সরকারি-বেসরকারী যৌথ অংশীদারিত্বে বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট ইন্টারনেট অ্যাকসেস সম্ভব

ড. ইমাদুর রহমান। মুসলিম এইড সুইডেন চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান। একাডেমিক রিসার্চার, উদ্ভাবক, সমাজসেবী এবং বিশ্বটেলিকম খাতের নেতৃস্থানীয় প্রবাসী বাংলাদেশী। ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনে রয়েছ তার ১৭ বছরের বেশি সময়ের গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা। নিজ নামে পেটেন্ট রয়েছে ৩ শতাধিক। দেড় যুগের অীভজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে দেশের স্যাটেলাইট খাতের ক্ষত শুকিয়ে জাতীয় গৌরবের প্রতীক হিসেবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হাল ধরছেন বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের। মহাকাশেও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় বিদেশী নয়; দেশীয় প্রেসক্রিপশন তৈরিতে মনোনিবেশ করেছেন দায়িত্ব গ্রহণের পরেই। সম্প্রতি নিজ দফতরে বসে ডিজিবাংলাটেকডটনিউজ নির্বাহী সম্পাদক এস এম ইমদাদুল হক এর কাছে তুলে ধরেছেন নিজের কার্যক্রম, ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার কথা। আলাপচারিতায় তিনি জানিয়েছেন,পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আর্থ অবজারভেটরি স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। তবে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এই খাতে এগিয়ে আসলে বাংলাদেশ থেকেও নিম্ন উপগ্রহে একটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করে পুরো ভূখন্ডকে সহজেই একটি অন্তর্ভূক্তিমূলক শক্তিশালী কৃত্রিম উপগ্রহ ভিত্তিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন ব্যয় নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। আপনার মত জানতে চাই-
উত্তর: বাংলাদেশ স্যাটেলাইট -১ আমাদের বিনিয়োগটা হয়তোবা যা হওয়ার কথা ছিলো তার থেকে বেশি হয়েছে। অবশ্য যে সার্ভিসটা আমাদের দিচ্ছে- কমিউনিকেশন ও ব্রডকাস্টা সেটা দরকার ছিলো। কিন্তু আমরা এ জন্য বেশি ব্যয় করেছি। ওই হিসাব করলে এটা হওয়া উচিত হয়নি।
প্রশ্ন: অপচয় করা ব্যয়ের অঙ্ক কত?
উত্তর: ভেরি টাফ টু সে। অনুমান করে বলতে পারি, ৩০ শতাংশ খরচ বেশি হয়েছে। এক্সাক্ট নম্বরটা বলতে পারছি না। অনেক খাতে খরচ করা হয়েছে, যেটা কোনো প্রফেশনাল অর্গানাইজেশন দিয়ে করানো হলে, দেশের কথা চিন্তা করে করা হতো না। বালিশ কাণ্ডের মতো ১০ টাকার জিনিস কিনতে ২০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ইন-জেনারেল ওভার প্রাইসিং হয়েছে।
প্রশ্ন. গত ৭ বছরে বাংলাদেশ স্যাটেলাইটের অর্জন কি?
উত্তর: বাংলাদেশ স্যাটেলাইট -১ অনেক সক্ষমতা থাকলেও অর্জন কম। সাত বছরেই ব্রেক ইভেনে আসার কথা থাকলেও লসে আছি। কারণ, ৫ আগষ্টের পূর্বের ম্যানেজমেন্ট সেটা কাজে লাগায়নি। ব্যবসায়িকভাবে স্যাটেলাইটকে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করেনি। তবে পূর্বে আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো্ বিদেশি স্যাটেলাইট ব্যবহার করার ফলে বৈদিশিক মুদ্রা বাহিরে চলে যেত। এখন সেগুলো দেশেই আছে। এ ছাড়া সশস্ত্র বাহিনী নিজস্ব স্যাটেলাইট বিএস-১ এ সার্ভিস ব্যব্হার করার ফলে দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু এটা যেভাবে ব্যবহার করার কথা ছিলো তা হয়নি।
প্রশ্ন. বিনিয়োগের কতা টাকা ফেরত আনতে পেরেছে আমাদের স্যাটেলাইট?
উত্তর: এখন পর্যন্ত কোম্পানির রাজস্ব আয় প্রায় ৯৭০ কোটি টাকা। যদিও এর মধ্যে অপারেশনাল কষ্ট বাবদ খরচ রয়েছে। এছাড়াও মূল সেবাগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন ভ্যালু এ্যডেড সার্ভিস এর মাধ্যমে কোম্পানির আয় বাড়ানো হচ্ছে।
প্রশ্ন. বৈদেশিক বাজারে আমরা কেন যেতে পারছি না? বাধা কোথায়?
উত্তর: ৫ আগষ্টের পূর্বে বিভিন্ন জনের স্বার্থে বৈদিশিক বাজারে বাংলাদেশকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এছাড়াও বাংলাদেশ স্যাটেলাইট-১ ব্যান্ডউইথের সেবামূল্য বাজার মূল্য থেকে অনেক বেশি এবং ব্যান্ডউইথ তরঙ্গ ভিন্ন হওয়ায় আমরা বৈশ্বিক বাজারে পিছিয়ে পড়েছি। এ ধরনের সমস্যার সমাধান করাও হয়নি। এছাড়াও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের পূর্বে যেসব দেশে স্যাটেলাইট ফুটপ্রিন্ট রয়েছে সেসব দেশের সাথে কোঅর্ডিনেশন করা হয়নি। তাই ওইসব দেশে এখন ল্যান্ডিংস রাইটস নিয়ে কাজ করা কঠিন হচ্ছে।
প্রশ্ন. অথচ শুরুতে আমাদের টার্গেট ছিল যেসব দেশে আমাদের স্যাটেলাইটের ফুটপ্রিন্ট পড়বে সেসব দেশে আমরা ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারবো। কেন হলো না?
উত্তর: স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের পূর্বে যেসব দেশে স্যাটেলাইট ফুটপ্রিন্ট রয়েছে সেসব দেশের সাথে কোঅর্ডিনেশন করতে হয় কিন্তু সেটা করা হয়নি। তাই ওইসব দেশে ল্যান্ডিংস রাইটস নিয়ে এখন কাজ করা কঠিন হচ্ছে। তারপরও ব্যবসার কয়েকটি চুক্তির সম্ভাবনা ছিল। তৎকালীন ম্যানেজমেন্ট বাধায় সেগুলো হয়নি। উদাহরণস্বরুপ নেপালে ডিটিএইচ সেবা ৫ টা ট্রান্সপন্ডার কেইউ ব্যান্ডের বিক্রির সম্ভাবনা থাকলেও তৎকালীন ম্যানেজমেন্ট ও রাজনৈতিক বাধায় তা হয়নি।
প্রশ্ন: বিএস-১ থেকে প্রাপ্ত আয়ে আপনি সন্তুষ্ট কি না?
উত্তর: এখনো বিএস-১ এর মোট সক্ষমতার ৩৫ শতাংশ অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। কিন্তু এখন এগুলো বিক্রি করতে গিয়ে দাম পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া আগেই প্রাইস হাই করে রাখায় বিশ্ববাজারে আমাদের নিয়ে একটু নেতিবাচক অবস্থায় রয়েছি। কিন্তু আগে ব্যয় বেশি হওয়ায় দামও কমাতে পারছি না। প্রথম হাফে যদি ঠিকঠাক আয় করতে পারতাম, তবে এখন প্রফিটে যেতে পারতাম। বাজারে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকায় আমরা এই সমস্যায় পড়েছি।
প্রশ্ন: তাহলে কি বিএস-১ থেকে কোনো লাভ আসবে না?
উত্তর: সাত বছর চলে গেছে। বাকি আছে আট থেকে সাড়ে আট বছর। এখন প্রফিটতো তো দূরের কথা খরচ তুলে আনাই ভেরি টাফ হবে।
প্রশ্ন. আমরা কি বৈদেশিক বাজার অন্বেষণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি? না দিলে কবে থেকে শুরু হচ্ছে?
উত্তর: বর্তমানে বিদেশি গ্রাহকদের নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। ফিলিপাইনস, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও নেপালে কথা চলছে। বৈদিশিক বাজারে বিক্রি করার জন্য সর্বো্চ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। যেহেতু আফগানস্তান, কাজাগিস্তান, কিরগিজস্তানে কাভারেজ আছে, সেখানেও ক্রেতা খুঁজছি।
প্রশ্ন. দেশীয় বাজারের কত শতাংশ স্যাটেলাইটের কাভারেজে এসেছে?
