পড়ে সেই চ্যালেঞ্জটা কিভাবে নিলেন?
উত্তর: সাহিত্য আড্ডা দিয়ে আপনি হয়তো একসাথে ১০ জন মানুষের সাথে ভাবনা ভাগ করতে পারতেন আর এখন এআই দিয়ে একসাথে ৬০০ কোটি মানুষের ভাবনার অংশীদারিত্ব পাচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়া এসে তার ধরনটাই পাল্টে দিয়েছে। থিয়েটার-আড্ডা কমেছে। একদিন অবশ্যই এআই সহিত্য সাধনায় নতুন কোনো পথ রচনা করবে।
প্রশ্ন: চাকরি জীবনে এসে চিকিৎসক না হওয়ার জন্য কখনো অনুশোচনা বোধ হয়েছিলো কি?
উত্তর: প্রশ্নই ওঠে না। যে কোনও পরিস্থিতিতেই আমি বর্তমান নিয়ে খুবই খুশি। কখনোই হয় নি। এখনও হয় না। আমি সব সময়ই নিরীক্ষা প্রবণ । যেমন এ জীবনে কোথাও ৫ বছরের বেশি চাকুরীও করিনি। ৫ বছর শিক্ষা ক্যাডার , ৫ বছর প্রশাসন ক্যাডার, এরপর ইউএনডিপি, পিকেএসএফ, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক হিসেবে আইসিটি প্রকল্পে … স্কুল জীবন থেকে সাংবাদিকতা করতাম, পত্রিকায় কলাম লেখা, ছোট কাগজে গল্প আর সমালোচনা লেখার কাজও করেছি অনেক বছর। মাঝের প্রায় ১৫ বছর কিছুই লিখিনি।
প্রশ্ন: এআই নিয়ে জেনজি-দের ক্যারিয়ার ভাবনা কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
উত্তর: সকলকেই এটা জানতে হবে যে, কীভাবে এআই দিয়ে নিজের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা যায় – সে যে কাজই করুক না কেন।
ডিজিবাংলা: ব্যস্তসময়ে ধৈর্য ধরে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেয়ায় আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. মাহফুজ শামীম: আপনাকেও ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা যারা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে আমার কথা পড়লেন।
“যুবক যেখানে যেমন” উপন্যাসটি একটি আত্মদর্শনমূলক ও জীবনের দার্শনিক চিন্তায় ভিত্তি করে রচিত কাহিনি, যেখানে প্রধান চরিত্র অনিকের জীবনের ভেতরের দ্বন্দ্ব, আত্মবিশ্বাসের লড়াই এবং ভবিষ্যৎ গঠনের সংগ্রাম চিত্রিত হয়েছে। উপন্যাসটি মূলত একজন যুবকের আত্ম-অনুসন্ধান, স্বপ্ন ও বাস্তবতার সংঘর্ষ, এবং সামাজিক ও পারিবারিক প্রত্যাশার বিপরীতে তার নিজস্ব পথ খোঁজার গল্প। নিঝুম রাতের শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নিজের জীবনের গভীর প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হয়। এক বৃদ্ধ চাচার সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে সে জীবনের উদ্দেশ্য, সংগ্রাম, সুখ-দুঃখের সংজ্ঞা এবং আত্ম-আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নতুন উপলব্ধি লাভ করে। তার জীবনের বড় চ্যালেঞ্জ আসে তখন, যখন সে নিজের স্বপ্ন—একজন প্রকৌশলী হওয়া—নিয়ে পরিবারের চাপে পড়ে যায়। তার মা-বাবা এবং বড় ভাই তাকে এক স্থিতিশীল ক্যারিয়ার বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেয়, কিন্তু অনিক নিজের স্বপ্নকে ছাড়তে চায় না। তার মা-বাবা এবং বড় ভাই চান, সে যেন পরিবার ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু অনিক নিজের স্বপ্নের সঙ্গে আপস করতে চায় না। পারিবারিক প্রত্যাশা বনাম নিজের ইচ্ছার দ্বন্দ্ব তাকে কঠিন সিদ্ধান্তের মুখে ফেলে।
উপন্যাসটি জীবনের বাস্তবতা ও কল্পনার টানাপোড়েন, সমাজের চাপের বিপরীতে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুত্ব এবং একজন যুবকের আত্ম-উন্নয়নের যাত্রাকে তুলে ধরে। লেখক জীবনকে একটি সমুদ্রের তরঙ্গের মতো চিত্রিত করেছেন, যেখানে কখনো শান্তি, কখনো সংগ্রাম, এবং কখনো আত্ম-জিজ্ঞাসার মুহূর্ত আসে। এই উপন্যাসের প্রধান উপজিব্য হলো—স্বপ্ন ও বাস্তবতার সংঘর্ষ, আত্ম-আবিষ্কার, পারিবারিক ও সামাজিক প্রত্যাশার ভার, এবং জীবনের অর্থ খোঁজার নিরন্তর প্রচেষ্টা। এটি যুবকদের জীবনের গভীর সত্য ও বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি অনুপ্রেরণামূলক উপন্যাস, যা পাঠকদের স্বপ্ন অনুসরণের সাহস যোগাবে।