ধর্ষণ রোধে নীরবতা ভাঙতে হবে: 

প্রযুক্তি, আইন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছাই শেষ ভরসা


তানভীর হাসান জোহা
১৩ আগষ্ট, ২০২৫ ০৭:০০  
৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১৯:১৮  
প্রযুক্তি, আইন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছাই শেষ ভরসা

বাংলাদেশে ধর্ষণ কোনো অপ্রতিরোধ্য জৈবিক প্রবৃত্তির ফল নয়; এটি ক্ষমতার অপব্যবহার, দণ্ডহীনতা এবং এমন এক সংস্কৃতির ফল যা ভুক্তভোগীর বদলে অপরাধীকে রক্ষা করে। যদি যৌন সহিংসতা কেবল “প্রাকৃতিক নিয়তি” হতো, তবে প্রতিটি পুরুষই ধর্ষক হতো! বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে — আর বলে, এটি প্রতিরোধযোগ্য অপরাধ।

তবু পরিসংখ্যান ভয়াবহ: বাংলাদেশে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির প্রায় ৯০% ঘটনা রিপোর্টই হয় না। এই নীরবতাই অপরাধীদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তারা জানে, ভুক্তভোগী চুপ থাকবে, পরিবার পুলিশে যাবে না, আর বিচারব্যবস্থা ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ হবে।

প্রযুক্তি দিয়ে নিরাপত্তা ও সহায়তা
আইন ও প্রতিষ্ঠানিক সংস্কারের পাশাপাশি বাংলাদেশকে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভুক্তভোগীদের তাৎক্ষণিক সহায়তা দিতে হবে। নিরাপদ মোবাইল অ্যাপ, যাতে SOS অ্যালার্ট, জিও-ফেন্সিং, সরাসরি পুলিশের সাথে যোগাযোগের সুযোগ থাকবে, জরুরি পরিস্থিতিতে জীবন রক্ষা করতে পারে। এআই-নির্ভর সিসিটিভি বিশ্লেষণ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নজরদারি করতে পারবে, আর ব্লকচেইন প্রযুক্তি প্রমাণকে নিরাপদ ও পরিবর্তন-অযোগ্য রাখবে। অনলাইন গোপন রিপোর্টিং প্ল্যাটফর্ম, যেখানে প্রশিক্ষিত পরামর্শদাতা ও উদ্ধারকর্মী যুক্ত থাকবে, ভুক্তভোগীকে সামাজিক কলঙ্কের ভয় ছাড়াই অভিযোগ জানাতে উৎসাহিত করতে পারে।

ভুক্তভোগীরা কেন চুপ থাকেন
রিপোর্ট না করার কারণ সমাজের মনোভাব ও প্রতিষ্ঠানিক দুর্বলতায় গভীরভাবে গেঁথে আছে। ভুক্তভোগীকে প্রায়ই দোষারোপ করা হয়, “অনৈতিক” তকমা দেওয়া হয় এবং প্রকাশ্যে লজ্জা দেওয়া হয়। বিচার ধীরগতি, দোষী সাব্যস্তের হার কম, আর “ভাল নারী ধর্ষণের শিকার হয় না” বা “পোশাকের কারণে ঘটনা ঘটেছে” — এসব ভুল ধারণা সমাজে টিকে আছে।

নৈতিক পাহারাদারি (moral policing) এটিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। যখন কোনো মেয়ে সিনেমা দেখতে যায়, বন্ধুদের সাথে ঘুরে বা নিজের মতো পোশাক পরে — তখন তাকে দোষী বানানো হয়, অপরাধীকে নয়। এই লজ্জা ও ভয় অপরাধীর ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।

সংকটের মাত্রা
বাংলাদেশে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডসহ কঠোর শাস্তির আইন আছে। কিন্তু রিপোর্ট, তদন্ত আর দোষী সাব্যস্ত না হলে আইন কেবল কাগজে থাকে। অবকাঠামোগত ঘাটতিও গুরুতর: ১৮ কোটির বেশি মানুষের জন্য বিচারব্যবস্থায় বিচারক আছেন ১,৮০০ জনেরও কম, আর পুরো দেশে কার্যকর ডিএনএ ল্যাব মাত্র দুইটি।

যা এখনই বদলাতে হবে
ধর্ষণ বন্ধ হবে না ক্ষণিকের প্রতিবাদ বা প্রতীকী শাস্তিতে; লাগবে রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন সমন্বিত পদক্ষেপ:

  • আইন, শিক্ষা, গণমাধ্যম ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থায় সংস্কারের জন্য ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিশন গঠন।
  • ২,০০০ নতুন বিচারক নিয়োগ ও বিশেষায়িত ধর্ষণ মামলা আদালত স্থাপন।
  • নারী-সংবেদনশীল বিশেষ পুলিশ ইউনিট, যারা ফরেনসিক, পরামর্শদান ও অপরাধীর জাতীয় ডাটাবেস পরিচালনায় প্রশিক্ষিত।
  • আইনি সংজ্ঞা সংশোধন করে বস্তু প্রবেশ (object penetration) কে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা, প্রতারণার মাধ্যমে ধর্ষণ স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা এবং শিশুদের অনলাইন প্রলোভনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা।
  • প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ডিএনএ ল্যাব স্থাপন ও পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ।

বাজেটের প্রশ্ন
বাংলাদেশের পুরো বিচারব্যবস্থার বার্ষিক বাজেট একটি শহুরে ফ্লাইওভারের খরচের চেয়েও কম। দেশ যদি মহাসড়ক ও সেতু বানাতে পারে, তবে নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদার জন্য অর্থ বরাদ্দ করাও সম্ভব। এটি অর্থের নয় — রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়।

কর্মে নামার সময়
সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বা জনসমক্ষে প্রদর্শনীমূলক পদক্ষেপ নয় — লাগবে কাঠামোগত সংস্কার, যা ভুক্তভোগীকে রক্ষা করবে, অপরাধীকে ভয় দেখাবে এবং নীরবতার সংস্কৃতি ভাঙবে। সামনে দুটি পথ — কংক্রিট ও ইস্পাত বাড়ানো, নাকি এমন এক সমাজ গড়া যেখানে নারী-শিশুরা ভয়মুক্ত জীবনযাপন করতে পারবে।

অকর্মণ্যতার খেসারত টাকা দিয়ে নয়, বরং ধ্বংস হয়ে যাওয়া অসংখ্য জীবনের হিসাবেই চুকাতে হবে।

দ্রষ্টব্য: অভিমত-এ প্রকাশিত পুরো মতামত লেখকের নিজের। এর সঙ্গে ডিজিটাল বাংলা মিডিয়া কর্তৃপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বহুমতের প্রতিফলন গণমাধ্যমের অন্যতম সূচক হিসেবে নীতিগত কোনো সম্পাদনা ছাড়াই এই লেখা প্রকাশ করা হয়। এতে কেউ সংক্ষুব্ধ বা উত্তেজিত হলে তা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।