উত্তর: ব্রডকাস্ট ইন্ড্রাষ্টিতে আমরা শতভাগ স্বনির্ভরতা অর্জন করেছি।
প্রশ্ন. দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই। কবে নাগাদ আমাদের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট মহাকাশে উড়বে?
উত্তর: আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট সরকারের বিভিন্ন জায়গায় কথা বলা হচ্ছে। ফাইন্যান্স কীভাবে হবে সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এটা সরকারের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে। এক্ষেত্রে আমার দেশের টাকা সাশ্রয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
প্রশ্ন. দ্বিতীয় স্যাটেলাইট ওয়েদার স্যাটেলাইট হবে বলে শোনা গিয়েছিলো; এখনও কি ওই পরিকল্পনা ঠিক আছে নাকি নতুন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হবে?
উত্তর : দ্বিতীয় স্যাটেলাইট আর্থ অবজারভেশন নিয়ে হবে। এটা একটি রিমোট স্যাটেলাইট। আমাদের ভূমি, কৃষি, পানি সম্পদকে কাজে লাগাতে এটি কাজে লাগবে। বিশেষ করে ন্যাশনাল সিকিউরিটি, সভরেইনিটি ও ইকোনোমিক গ্রথের জন্য এই উদ্যোগ নেয়া হবে। এক্ষেত্রে আমারা পুরোনো ভুল নতুন করে করতে চাই না। বিন-১ উৎক্ষেপন করে আমরা এর বিজনেস কেইস খুঁজেছি। এখন আমরা আগেই কাস্টমার বেইজড তৈরি করবো। আর্থসামাজিক প্রভাব মূল্যায়ণ করছি। এ নিয়ে ডিটেইল আলোচানা হয়েছে। ৪টি কোম্পানি থেকে প্রোপোজালও পেয়েছি। সেগুলো ডিসিশন মেকারদের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রশ্ন: দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনে সম্ভাব্য ব্যয় কেমন হতে পারে?
উত্তর: এর খরচ ৫-৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে হওয়ার কথা। এই অর্থ ব্যয়ে আমরা আরবানাইজেশন, ক্লাইমেট চেঞ্জ ও ডিফরেস্টের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে।
প্রশ্ন. অনেকের প্রশ্ন, স্যাটেলাইটের অরবিট ‘কাজাকিস্তানের’ ওপর থাকার পরও গত এক বছরে কেন বাংলাদেশের উপর আনতে না পারার কারণ কি?
উত্তর : অরবিট ‘কাজাকিস্তানের’ উপর এটা ভুল তথ্য। বিএস–১ কৃত্রিম উপগ্রহটি ১১৯.১° পূর্ব দ্রাঘিমার ভূস্থির স্লটে রয়েছে। যেটা ইন্দোনেশিয়ার পাশে অবস্থিত।
প্রশ্ন: স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে দেশে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্যালাইট কী ভাবছে?
উত্তর: স্যাটেলাইট ইজ এ গুড ওয়ে ফর কানেক্টিটিং পিপ্যুল। সেসব জায়গায় আপনি ফাইবার টানতে পারবেন না, কিংবা ওয়্যারল্যাস কানেক্টিভিটি পৌঁছেনি। সেসব জায়গাতেও এড্যুকেশন, হেলথকেয়ার ও ফাইন্যান্সিয়াল ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসিম। আমরা এ বিষয়ে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করছি। ইতিমধ্যেই একটি বেসরকারি কোম্পানিকে আমাদের রিটেইল এজেন্ট নিয়োগ করেছি।
প্রশ্ন: লো-অরবিটে বাংলাদেশ থেকে কোনো স্যাটেলাইট পাঠানোর পরিকল্পনা আছে কি না? এটা করতে হলে আমাদের কেমন খরচ পড়তে পারে?
উত্তর: পরিকল্পনা আছে কিন্তু অর্থায়নটা বড় বিষয়। আমাদের ইনিসিয়াল অ্যানালাইসিসে ১০-১২টি স্যাটেলাইট হলেই আমাদের পুরো দেশকে স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের অধীনে আনা সম্ভব। এজন্য ১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সম্ভব হতে পারে। পাবলিক-প্রাইভেট ইনভেস্টর সিস্টেমে এটা করা সম্ভব বলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি। তবে এটা সরকারের নীতি নির্ধারণী বিষয়।