মোবাইল কলের গুণগত মান বাড়ায় ভয়েস ওভার ওয়াইফাই

৮ ডিসেম্বার, ২০২৪  
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  
মোবাইল কলের গুণগত মান বাড়ায় ভয়েস ওভার ওয়াইফাই

মোবাইল টেলিকমিউনিকেশনে উচ্চ মানের ভয়েস পরিষেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শহর এলাকায় নেটওয়ার্ক কনজেশন, গ্রামীণ এলাকায় অপর্যাপ্ত কাভারেজ এবং ঘরের ভেতরে দুর্বল সিগনালের মতো চ্যালেঞ্জগুলো প্রায়ই কলের অভিজ্ঞতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই সমস্যার সমাধানে ভয়েস ওভার ওয়াইফাই (VoWiFi) একটি প্রতিশ্রুতিশীল প্রযুক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে, যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্কগুলো নানা অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, সেখানে এই প্রযুক্তি কার্যকর হতে পারে। বিশ্বব্যাপী ভয়েস ওভার ওয়াইফাই (VoWiFi) প্রযুক্তি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, এবং অনেক দেশ এটি মোবাইল কলের মান উন্নত করতে এবং নেটওয়ার্ক কাভারেজের সমস্যা সমাধানে ব্যবহার করছে। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে এই প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালে VoWiFi প্রযুক্তি চালু করেছিল, এবং বর্তমানে দেশটির প্রধান মোবাইল অপারেটররা এটি ব্যবহার করে আসছে। ভারতে Airtel, Jio, এবং Vodafone Idea-এর মতো শীর্ষস্থানীয় অপারেটররা VoWiFi সেবা চালু করেছে, যা বিশেষত ঘরের ভিতরে দুর্বল নেটওয়ার্ক সমস্যা সমাধানে সহায়ক। ইউরোপে, VoWiFi প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে, বিশেষত নেটওয়ার্ক কাভারেজ বৃদ্ধির জন্য। দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান-এর মতো দেশেও এটি ৫জি নেটওয়ার্কের সঙ্গে সমন্বিতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা ব্যবহারকারীদের সিমলেস কলের অভিজ্ঞতা প্রদান করছে।

ভয়েস ওভার ওয়াইফাই কী?

ভয়েস ওভার ওয়াইফাই (VoWiFi) হল এমন একটি প্রযুক্তি যা মোবাইল নেটওয়ার্কের অ্যাক্সেস নেটওয়ার্কের (অ্যাক্সেস নেটওয়ার্ক হল মোবাইল নেটওয়ার্কের সেই অংশ, যা ব্যবহারকারীর ডিভাইসকে নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত করে এবং তাদের কল, ইন্টারনেট ব্যবহার ও অন্যান্য সেবা নিতে সাহায্য করে)  পরিবর্তে WiFi নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভয়েস কল করার সুযোগ দেয়। এটি ভয়েস ওভার LTE (VoLTE)-এর একটি এক্সটেনশন এবং বিদ্যমান টেলিকম অবকাঠামোর সাথে নির্বিঘ্নে সংযুক্ত হয়। VoWiFi এর মাধ্যমে পরিষ্কার ভয়েস কোয়ালিটি, কম কল ড্রপ এবং দুর্বল সিগনালযুক্ত এলাকায় উন্নত সংযোগ সম্ভব হয়।

বাংলাদেশে VoWiFi-এর প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশে ঘন জনসংখ্যা এবং দ্রুত ডিজিটালাইজেশনের কারণে VoWiFi প্রযুক্তি গ্রহণের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা রয়েছে:

  1. নগর অঞ্চলের কনজেশন: ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে নেটওয়ার্ক কনজেশন সাধারণ সমস্যা। VoWiFi, ভয়েস ট্র্যাফিককে WiFi নেটওয়ার্কে সরিয়ে নেটওয়ার্কের উপর চাপ কমাতে পারে। এতে অতি মূল্যবান রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (RF) সাশ্রয় সম্ভব হবে। এর ফলে মোবাইল অপারেটররা তাদের গ্রাহকদের স্বল্প মূল্যে উন্নতমানের ভয়েস সেবা প্রদানে সক্ষম হবে।
  2. গ্রামীণ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক কাভারেজের ঘাটতি: মোবাইল নেটওয়ার্কের ব্যাপক বিস্তার সত্ত্বেও অনেক গ্রামীণ ও দূরবর্তী অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক  কাভারেজের অভাব রয়েছে। সাশ্রয়ী ব্রডব্যান্ড পরিষেবা চালিত WiFi নেটওয়ার্ক ভয়েস কলের বিকল্প চ্যানেল সরবরাহ করতে পারে। ফলে মোবাইল নেটওয়ার্ক  কাভারেজ না থাকলেও গ্রাহকগণ আইএসপি কর্তৃক সরবরাহকৃত ব্রডব্যান্ড চালিত WiFi নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তাদের মোবাইল ভয়েস কল করতে সক্ষম হবে।
  3. ঘরের ভেতরের দুর্বল নেটওয়ার্ক: উঁচু ভবন এবং ঘরের মধ্যে দুর্বল সিগনালের কারণে প্রায়ই ব্যবহারকারীরা সমস্যায় পড়েন। VoWiFi, বাড়ি বা অফিসের WiFi নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এই সমস্যা সমাধান করতে পারে।
  4. খরচ সাশ্রয়ী: VoWiFi কলগুলো মোবাইল অপারেটর ও ব্যবহারকারীদের জন্য সাশ্রয়ী।

কল কোয়ালিটির উপর প্রভাব

VoWiFi-এর অন্যতম বড় সুবিধা হল ভয়েস কলের মান উন্নত করা। মোবাইল অ্যাক্সেস নেটওয়ার্ককে বাইপাস করে, এটি নিশ্চিত করে:

  • এইচডি ভয়েস কোয়ালিটি: WiFi এর মাধ্যমে কল করলে ভয়েস কোয়ালিটি স্পষ্ট ও উচ্চমানের হয়।
  • কম কল ড্রপ: স্থিতিশীল WiFi নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার কারণে কল ড্রপের হার কমে যায়।
  • সিমলেস হ্যান্ডওভার: উন্নত VoWiFi সিস্টেমের মাধ্যমে WiFi এবং মোবাইল নেটওয়ার্কের মধ্যে কল ড্রপ ছাড়াই পরিবর্তন সম্ভব।

VoWiFi গ্রহণে চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান

VoWiFi-এর সুবিধা সত্ত্বেও, বাংলাদেশে এর গ্রহণযোগ্যতায় কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  1. WiFi নেটওয়ার্কের অভাব: শহুরে এলাকায় ব্রডব্যান্ড অ্যাক্সেস ব্যাপক হলেও গ্রামীণ এলাকায় WiFi নেটওয়ার্ক এখনো তেমন স্থিতিশীল নয়। গ্রামীণ ব্রডব্যান্ড পরিষেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।
  2. ডিভাইসের সামঞ্জস্যতা: অনেক পুরোনো স্মার্টফোন VoWiFi সাপোর্ট করে না। সাশ্রয়ী দামে VoWiFi-সাপোর্টেড ডিভাইস সরবরাহ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।
  3. অপারেটরদের প্রস্তুতি: টেলিকম অপারেটরদের VoWiFi সেবা চালু করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নত করতে হয়। সুখবর হলো বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটররা ইতোমধ্যে তাদের নেটওয়ার্কে ভয়েস ওভার ওয়াইফাই (VoWiFi) প্রযুক্তির সফল পরীক্ষামূলক কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে।
  4. ব্যবহারকারীদের সচেতনতা: VoWiFi এবং এর সুবিধাগুলো সম্পর্কে অনেক ব্যবহারকারী এখনো অজ্ঞ। অপারেটর এবং ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারীদের ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণা চালাতে হবে।

পরিশেষে

VoWiFi প্রযুক্তি সকল নাগরিকের জন্য উন্নত মানের ভয়েস সেবা নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হতে পারে। ভয়েস ওভার ওয়াইফাই (VoWiFi) প্রযুক্তির সফল বাস্তবায়নের জন্য টেলিকম অপারেটর, ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। VoWiFi-সক্ষম ডিভাইসের জন্য ভর্তুকি, গ্রামীণ ব্রডব্যান্ড অবকাঠামোতে বিনিয়োগ এবং জনসচেতনতা কার্যক্রম এই প্রযুক্তির পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটররা ইতোমধ্যে তাদের নেটওয়ার্কে ভয়েস ওভার ওয়াইফাই (VoWiFi) প্রযুক্তির সফল পরীক্ষামূলক কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে ফলে বাংলাদেশের জনগন খুব দ্রুতই এই সেবা পেতে পারে।

লেখক: মো. আরিফুল হক- বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস পিএলসি (বিএসসিপিএলসি) -এর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার । তিনি এর আগে ওপেরা’র কান্ট্রি ডিরেক্টর, নোকিয়া’র অ্যাকাউন্ট ডিরেক্টর এবং হুয়াওয়ে’র প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সুদীর্ঘ ১৯ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি টেলিযোগাযোগ শিল্পে কাজ করছেন।
দ্রষ্টব্য: অভিমত-এ প্রকাশিত পুরো মতামত লেখকের নিজের। এর সঙ্গে ডিজিটাল বাংলা মিডিয়া কর্তৃপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বহুমতের প্রতিফলন গণমাধ্যমের অন্যতম সূচক হিসেবে নীতিগত কোনো সম্পাদনা ছাড়াই এই লেখা প্রকাশ করা হয়। এতে কেউ সংক্ষুব্ধ বা উত্তেজিত হলে তা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।