দেশের ই-কমার্স খাতের সংকট ও উত্তরণের পথ
মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন শিপন
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত এক দশকেরও কম সময়ে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে। কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে অনলাইন শপিং এবং ডিজিটাল লেনদেনের প্রবণতা বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর কার্যকর নেতৃত্বের অভাব এই খাতের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একটি কার্যকর নেতৃত্ব ছাড়া এই সেক্টরের সুষ্ঠু বিকাশ অসম্ভব।
বর্তমানে বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারের আকার ৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। প্রতিবছর প্রায় ২৫% হারে এই খাতের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় দ্রুতগতিসম্পন্ন। তবে, সঠিক নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণ হলে এই বৃদ্ধির গতি আরও বেশি হতে পারত।
দারাজ, বিকাশ, চালডাল, শেয়ারট্রিপ বা স্টিডফার্স্টের মতো উদ্যোগ বাজারে আধিপত্য বজায় রাখলেও, অসংখ্য কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। ই-ক্যাবের কার্যকর কমিটি না থাকায় এই উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় গাইডলাইন, ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট এবং নীতিগত সহায়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বর্তমানে ই-ক্যাবের কোনো নির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটি নেই, যার ফলে পুরো ই-কমার্স শিল্প নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় পড়েছে। এই নেতৃত্বহীনতার কারণে শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছে, যা দিন দিন আরও প্রকট আকার ধারণ করছে।
প্রথমত, নীতিগত অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, যা শিল্পের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পেমেন্ট গেটওয়ে এবং ব্যাংকগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, বিশেষ করে মার্চেন্ট রেট (এমআরআর) নিয়ে চলমান বিরোধ শিল্পের স্বাভাবিক গতিপথকে ব্যাহত করছে। এই সমস্যা সমাধানে একটি শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, গ্রাহকদের আস্থা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। গত দুই বছরে অনলাইন প্রতারণার অভিযোগ ১৫% বেড়েছে। কেন্দ্রীয় অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা না থাকায় ক্রেতারা ধীরে ধীরে অনলাইন শপিংয়ে আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ই-কমার্স শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হবে।
তৃতীয়ত, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়ছে। বিভিন্ন উৎস অনুযায়ী, গত দুই বছরে অনেক ই-কমার্স স্টার্টআপ কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। ই-ক্যাবের মেন্টরশিপ ও ট্রেইনিং সুবিধা না থাকায় নতুন উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই অবস্থা সেক্টরের diversity ও innovation ক্ষমতা দুর্বল করে দিচ্ছে।
বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে আমাদেরকে কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত, এসব সমস্যা সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে ই-ক্যাবের একটি কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক নেতৃত্ব গঠন করা প্রয়োজন। শিল্পের সকল স্তরের স্টেকহোল্ডারদের অংশগ্রহণে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্বই কেবল এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে এবং ই-কমার্স শিল্পকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে। একটি সুষ্ঠু ও সমন্বিত নেতৃত্ব ছাড়া এই শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, নীতিমালা সংস্কার করা এখন সময়ের দাবি। ডিজিটাল কমার্স অথরিটি একট প্রণয়ন করে শিল্পকে একটি কাঠামোবদ্ধ নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি মার্চেন্ট রেট ক্যাপ (১.৫%) চালু করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এসব পদক্ষেপ না নিলে শিল্পের টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।
তৃতীয়ত, গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ই-ক্যাব ভেরিফাইড মার্চেন্ট সিস্টেম চালু করতে হবে যাতে নির্ভরযোগ্য অনলাইন প্রতিস্ঠান চিহ্নিত করা যায়। এছাড়াও সেন্ট্রাল কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কার্যকর করে অনলাইন প্রতারণা রোধ করতে হবে। গ্রাহক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে ই-কমার্স শিল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে।
চতুর্থত, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর জন্য ই-কমার্স বান্ধব ঋণ স্কিম চালু করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে সমন্বয় করতে হবে। একইসাথে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) এবং ডিজিটাল ওয়ালেটের সাথে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর সংযোগ বাড়াতে হবে। এতে করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং শিল্পের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।
এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের ই-কমার্স শিল্প নতুন করে গতি সঞ্চার করতে সক্ষম হবে। সরকার, বেসরকারি খাত এবং সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই কেবল এই শিল্পকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে। সময় নষ্ট না করে এখনই এসব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
এখনই সময় সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার। যদি আমরা দেরি করি, তাহলে বাংলাদেশের ই-কমার্স শিল্প কেবল সম্ভাবনার গল্প হয়েই থেকে যাবে। সরকারের নীতি-সহযোগিতা, বেসরকারি খাতের উদ্ভাবন এবং সংগঠনগুলোর কার্যকর নেতৃত্ব এই ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা আমাদেরকে টেকসই ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে এগিয়ে নিতে পারে।
লেখক: সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, ই-ক্যাব







