বিটিআরিসি’র স্বায়ত্ত শাসনে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্বানুমতির পক্ষে মন্ত্রণালয়

ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানে পদচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ২০১০ সালের ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) আইন’ বাতিল চেয়ে ফের স্বায়ত্ত শাসন চায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। বাতিলের পক্ষে বিটিআরসি’র যুক্তি- লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ, লাইসেন্সের নাম পরিবর্তন এবং ট্যারিফ অনুমোদনসহ বিভিন্ন অপারেশনাল কার্যক্রমে স্থবিরতা ও নিয়ন্ত্রণের সঠিক কাঠামোর বাইরে নেতিবাচক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া; দেশের টেলিকম খাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং আইনকে পরিশীলনের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ সেবাকে আধুনিক, অর্থবহ, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ ডিজিটাল সেবার সহায়ক ভূমিকা পালনের উপযোগী করে তুলতেই বিটিআরসি-কে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে।
বিটিআরসি’র মতো খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও মনে করেন, বিগত সরকারের সময়ে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে বিটিআরসির নির্ধারিত নম্বরের চেয়ে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে বাড়তি নম্বর দিয়ে রাজনৈতিক কারণে অনেক লাইসেন্স দিতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনকালের শুরুর দিকে তৎকালীন সরকারঘনিষ্ঠরা আইআইজি লাইসেন্স নিয়ে আইএফও বানিয়ে একটি সিন্ডিকেট করে মুনাফা করেও রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। পাওনা বকেয়া রেখেই পরে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। একইভাবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবের অধীনে থাকা বিটিসিএল, টেলিটকসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আজ পর্যন্ত লাভের মুখ দেখেনি। বিটিআরসি বিটিসিএলের কাছে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং টেলিটকের কাছে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা পায়। কিন্তু সেই টাকা এই দুটি প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করছে না। কিন্তু বিদ্যমান আইনের ২১ ধারায় টেলিযোগাযোগ খাত থেকে আয় বিটিআরসির নিজস্ব তহবিলে জমা রাখার বিধান থাকলেও সেটি সংশোধন করে সরকারি কোষাগারে জমার বিধান রাখায় বিটিআরসি মূলত ঠুটো জগন্নাথ হয়েছে।
বিটিআরসি মনে করে, এ আইনের মাধ্যমে সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে বিটিআরসিকে টেলিযোগাযোগ খাতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ব্যাপক লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। আগামীতে যেনো আর এমনটা না হয় তাই ফিরিয়ে দেয়া হোক কেড়ে নেয়া স্বাধীনতা। তবে এই স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার আগে বিগত সময়ে সংস্থাটির সাবেক প্রধানদ্বয় থেকে শুরু করে বিভন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর উত্থাপিত অভিযোগ এবং এখনো সেখানে থাকা বিতর্কিতদের বিষয় বাধা হতে পারে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট একটি শীর্ষ সূত্র জানিয়েছে, সহসাই স্বাধীন কমিশন হওয়ার সুযোগ নেই। কিছুটা ছাড় পেলেও জবাবদিহিতার মধ্যে থাকতে হবে। স্বাধীন হওয়ার আগে মানবসম্পদ পরিশুদ্ধ হতে হবে।
এদিকে ফের স্বাধীনতা ফিরে পেতেই গত ১৬ এপ্রিল বিটিআরসির মহাপরিচালক অশীষ কুমার কুণ্ডের সই করা একটি চিঠি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব ড. মোঃ মুশফিকুর রহমান বরাবর পাঠানো হয়েছে। চিঠির সঙ্গে বিটিআরসির একটি কমিটির মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) অধ্যাদেশ’ নামের একটি খসড়া আইনও প্রস্তুত করা হয়েছে। ওই চিঠির অনুলিপি প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবকেও পাঠানো হয়েছে ।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১-এর অধীনে গঠিত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন স্বাধীন সত্তাবিশিষ্ট একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে শুরু থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছে। সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন ও তৎসংশ্লিষ্ট ক্ষমতা প্রয়োগের তথা টেলিযোগাযোগ খাতে সম্পদের সুষম বণ্টন এবং সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সুশৃঙ্খল ও ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন সুনিশ্চিত করার জন্য নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনভাবে কাজ করা অপরিহার্য, যা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত শতাধিক সদস্য রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করেছে। এর ধারাবাহিকতায় প্রারম্ভ থেকে ২০১০ সালে ওই আইনের সংশোধনীর আগ পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশন ভূমিকা পালন করে টেলিযোগাযোগ খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতিমালা, নির্দেশিকা, গাইডলাইন ইত্যাদি প্রণয়ন এবং তা প্রয়োগের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ আবশ্যক। কিন্তু আইনটি ২০১০ সালে সংশোধনের মাধ্যমে এ বিষয়ে সরকারের পূর্বানুমোদনসংক্রান্ত বিধান সন্নিবেশ করার ফলে দ্রুত পরিবর্তনশীল টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে, যা এই খাতে সুষ্ঠু বাজার নিয়ন্ত্রণের অন্তরায়। এ অবস্থায় নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদান ও গতিশীলতা আনার জন্য ২০১০ সালের সংশোধনী বাতিল করা প্রয়োজন।’
এই চিঠি বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেছেন, এ জন্য তিন ধরনের ‘টার্গেট’ (লক্ষ্য) দেওয়া হয়েছে।এগুলো হলো বিটিআরসির স্বাধীনতা ও জবাবদিহির মধ্যে ‘ট্রেড-অফ’ (ভারসাম্য) করা। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন যে ৬টি প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়কে যুক্ত করা এবং সেসব বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি চাওয়া। অর্থাৎ যে বিষয়গুলোতে লাইসেন্সিং, রেগুলেটরি পলিসিসহ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ আছে, সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতির দরকার আছে। আর ইন্টারনেট যেন কোনো সরকার বন্ধ করতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হবে।