সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিকার নারী

ফারিয়া ইফফাত মীম
১১ জুলাই, ২০২৫ ০০:৩৫  
৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১৯:২৫  
সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিকার নারী

বর্তমান সময়ে নারীরা সবচেয়ে বেশি অনলাইনের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতি প্রতিহিংসা, নারীর প্রতি অসংবেদনশীলতা কিংবা নারীর দেয়া কোন মতামত-অভিমত পছন্দ না হলেই নারীর ব্যক্তি জীবনে আঘাত বাড়ছে। তার ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করার মাধ্যমে মানহানি করা কিংবা ডিপফেক ও এআই এর মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত তথ্য বিকৃত করে তাকে হয়রানি করা হয়। ভয় দেখানো কিংবা তার ক্ষতির হুমকি দেয়াটাও বর্তমানে যেন একটি ট্রেন্ড। নারীর আওয়াজকে দমিয়ে রাখতে হবে এমন মানসিকতা ও স্টকিংয়ের মাধ্যমে নারীর চলাফেরাকে কড়া নজরদারিতে রাখার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে চলছে। যার ফলে বর্তমানে ক্লিকবেইট সংবাদ শিরোনামে সাধারণ নারীদের ছবিও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। 

একটা সময় যখন ধরেই নেয়া হত যে, নারী কেবল তার পরিচিতজনদের দ্বারাই এধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। বর্তমানে আর এই ন্যারেটিভ নেই। অনলাইনে একজন নারী যে কারও দ্বারাই আক্রান্ত হতে পারেন। ২০২৪ সালে প্রকাশিত ইউএনউইমেনের একটি রিপোর্টে দেখা গেছে ৬৭% নারী অনলাইন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। প্রায় ৭৩ শতাংশ নারী সাংবাদিক অনলাইনে সহিংসতার শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

জার্মান ভিত্তিক উন্নয়ন ও ন্যায় বিচার সংক্রান্ত সহযোগিতা সংস্থা এনইটিজেডের ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সম্পর্কিত একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে জানা যায়, নির্যাতনের শিকার নারীদের শতকরা ৭৮ ভাগেরও বেশি প্রযুক্তিনির্ভর সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে ৭৮.৪ শতাংশ ফেসবুকে , ২৮ শতাংশ হোয়াটসআ্যাপ ও ইমোর মতো মেসেজিং অ্যাপে সংঘটিত হয়েছে।

ইন্টারনেটের প্রসার আমাদের জীবনকে সহজ করেছে। একই সঙ্গে ইন্টারনেটের অপব্যবহার নতুন এক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ব্যক্তিগত তথ্যচুরি বাড়ছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেসব দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে সেখানে এই প্রবণতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নারীসহ সাধারণ ব্যবহারকারীদের তথ্য চুরি ক্রমশ বাড়ছে।

তথ্যচুরির পদ্ধতি দিন দিন আরও উন্নত হচ্ছে। ফিশিংয়ের প্রবণতা বাড়ছে। হ্যাকাররা এমন ওয়েবসাইট বা ইমেইল তৈরি করে যা দেখতে ঠিক মনে হয়। ব্যবহারকারী যখন সেখানে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য হিসেবে ইউজারনেম ও পাসওয়ার্ড প্রবেশ করানোর পরে তথ্য হ্যাকারদের হাতে চলে যায়। এছাড়াও ম্যালওয়্যার আক্রমণ বাড়ছে।

ক্ষতিকারক সফটওয়্যার যা আপনার ডিভাইসে ইনস্টল করলে তা ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে হ্যাকারদের কাছে পাঠায়। এটি ইমেইল অ্যাটাচমেন্ট, সন্দেহজনক লিঙ্ক বা অনিরাপদ ওয়েবসাইট থেকে ছড়াতে পারে। এখন বিশেষভাবে ইন্টারনেটভিত্তিক সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং হ্যাকিংয়ের বড় একটা টুল। হ্যাকাররা মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তথ্য আদায় করে। ফোন করে বিকাশ বা ব্যাংক কর্মকর্তা সেজে বা পরিচিতজনের ছদ্মবেশে ব্যক্তিগত তথ্য চাইতে পারে। অনেকেই এমন ফাঁদে প্রতারিত হচ্ছেন।

অনলাইনে নারী ব্যবহারকারীরা তথ্যচুরির ক্ষেত্রে আরও বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। অনেক সময় চুরি করা ব্যক্তিগত তথ্য যেমন ছবি, ভিডিও বা চ্যাটের স্ক্রিনশট ব্যবহার করে তাদের ব্ল্যাকমেইল বা হয়রানি করা হয়। এর ফলে ভুক্তভোগীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় অনেকে আইনি সহায়তা নিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীর ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে ফেক অ্যাকাউন্ট তৈরি করে অপপ্রচার চালানোও একটি সাধারণ ঘটনা।

বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বেশ কিছু আইন ও বিধিমালা রয়েছে, যা অনলাইনে ব্যক্তিগত তথ্যচুরি এবং সাইবার অপরাধ দমনে সহায়তা করে। তবে এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। হ্যাকাররা প্রতিনিয়ত নতুন কৌশল অবলম্বন করছে, যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য কাজ করা কঠিন। অনেক সময় হ্যাকাররা দেশের বাইরে থেকে কাজ করে, যা তাদের সনাক্ত করা এবং বিচারের আওতায় আনাকে জটিল করে তোলে। ভুক্তভোগীরা অনেক সময় তথ্যচুরির পর্যাপ্ত প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেন না, যা মামলা দায়ের বা তদন্তে বাধা সৃষ্টি করে। সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা এবং অনলাইন ঝুঁকির বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে।

সোশ্যাল হ্যান্ডেলে অ্যাক্টিভ হলেও অনেক নারীই সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে অবগত নন। ফলে সহতেই নারীর সরল মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের থেকে সংবেদনশীল তথ্য হাতিয়ে নেয় হ্যাকাররা। সাধারণত ব্যবহারকারীর বিশ্বাস অর্জন করার জন্য কখনো বন্ধু, কখনওবা প্রেমিকের ছদ্মবেশ ধারণ করে এবং তাদের বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করে তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য করে। সচারচর এই ধরনের অপরাধের বেশি শিকার হন নারীরা। অনেক সময় তারা লোকলজ্জার ভয়ে ঘটনা প্রকাশ করেন না। এতে ঘুনপোকার মতো পুরো সমাজকেই কুটিকুটি করছে তারা। তাই এই ধরনের অপরাধের শিকার হলে, একা না থেকে পরিবারের সদস্য, বন্ধু বা বিশ্বাসযোগ্য কারো সাথে শেয়ার করা আবশ্যক। 


লেখক: মানবাধিকার কর্মী ও গবেষক


দ্রষ্টব্য: অভিমত-এ প্রকাশিত পুরো মতামত লেখকের নিজের। এর সঙ্গে ডিজিটাল বাংলা মিডিয়া কর্তৃপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বহুমতের প্রতিফলন গণমাধ্যমের অন্যতম সূচক হিসেবে নীতিগত কোনো সম্পাদনা ছাড়াই এই লেখা প্রকাশ করা হয়। এতে কেউ সংক্ষুব্ধ বা উত্তেজিত হলে তা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।