সাবমেরিন কোম্পানির থেকে ২০০ গিগ ব্যান্ডউথ কিনেছে স্টারলিংক
স্টারলিংকের কাছে ডিসকাউন্ট চেয়েছে সরকার

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও উদ্যোগে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক। এর মাধ্যমে ইন্টারনেট-কে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে যাচ্ছে সরকার। ফলে এটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত অর্জন নয়, বরং দেশের ডিজিটাল কাঠামোর জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বল মন্তব্য করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি বলেছেন, আমরা কখনোই কোনো অবস্থায় ইন্টারনেট বন্ধ করবো না এবং ভবিষ্যতেও যেন কেউ তা করতে না পারে সেজন্য টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধনের কাজ চলছে। আইনটি কিছুটা জটিল হওয়ায় সময় লাগছে। তবে আগামী এক বছরের মধ্যে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। এ নিয়ে আরো বিস্তারিত জানুন-ডিজিবাংলাটেক.নিউজ এর টেক-টক-এ।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে স্টারলিংকের বাংলাদেশে ব্যবসায়িক মডেল কী? সেখানে থেকে সরকার কতটা সুযোগ পাবে?
উত্তর: স্টারলিংকের বিজনেস মডেল তারাই নির্ধারণ করে। এটি সরাসরি গ্রাহক ও এন্টারপ্রাইজ চ্যানেলের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এজন্য আমরা রেগুলেটরি গাইডলাইন ও এনজিএসও গাইড লাইসেন্স করেছি। প্রতিবছর তাদের কাছ থেকে নির্দষ্ট ফি পাবো। তবে আমাদের একটা রিক্যুয়েস্ট ছিলো আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠান-বাংলাদেশ সাবমেরিন কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) ও বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানিকে তারা অ্যাকোমোডেট করে। ইতিমধ্যেই স্যাটেলাইটের সঙ্গে একটা এমওইউ হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি এখানে স্থানীয়ভাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করে। লক্ষ্য হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহজলভ্য ও স্কেলযোগ্য কানেক্টিভিটি সলিউশন তৈরি করা
প্রশ্ন: বাংলাদেশে স্টারলিংক-এর প্যাকেজগুলো উচ্চ মূল্যের। বাংলাদেশর জন্য কাস্টমাইজড প্যাকেজ করতে সরকার বলবে কিনা?
উত্তর: এটা স্টারলিংকের প্রতিনিধিরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমরা দেখেছি, বর্তমানে তারা বাংলাদেশে যে প্যাকেজ দিয়েছে তা শ্রীলঙ্কার তুলনায় কম। আমরা বুঝতে পারছি সামনের দিনে স্টারলিংকের ইউজ কেইস বাড়বে। উপকূলীয় ও দুর্গম এলাকায় যারা হাইস্পিড ইন্টারনেটের বাইরে ছিলো তাদের সংযুক্ত হওয়া সহজ হবে। এতে ভাবিষ্যমে মূল্য ফ্লেক্সিবল হবে বলে মনে করি। তবে আঞ্চলিক মূল্য হিসেবে শ্রীলঙ্কার থেকে আমাদের মূল্য কম।
প্রশ্ন: বর্তমানে বাংলাদেশে কতজন গ্রাহক স্টারলিংক-এ সাবস্ক্রাইব করেছেন তা নিশ্চিত করতে পারেন?
উত্তর: এই মুহূর্তে গ্রাহক সংখ্যার বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ সার্ভিস এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে এবং অনবোর্ডিং চলছে। তারাই এই বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারবে। তবে আমরা কিছু আইনিটি জটিলতায় পড়েছি। ট্যাক্স জটিলতায় গ্রাহককে এখনো আমরা অনেককেই সংযোগ দিতে পারিনি। এটা সলভ করছি। আগামীতে সংখ্যার বিষয়টি বিটিআরসি থেকে দেয়া হবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে স্টারলিংক-এর চূড়ান্ত অফিসিয়াল লঞ্চ১৮ জুলাই করা হচ্ছে কেন?
উত্তর: যদিও সার্ভিসটি প্রযুক্তিগতভাবে আগেই চালু হয়েছে। যখন লাইসেন্স নেয় তখন সফট লঞ্চ হয়েছিলো। আজ (১৮ জুলাই) অফিসিয়ালি লঞ্চ হচ্ছে। কেননা, ১৭ জুলাই ২০২৪ সালে রাতের বেলায় ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট করে ম্যাসিভ ক্র্যাকডাউন করা হয়েছিলো। এই দিনে আমরা শপথ নিয়েছি যে, আমাদের সরকার বা ভবিষ্যতের কোনো সরকার আর ইন্টারনেট বন্ধ করবে না- এই ম্যাসেজ আমরা দিতে চাই। আমরা তরুণদের কাছে এই বার্তা দিতে চাই যে- আগামীতে কেউ আর আনকানেক্টেড থাকবে না। ভবিষ্যতে এমন শাটডাউন আর না হয় সে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
প্রশ্ন: গত বছর যারা ইন্টারনেট শাট ডাউনে বিটিআরসি ও মন্ত্রণালয়ের যারা জড়িত ছিলো তাদের বিজার কি অবস্থায় রয়েছে?
