মোবাইল ফোনের আসক্তির সামাজিক সম্পর্ক ও মনোযোগের ওপর প্রভাব

বর্তমান যুগে মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এটি যোগাযোগ, তথ্য সংগ্রহ এবং বিনোদনের এক দারুণ মাধ্যম। তবে এর অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে সামাজিক সম্পর্ক, দাম্পত্য জীবন এবং মনোযোগের ওপর। বিভিন্ন গবেষণায় এই আসক্তির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের Pew Research Center-এর একটি জরিপে দেখা গেছে, ৫৩% প্রাপ্তবয়স্ক মনে করেন যে, স্মার্টফোন তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে, যখন দুজন মানুষ একসঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন, তখন মোবাইল ফোনের ব্যবহার তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি ডিনারেও যদি একজন ব্যক্তি মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকেন, তবে অন্যজনের মনে একাকীত্ব ও উপেক্ষিত হওয়ার অনুভূতি তৈরি হয়। দিন শেষে বাসায় এসে পার্টনারকে সময় না দিয়ে আপনি যখন মোবাইলে ডুব থাকবেন তখন দাম্পত্য সম্পর্কে সমস্যা দেখা দিবেই। মোবাইল ফোন আসক্তিকে এক ধরনের 'phubbing' (phone+ snubbing) বলা হয়। এর অর্থ হলো, যখন একজন ব্যক্তি সামনে থাকা অন্য ব্যক্তিকে উপেক্ষা করে মোবাইল ফোনে মনোযোগ দেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দম্পতি phubbing-এর শিকার হন, তাদের মধ্যে পারস্পরিক সন্তুষ্টি এবং সম্পর্কের গভীরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। Journal of Social and Personal Relationships-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৬.৩% দম্পতি মনে করেন যে, তাদের সঙ্গীর মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। তারা দিন শেষে বাসায় ফিরে নিজের সঙ্গীর সাথে আলাপ আলোচনা করার চাইতে ডুবে থাকতে বেশি আরাম বোধ করছেন। এ কারণে সঙ্গীও তার প্রতি নেতিবাচক হয়ে উঠছেন। ফলশ্রুতিতে তাদের সম্পর্কটি এর স্বাভাবিক ছন্দ হারাচ্ছে।
মনোযোগের ওপর প্রভাব
মোবাইল ফোনের আসক্তি শুধু সম্পর্কের ওপর নয়, আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা এবং মনোযোগের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল মোবাইল ফোনের উপস্থিতিই আমাদের মনোযোগের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এমনকি যদি ফোনটি বন্ধও থাকে বা অন্য ঘরে থাকে, তবুও আমাদের মস্তিষ্ক অবচেতনভাবে ফোনের উপস্থিতি অনুভব করে এবং তার দিকে মনোযোগ দেয়। এর ফলে কোনো একটি কাজে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে মনোযোগের সময় কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। একটি সাধারণ কাজেও বারবার মোবাইল চেক করার অভ্যাস আমাদের মস্তিষ্কের ডোপামিন সিস্টেমকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, এটি দ্রুত নতুন কিছু খোঁজার জন্য উৎসাহিত হয়। ফলে, দীর্ঘক্ষণ এক কাজে মনোযোগ ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সমাধানের উপায়
মোবাইল ফোন আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। ডিজিটাল ডেটক্স অনুসরণ করুন। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় মোবাইল ফোন থেকে দূরে থাকুন। যেমন- রাতে ঘুমানোর এক ঘণ্টা আগে ফোন ব্যবহার বন্ধ করা। নো ফোন জোন আরেকটি ভালো উপায়। ডাইনিং টেবিল, বেডরুমের মতো জায়গায় মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। এটি পারিবারিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করতে সাহায্য করবে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং অ্যাপগুলোর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন। প্রয়োজনের বাইরে অতিরিক্ত স্ক্রল করা থেকে বিরত থাকুন। মোবাইলের বদলে বই পড়া, গান শোনা, বা বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার মতো কার্যকলাপে নিজেকে যুক্ত করুন। নিজে এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করুন। নিয়মিত এ বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
মোবাইল ফোন আসক্তি একটি আধুনিক সমস্যা যা আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষুণ্ণ করছে। এর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন হয়ে এবং সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে আমরা এই আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি এবং আরও সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারি।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান অডিওলজি এন্ড স্পিচ ল্যাংগুয়েজ প্যাথলজি বিভাগ, প্রয়াস ইনস্টিটিউট অফ স্পেশাল এডুকেশন, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস