২৯ জুনিয়র পরামর্শক
বিটিআরসি’র ‘অগ্রহণযোগ্য’ নিয়োগে জবাবদিহিতার নির্দেশ
বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ২৯ কর্মচারীর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) যে জবাব দিয়েছে তা ‘গ্রহণযোগ্য’ নয় বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় থেকে বিটিআরসি-কে দেয়া এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, নিয়োগ বিধি উপেক্ষা করে ২৯ জুনিয়র পরামর্শক-কে রাজস্ব খাতের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেয়া গ্রহণযোগ্য নয়। ২০১৬-২০১৭ থেকে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে গুরতর আর্থিক অনিয়ম (এসআইএফ) অনুচ্ছেদ-১ এর অধীনে এই মত দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
চিঠিতে ‘নির্দিষ্ট কাজের এবং নির্দিষ্ট সময়ের’ জন্য পরামর্শকদের ‘চুক্তি ভিত্তিক’ নিয়োগ করা হয় যুক্তি দিয়ে বিষয়টি স্পষ্টিকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা গ্রহণের কথা বলা হলেও লিখিত পরীক্ষা না নিয়েই শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে বিভাগীয় প্রার্থী দেখানোর বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছে মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি অভিযুক্ত ২৯ জন কর্মচারী বিটিআরসি’র মঞ্জুরিকৃত এবং অর্গানোগ্রামভূক্ত কোনো রাজস্ব খাতে নিযুক্ত ছিলো না বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে তাদের বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবেও গণ্য করার সুযোগ নেই বলে মতামত দিয়ে মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে বিধি না মেনে নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত সহ জবাব দিতে বিটিআরসি-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ১৬ অক্টোবর ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সহকারী সচিব লায়লা করিম স্বাক্ষরিত চিঠিতে জবাব নাকচের এসব কারণ উল্লেখ করেছে মন্ত্রণালয়। চিঠিটি গত ২১ অক্টোবর বিটিআরসি গ্রহণ করেছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয় সূত্রটি।
নাম প্রকাশ না করে সূত্রটি বলছে, বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক তদন্ত ও অভিযোগের বিষয়ে উপযুক্ত দালিল ও প্রমাণের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের এই চিঠি দেয়া হয়েছে। কিভাবে অর্থমন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসনকে পাশকাটিয়ে রাজস্ব খাতে নিয়োগ দেয়া হলো সে বিষয়ে বিটিআরসি’র কাছে জবাব চাওয়া হয়েছে। তবে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটিই যে বিধি বহির্ভূত তা প্রমাণিত হয়েছে।
বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের ২৯ জনের তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে কমিশনে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন উপপরিচালক খালিদ ফয়সাল রহমান, নাহিদুল হাসান, শারমিন সুলতানা, তাসমিয়া তাহমিদ, মিরাজুল ইসলাম, তৌহিদ হোসেন, এসএম তাইফুর রাহমান, রোখসানা মেহজাবীন, রাইসুল ইসলাম, মো. আসাদুজ্জামান, তৌহিদুর নাহার, নাফিসা মল্লিক, মাহরীন আহসান, সামিরা তাবাসসুম, এসএম গোলাম সারোয়ার, মেহফুজ বিন খালেদ, শামসুজ্জোহা । সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পাওয়া অন্যান্যরা বিভিন্ন সময়ে চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। এছাড়াও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত কাউছার আহমেদ, শামছুল আলম, উপ-সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত রেজাউল করিম, দেওয়ান মো. ফারুক আহমেদ এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলামকেও বয়স প্রমার্জন ও নিয়োগ বিধি উপেক্ষা করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, গত ২০ জুলাই ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে মহাপরিচালক আশীষ কুমার কুণ্ডু, পরিচালক এম এ তালেব হোসেন, পরিচালক আফতাব মো. রাশেদুল ওয়াদুদ, পরিচালক মো. এয়াকুব আলী ভূঁইয়া, উপপরিচালক মো. আসাদুজ্জামান এবং উপপরিচালক বেগম শারমিন সুলতানাকে ওএসডি করা এবং নিয়মবর্হিভূতভাবে নিয়োগ পাওয়া অন্যদের বিষয়ে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশনার আলোকে আগস্ট মাসে কমিশনের ২৯৮তম সভায় ছয় কমকর্তাকে ওএসডি ও অন্যান্যদের বিষয়ে ব্যাখা চাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইতোমধ্যে ছয় কমকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) এবং ১৫ সেপ্টেম্বর বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়া ৪২ জনকে তাদের নিয়োগের বিষয়ে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখা প্রদানের নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেয় কমিশন। সেই নির্দেশনা মেনে চাকরিরত অভিযুক্ত সকলে তাদের স্ব স্ব ব্যাখা কমিশনে জমা প্রদান করেন।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ-পদোন্নতিতে ব্যাপক অনিয়ম ও কারসাজির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। গাড়িচালক, ক্লিনার, এমএলএসএস থেকে শুরু করে পরিচালক, এমনকি কমিশনার ও পরামর্শক পদে নিয়োগেও আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে, যা বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদনে প্রমাণ মিলেছে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ১০ আগস্ট অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
ওই নির্দেশনার সঙ্গে বিধিবহির্ভূতভাবে রাজস্ব খাতে নিয়োগপ্রাপ্ত ২৯ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট এবং চাকরির বয়স না থাকলেও নিয়োগপ্রাপ্তদের তথ্যও দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। অনেকে চাকরির বয়স না থাকায় অযোগ্য ছিলেন। এসব কর্মকর্তাকে বিধিবহির্ভূতভাবে প্রকল্পের মাধ্যমে রাজস্ব খাতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে পদোন্নতিতেও অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল।
জানাগেছে, ২০২০ সালের নিরীক্ষায় কমিশনারসহ শতাধিক জনকে নিয়োগ ও অন্তত এক ডজন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও বিধি ভঙ্গ করে। ২৭ জন সহকারী পরিচালক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও উপ-সহকারী পরিচালকসহ ২৯ জন ২০০৯ সালের কোনো প্রকার পরীক্ষায় ছাড়াই নিয়োগ পান। একজনও বিভাগীয় প্রার্থী না হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে দেখিয়ে অনিয়ম করে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিভাগীয় প্রার্থী দেখিয়ে একজন উপপরিচালক, তিনজন জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক, পাঁচজন সহকারী পরিচালক, একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ১১ জন উপসহকারী পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে তদন্ত কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়। সে প্রতিবেদনে অনিয়মের সত্যতা খুঁজে পায়। ২০২৩ সালে আবারও মন্ত্রণালয় কর্তৃক তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও সেই প্রতিবেদনে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে গত বছর গঠিত তদন্ত কমিটি চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রতিবেদন জমা দিলেও এসব বিষয়ে এখনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়নি বিটিআরসি।
এ বিষয়ে জানতে এবং সর্বশেষ মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া চিঠির বিষয়ে বিটিআরসি’র বক্তব্য জানতে কয়েক দফা সংস্থাটির প্রশাসন শাখার মহাপরিচালক মোঃ মেহেদী-উল-সহিদ এর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাকে এসএমএস ও কল করেও তিনি তাতে সাড়া দেননি। ফলে এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত এ বিষয়ে বিটিআরসি’র কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।