উত্তর: এটা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। তৎকালীন মন্ত্রী জেলে আছে। তাদের নির্দেশেই এটা হয়েছে। তৎকালীন স্বৈরাচারি সরকারের যারা স্টেকহোল্ডার, প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী পর্যায়ের লোকজন জেলে আছে। তাদের একাধিকবার রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি সেখানে নিশ্চয় আসবে।
প্রশ্ন: স্টারলিংকের ডিভাইসের দাম বাংলাদেশের মানুষের জন্য বোঝা। এই ডিভাইস কি বাংলাদেশে ম্যানুফ্যাচারের পরিকল্পনা আছে কি না; কিংবা আমদানিকৃত ডিভাইসে নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে কি না।
উত্তর: এই ধরণের কোনো আশঙ্কা নেই। এটিতে যেহেতু একটি ট্রেডিশনাল ডিশ ও রাউটার আছে সে জন্য এটির দাম বেশি পড়ছে। কিন্তু আমাদের হাতে যেসব মোবাইল আছে তার দাম অনেকক্ষেত্রে এরচেয়েও বেশি। আর এই হার্ডওয়্যারটি যেহেতু কমিউনিটি কানেক্টিভিটির জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, সেজন্য আমাদের হাটা বাজার, কো-ওয়ার্কি স্পেসে একটি ডিশ দিয়ে অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে। যে কেউ এটা শেয়ার করে ব্যবহার করতে পারবে। ভাবুন, বাংলাদেশের বহু রিমোট মোবাইল টাওয়ারে যে পরিমাণ টোটাল ইফেক্টিভ ইন্টারনেট দেওয়া হয়, স্টারলিংকের একটি ডিশ এককভাবে সেটা দিতে পারে। এটা উদ্যোক্তারা শেয়ার করে ব্যবহার করতে পারে। সেই ক্ষেত্রে এটি বেশি দাম বলার কারণ নেই। পেইজারের মতো দুর্ঘটনা ঘটার কারণ নেই।
প্রশ্ন: স্টারলিংক কি গ্রামীণ কানেক্টিভিটি ও স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা খাতে সহায়তা করতে পারবে?
উত্তর: হ্যাঁ, গ্রামীণ স্কুল, মোবাইল ক্লিনিক ও দুর্গম এলাকায় এখন নির্ভরযোগ্য, উচ্চগতির ইন্টারনেট পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের বেশ কিছু এনজিও একটি কন্টেইনারের মধ্যে চিকিৎসা সেবা ও ডায়াগনস্টিক করে। তারাও স্টারলিংক দিয়ে টেলিমেডিসিন সেবা দিতে পারে। আমরা দেশের হাওর বাওরে মোবাইল আইসিটি ল্যাব নিয়ে যাবো সেখানে তারা স্টারলিংক দিয়ে কানেক্টেড থাকবে। মোটকথা সংযোগের বাইরে থাকা নাগরিকদের সংযুক্ত করতে বাংলাদেশে স্টারলিংক-এনেছি।
প্রশ্ন: স্যাটেলাইট ইনটারনেট নিয়ে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় কী আছে? আমাদের বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কি স্টারলিংকের অংশীজন হচ্ছে? জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে স্টারলিংক স্যাটেলাইটকে আমরা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো?
উত্তর: আমাদের সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত আমরা কখনোই ইন্টারনেট বন্ধ করবো না। ভবিষ্যতেও কোনো সরকার যেন বন্ধ করতে না পারে সেজন্য আমরা টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধনের লক্ষ্যে গাইডলাইন নিয়ে কাজ করছি। যেহেতু এটা জটিল ধরনের আইন। তাই সময় লাগছে। এক বছরের মধ্যে যদি আমরা আইনটা শেষ করতে পারতাম তাহলে ভালো হতো। তারপরেও আমরা শিকার করছি, আমাদের দেরি হচ্ছে। আমরা সময় নিচ্ছি যাতে করে আমরা আইনটাকে এমন স্তরে নিয়ে যাবো যেন ইন্টারনেট আর বন্ধ করা যাবে না। বিটিআরসি বর্তমানে এমন একটি নীতিমালা ও আইনি কাঠামো তৈরি করছে, যাতে কোনো সরকার জাতীয়ভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে এবং নাগরিকদের সংযোগের অধিকার সুরক্ষিত থাকে।
প্রশ্ন: স্টারলিংক সব এলাকায় কি সমান সার্ভিস কোয়ালিটি পাওয়া যাবে?
উত্তর: ব্যক্তি ও স্থান- শহর-গ্রাম, পাহাড় কিংবা সমতলে স্টারলিংক নিরপেক্ষ। স্টারলিংক সব ব্যবহারকারীকে সমানভাবে দেখে—শহর বা গ্রাম, সার্ভিস কোয়ালিটি সারা দেশে একই থাকবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট খাতে কি অন্য কোম্পানিও আসছে? ভ্যাট-ট্যাক্স এর জটিলতা কি দূর হয়েছে?
