সরকারের ব‍্যবসা 

নানা চক্রে  টেকনোলজিই বাতিলের পর্যায়ে চলে যায়

নানা চক্রে  টেকনোলজিই বাতিলের পর্যায়ে চলে যায়
২৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১০:০৫  
২৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১০:০৬  

বাংলাদেশে সরকারী মালিকানাধীন ব‍্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। বিশেষ করে যে সব খাত বেসরকারীকরণ করা হয়েছে সেইসব খাতের সরকারী প্রতিষ্ঠান বেশী ভোগান্তিতে রয়েছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও সরকারী মালিকানাধীন অনেক প্রতিষ্ঠান দশকের পর দশক লোকসান করছে। দক্ষতা বৃদ্ধির জন‍্য অনেক প্রতিষ্ঠানকে কোম্পানি আইনের আওতায়‍্য শতভাগ সরকারী মালিকানাধীন কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছে। কিন্তু কোম্পানি করার মাধ্যমেও তেমন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। শুধুমাত্র কিছু সরকারী মালিকানাধীন একক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিযোগিতা না থাকায় সেই সব খাতে বাজারে দক্ষতার অভাব রয়েছে।

কেন সরকারী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিগুলো ধারাবাহিকভাবে লোকসান করছে? সরকারী প্রতিষ্ঠানকে কেন লাভজনক করা যাচ্ছে না? সবকিছুর মূলে সরকারের মানসিকতা ও দুর্নীতি বড় সমস‍্যা। এ ছাড়াও অনেক ধরনের পরিচালনা সংক্রান্ত চ‍্যালেঞ্জ রয়েছে। 

বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প সরকার পরিচালনা করে এবং বেশ কয়েকটি পণ্য বা সেবায় সরকার ভর্তুকি দিয়ে জনগনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে ফলে সেইসব প্রতিষ্ঠান কখনোই লাভের মুখ দেখবে না। সেইসব প্রতিষ্ঠান যে পরিমান ভর্তুকি দেয় তা শুধু হিসাবে রাখা হয়। ভর্তুকির কারণে সেইসব প্রতিষ্ঠানের সঠিক পারফরমেন্সও বোঝা যায় না। 

কয়েকটি খাতে দেশী বিদেশী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান যে পরিমান বিনিয়োগ করেছে সেই তুলনায় সরকারী প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ খুবই অপ্রতুল। আবার সরকারী প্রতিষ্ঠান নানামুখী আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রকল্প গ্রহন করেও সময়মত বিনিয়োগ করতে পারে না। প্রকল্পে বিনিয়োগ পেলেও তা সরকারের পিপিআর অনুসরন করে ক্রয় প্রক্রিয়ায় যেয়ে এক জটিল দীর্ঘসূত্রিতায় পরে যায় বিভিন্ন টেন্ডার কমিটি, কেবিনেট পারচেজ কমিটি, টেন্ডার , রি-টেন্ডারের চক্রে পরে সেই টেকনোলজিই বাতিলের পর্যায়ে চলে যায়। আবার ক্রয়ের ক্ষেত্রে পিপিআর ঠিকমত অনুসরন না করলে অডিট আপত্তি বা দুদকের চক্করে পরে যেতে পারে।

অন‍্যদিকে বেসরকারি খাত খুব দক্ষতার সাথে স্বল্প সময়ে আধুনিক টেকনোলজিতে বিনিয়োগ করে নতুন নতুন পণ‍্য বা সেবা বাজারে নিয়ে এসে দ্রুতই বাজার দখল করে ফেলে। 

বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারী কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান হয় পদাধিকার বলে সেই মন্ত্রণালয়র সচিব। কিছু কিছু কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরস এ থাকে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সামরিক সংস্থার কর্মকর্তা এবং ব‍্যবসায়িক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ব‍্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দেয়া হয় সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই জৈস্ঠতার ভিত্তিতে অথবা মন্ত্রনালয় থেকে যুগ্ম বা অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কোন কর্মকর্তাকে। অনেক সময় দেখা যায়, খাত সংশ্লিষ্ট দীর্ঘ ব‍্যবসা পরিচালনার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কেউই সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করে না। কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা সরকারী চাকুরির সুযোগ সুবিধা পায়, মাস শেষে বেতন পায়। এইসব প্রতিষ্ঠানে যোগ‍্যতা বা পারফরম্যান্স ভিত্তিক নিয়োগ, প্রোমোশন বা ছাঁটাইয়ের ব্যবস্থা নাই ।

সচিবালয় তথা মন্ত্রী বা সচিবদের নানাবিধ হস্তক্ষেপের কারণে এইসব প্রতিষ্ঠান দক্ষভাবে চালাতে চাইলেও অনেক সময় সংস্থা প্রধানের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। সংস্থা প্রধান প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করার চেয়ে উর্ধ্বতনদের ফুট ফরমায়েশ খাটতেই বেশী ব‍্যস্ত। অনেক সময় সরকার এমন সব প্রকল্প গ্রহনের প্রস্তাব করে যা কখনই কোম্পানির জন‍্য লাভজনক হয় না বরং সেইসব প্রকল্প থেকে তৃতীয় পক্ষের লাভ হয়। 

পৃথিবীর অনেক দেশেই এক সময় বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠানই সরকারী মালিকানাধীন ছিল। আশির দশক বা তারও আগে উন্নত দেশগুলো বেশীরভাগ খাতই বেসরকারীকরণ করে ফেলেছে।  উন্নয়নশীল দেশগুলোও বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে কিছু কিছু খাতে  সরকারী সংস্থাগুলোকে প্রথমে সরকারী মালিকানাধীন কোম্পানিতে রূপান্তরিত করেছে। তারপর কিছু শেয়ার ছেড়ে দেশী-বিদেশী প্রাইভেট বিনিয়োগ নিয়েছে বা ম্যানেজমেন্ট পার্টনার নিয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দেশের শেয়ার মার্কেটে শেয়ার ছেড়ে পুঁজি সংগ্রহ করেছে। পরবর্তীতে অনেক ক্ষেত্রে বিদেশী কোম্পানি শেয়ার অফলোড করে চলে গেছে। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও শতভাগ মালিকানায় অনেক সরকারী কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল কিন্তু অন‍্যান‍্য উন্নয়নশীল দেশের মডেলে তার পরবর্তী কোন ধাপ অনুসরন করা হয়নি। 

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, শ্রীলংকান এয়ার ১৯৯৮ সালে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের কাছে আংশিক শেয়ার দিয়ে ম‍্যানেজমেন্ট পার্টনার করেছিল,  কিন্ত ২০০৮ সালে শ্রীলংকা সরকার আবার পুরো শেয়ার কিনে নেয়।  ১৯৯৭ সালে শ্রীলংকা টেলিকমকে সরকার বেসরকারীখাতে ছেড়ে দেয়। তখন সরকার ৪৯.৫% শেয়ার রেখে বাকীটা জাপানের এনটিটি, শেয়ার বাজার এবং কর্মীদের মাঝে ছেড়ে দেয। জাপানের এনটিটি প্রায় ৩৫% শেয়ার কিনে নেয় এবং ব‍্যবস্থাপনায় যুক্ত হয়। ২০০৮ সালে এনটিটি সেই শেয়ার ১০মিলিয়ন ডলার ক‍্যাপিটাল গেইন নিয়ে  মালয়েশিয়ার ম‍্যাক্সিস টেলিকম গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়। 

সোনারগাঁ প‍্যানপ‍্যাসিফিক হোটেল এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের অবকাঠামোর মালিকানা বাংলাদেশ সরকারের। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হোটেলস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এবং বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড নামের দুটি সরকারি কোম্পানি যথাক্রমে সোনারগাঁ প‍্যানপ‍্যাসিফিক এবং ইন্টারকন্টিনেন্টালের হোটেলের অবকাঠামোর মালিকানায় রয়েছে। রাজস্ব ভাগাভাগির শর্তে হোটেল ম‍্যানেজমেন্ট চুক্তির মাধ‍্যমে প‍্যানপ‍্যাসিফিক গ্রুপ এবং ইন্টারন্যাশনাল হোটেলস গ্রুপ (ইন্টারকন্টিনেনটাল) হোটেল দুটি পরিচালনা করছে। সুতরাং বাংলাদেশেও সরকার ইতোমধ্যেই এ ধরনের ম‍্যানেজমেন্ট চুক্তির মাধ‍্যমে স্থাপনা পরিচালনার উদাহরণ রয়েছে। 

সরকারী পাট ও বস্ত্র কলগুলো বছরের পর বছর লোকসান করতো। বার বার হাজার হাজার কোটি টাকা বিএমআরই প্রজেক্ট করেও কোন সুফল আসেনি। অবশেষে অতি সম্প্রতি এইসব কল কারখানা বেসরকারী খাতে লিজ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারী কাগজ উৎপাদন কারখানারও একই অবস্থা।

সরকার যেখানে রাজস্ব আদায় করে সরকারী ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ভর্তুকি দিয়ে বছরের পর বছর ব্যবসা সম্প্রসারণের চেস্টা করা বা ব‍্যবসাতে না থাকাই ভালো।গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো খাত বাদ দিয়ে বাজারে দক্ষতা আনতে হলে অন‍্যান‍্য খাতগুলো বিভিন্ন ফরমেটে (বিনিয়োগ বা ব‍্যবস্থাপনা) বেসরকারিকরন করতে হবে। 

তবে পুরোপুরি বেসরকারিকরণের পূর্ব শর্ত হলো সরকারকে  খাত সংশ্লিষ্ট দক্ষ, শক্তিশালী ও স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়াও সরকারের জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও শক্তিশালী করে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে ব‍্যাপকভাবে কাজে লাগাতে হবে। 


লেখকঃ সিইও, ইন্টারক্লাউড লিমিটেড


দ্রষ্টব্য: অভিমত-এ প্রকাশিত পুরো মতামত লেখকের নিজের। এর সঙ্গে ডিজিটাল বাংলা মিডিয়া কর্তৃপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বহুমতের প্রতিফলন গণমাধ্যমের অন্যতম সূচক হিসেবে নীতিগত কোনো সম্পাদনা ছাড়াই এই লেখা প্রকাশ করা হয়। এতে কেউ সংক্ষুব্ধ বা উত্তেজিত হলে তা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।