উত্তর: হ্যাঁ, আরও চারটি কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। এর মধ্যে OneWeb আসাতে চাইছে। তবে তারা শুধুমাত্র B2B অর্থাৎ কর্পোরেট সেগমেন্টে কাজ করবে। এই প্রতিযোগিতা ব্যবহারকারীদের জন্য সুফল ও উদ্ভাবন নিয়ে আসবে। ভ্যাট-ট্যাক্স বিষয়টি হচ্ছে- স্টারলিংক অ্যাজাইল ওয়ার্ক করে। তাদের কাজের ধরণ ফ্লেক্সিবল। ট্যাক্স-ভ্যাট নিয়ে আমাদের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে হয়। সব জায়গায় এক্যুমোলেড করতে আমাদের কিছুটা দেরী হয়েছে।
প্রশ্ন: আমরা শুনেছিলোম ইলন মাস্ককে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো। তিনি কি আসবেন? বিদেশী বিনিয়োগ কি বাড়বে?
উত্তর: ইলন মাস্ক বাংলাদেশে আসলে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের তরুণ সমাজের জন্য একটা প্রণোদনা হবে। কেননা, আজকে সবাই উদ্যোক্তা হতে চায়। আর ইলন মাস্ক পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তাদের একজন। ইতিমধ্যেই স্টারলিংক আমাদের সাবমেরিন কোম্পানির কাছ থেকে ২০০ গিগ ব্যান্ডউথ কিনেছে। এর মাধ্যমে এফডিআই ইতিমধ্যেই আশা শুরু করেছে। আমি মনে করি স্টারলিংক আসার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইজ অব ড্যুইং সহায়কীকরণ সূচকে আমাদের ব্র্যান্ডিং ভালো হবে।
প্রশ্ন: টেলিকম নীতিমালা কোন পর্যায়ে আছে? নির্বাচনের আগে করার বিষয়ে কোনো বাধা আছে কি না?
উত্তর: টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির বিষয়। এরসঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের লাইসেন্স প্রক্রিয়া সহজ ও বিশ্বমানের করতে আমরা কাজ করছি। দ্রুতই কাজটি শেষ হবে?
প্রশ্ন: Starlink-এর উপস্থিতি কি বাংলাদেশের ব্যবসা সহজ করবে?
উত্তর: হ্যাঁ। উন্নত কানেক্টিভিটি FDI বাড়াবে, উদ্ভাবনকে সহায়তা করবে এবং বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিতে আকৃষ্ট করবে।
প্রশ্ন: সরকার কীভাবে স্টারলিংক থেকে রাজস্ব আদায় করবে?
উত্তর: স্টারলিংকের প্রতিটা ডিভােইস থেকে সরকার রেভিনিউ আর্ন করবে। অর্থাৎ লাইসেন্স ফি, VAT ও গেটওয়ে অ্যাক্সেস ফি-এর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় হবে। এছাড়া, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (BSCL) রিটেইল পার্টনার হিসেবে স্থানীয় বিতরণ ও কমপ্লায়েন্সে সহায়তা করবে।
প্রশ্ন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সহায়তার জন্য সরকারের সঙ্গে কোনো চুক্তি হচ্ছে কি?
উত্তর: এরকম কোনো চুক্তি হচ্ছে না। তেবে লরেন ড্রায়ার ও রিচার্ডের সঙ্গে আজ আমাদের কিছু আলোচনা হয়েছে। সেই আলোচনায় বিষয়গুলো উঠে এসেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অংশ হিসেবো আমাদের ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি স্কুলে ইন্টারনেট পৌঁছতে হবে। সেজন্য আমরা তাদের সঙ্গে এঙ্গেজ হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছি। এক্ষেত্রে আমরা কতটা ডিসকাউন্ট পেতে পারি তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। স্টারলিংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালযয়ের ডরমেটরি, নার্সিং কলেজ ও পাবলিক ইনস্টিটিউশনের জন্য ভর্তুকি বা বিশেষ কানেক্টিভিটি প্রোগ্রামের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। পরে এ বিষয়ে বলতে পারবো।
প্রশ্ন: ৯০ দিনের মধ্যে স্টারলিংকের বাংলাদেশ গেটওয়ে করার কথা ছিলো। এরই মধ্যে ৬০ দিন শেষ হয়েছে। এখনো গেটওয়ে স্থাপন করা হয়নি। বাকি ৩০দিনের মধ্যে কি সেটা সম্ভব হবে?
উত্তর: জ্বি, গেটওয়ের কাজ চলছে। যেহেতু আমি বলেছি যে, ট্যাক্স-ভ্যাটের কিছু জটিলতা ছিলো; সেগুলো সমাধান করতে কিছুটা সময় লেগেছে। আরো কয়েকদিন গেলে আমরা টের পাবো কোন অবস্থায় আছে। আমরা যতদূর জানি গেটওয়ে স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে।