কেন দেশী আইটি কোম্পানিগুলো বিদেশমুখী?

বাংলাদেশের সফটওয়ার কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগেরই দেশের বাইরে (সিঙ্গাপুর, দুবাই, আমেরিকা) একটা করে কোম্পানি আছে। কেন জানেন? একমাত্র কারণ যাতে আমরা কাস্টমারের কাছ থেকে পেমেন্ট নিতে পারি, আমাদের কাজের জন্যে খরচ করতে পারি (ডোমেইন-হোস্টিং কেনা, মার্কেটিং-এ খরচ করা, টুলস কেনা, সাবস্ক্রিপশন খরচ দেয়া, ইত্যাদি)। এরপর যা অবশিষ্ট থাকে তা আমরা দেশে নিয়ে আসি বেতন দিতে, অফিস খরচ চালাতে। অনেকে শুধু প্রয়োজনেরটুকুই আনে, বাঁকিটুকু বিদেশের সেই ব্যাংকে পড়ে থাকে। বছর শেষে সেখানে সেই সরকারকে আমাদের ট্যাক্স দিতে হয়, অ্যাকাউন্টস মেইনটেইন করা, লিগাল সাপোর্ট ইত্যাদির জন্যে অনেক খরচ করতে হয়। বিভিন্ন স্টেটে/দেশে সেলস ট্যাক্স ফাইল করার ঝামেলা তো আছেই।
সবাই তো আর দেশের বাইরে যেতে পারে না, কিভাবে কি করবে তা নিয়ে হাতড়াতে থাকে, হা-হুতাশ করতে থাকে। দেখা যায় বিজনেস করার চেয়ে এইসব কমপ্লায়েন্স মেইনটেইন করতেই ফাউন্ডারদের অনেকটা সময় চলে যায়, বিজনেস বাড়ানোর চিন্তা তো পরের কথা। এমনটা কেন করতে হয়? একমাত্র কারণ আপনি যেই সার্ভিস বেচতেছেন, সেইটার জন্যে ডলার কালেকশন করা। আপনি সফটওয়ার বেচেন, সার্ভিস বেচেন, SaaS বিজনেস চালান, বা ক্লায়েন্টের কাজ করেন, দিন শেষে আপনাকে ক্লায়েন্ট/কাস্টমারের কাছ থেকে টাকা কালেক্ট করতে হয়। এই একটা মাত্র জিনিস না থাকার জন্যে আমরা ধুঁকে ধুঁকে মরছি। বিজনেস চালাতে গিয়ে আমরা বিজনেস এক্সপানশনের কথা চিন্তা করতে পারিনা, কিভাবে বিজনেস চালাব সেই চিন্তা করতেই আমাদের সিংহভাগ সময় চলে যায়।
ক্রেডিট কার: এই যে বাংলাদেশ আইটি সেক্টরে এতদূর এসেছে, সরকার এই করেছে সেই করেছে বলে চিল্লাফাল্লা করে। এর পেছনে তো আমি সরকারের কোনো ক্রেডিটই দিতে চাই না। পুরো ক্রেডিট তাদেরই প্রাপ্য, যারা এই সেক্টরে কাজ করছেন। এত এত ফ্রিল্যান্সার, এত কোম্পানি বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাজ করছে, প্রোডাক্ট ডেভেলপ করছে, এবং বিশ্বব্যাপী বিক্রি করছে—এসব কিছুই নিজেদের প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে। এখানে সরকারের ক্রেডিট নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা বাংলাদেশে বসে প্রোডাক্ট এবং সার্ভিস তৈরি করে বিশ্বব্যাপী বিক্রি করছি, কিন্তু কত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে যাচ্ছি তা একমাত্র আমরাই জানি।
আমাদের চাহিদা খুবই সামান্য— সহজে কোম্পানি চালানো, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, দ্রুত ইন্টারনেট, এবং সহজ পেমেন্ট গেটওয়ে। এই কয়েকটি জিনিস থাকলেই আমরা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি, এবং আমরা তা করেও দেখিয়েছি এবং করে যাচ্ছি। কিন্তু শুধুমাত্র একটি পেমেন্ট গেটওয়ের অভাবে আমাদের পুরো সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের মতো প্রতিটি কোম্পানিকে বিদেশে কোম্পানি সেটআপ করতে হচ্ছে এবং সেই দেশে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে।
পেমেন্ট প্রোভাইডার: যদি সরকার এই পেমেন্ট কালেকশনের ব্যাপারটিতে মনোযোগ দিতো, তাহলে তারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করতে পারতো। পেপালের মুলা তো আমরা সেই ২০০৮ সাল থেকে শুনে আসছি। পেপাল না থাকলেও, আরও অনেক বিকল্প আছে যেগুলো ব্যবহার করে আমরা পেমেন্ট কালেকশন করতে পারি। সরকার চাইলেই যে কোনো পেমেন্ট প্রোভাইডারের সাথে চুক্তি করে বাংলাদেশে তাদের সাপোর্ট আনতে পারতো, যাতে আমরা সহজেই ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পেমেন্ট নিতে পারি এবং কাস্টমারকে ইনভয়েস করতে পারি। এতে করে সার্ভিস বিজনেসের যারা আছেন তারা খুব সহজেই ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করতে পারতেন। যারা সফটওয়ার সেল করছেন, SaaS বিজনেস চালাচ্ছেন বা সাবস্ক্রিপশন বেচতেছেন, কারোরই বিদেশে কোম্পানী সেটাআপ করা লাগতো না। এটা না করতে হলেই আমার মনে হয় ৫০% হ্যাসল কমে যেত।
ডলার একাউন্ট: আমার মনে হয় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে একটি ডলার একাউন্ট থাকতে পারে, যেখানে আউটসোর্সিং, সফটওয়্যার সার্ভিস ইত্যাদি থেকে আমরা যেই ডলারগুলো অর্জন করব, সেটা যেন আমরা ডলার হিসেবেই রাখতে পারি। এই একাউন্টের সাথে ডেবিট কার্ড এবং ক্রেডিট কার্ড থাকতে পারে যা ব্যবহার করে আমরা ডলারে খরচ করতে পারবো। যেমন হোস্টিং বিল দেয়া, ডোমেইন কেনা, মার্কেটিং এক্সপেন্স ইত্যাদি—সবকিছু এখান থেকেই যাতে করা যায়। এতে করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আর বিদেশের ব্যাংকগুলাতে পড়ে থাকবে না, বাংলাদেশে চলে আসবে। আর আমাদের বিদেশে কোম্পানি খুলে সেখানে ট্যাক্স দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন: আরেকটি বিষয় হলো, কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন। বাংলাদেশের প্রায় ৯০% সফটওয়্যার কোম্পানি রেসিডেন্সিয়াল এলাকায় অফিস করছে, কিন্তু এখানে কোনোভাবেই ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া সম্ভব নয়। একটি কোম্পানি খোলা এবং সেখান থেকে বিজনেস পরিচালনার প্রক্রিয়া যত সহজ করা যাবে, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল হবে। কিন্তু এই বিষয়ে কারোই মাথাব্যথা নেই।
ট্যাক্স এবং ভ্যাট: এটি যে কত বড় একটি সমস্যার বিষয়, যারা শুধুমাত্র ব্যবসা করছেন তারাই বুঝতে পারেন। আমরা যারা সফটওয়্যার বা আইটি বিজনেসের সাথে যুক্ত আছি, এইসব ঝামেলার কারণে আমাদের অধিকাংশ সময় চলে যায় শুধুমাত্র কমপ্লায়েন্স মেইনটেইন করতে। যেমন আমাদের ১০০% রেমিটেন্স ইনকাম, কিন্তু ট্যাক্স/ভ্যাট অফিস এমন সিস্টেম করে রেখেছে আপনি কোন ভাবেই পার পাবেন না, লাখ লাখ টাকা চেয়ে বসে। কোন এক্সপ্ল্যানেশনেই তারা মানতে নারাজ। এদের চোখ যে কিরকম উঁচু হয়ে গেছে যারা ভুক্তভোগী তারাই বোঝে। আমি জানি অনেকে ব্যবসা পর্যন্ত বন্ধ করে ফেলসে এদের অত্যাচারের কারণে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ করতে চাইলে ব্যবসা পরিচালনা সহজ করুন, দেশের আনাচে-কানাচে হাই স্পিড ইন্টারনেট সহজলভ্য করুন, সহজে পেমেন্ট নিতে দিন, এবং ট্যাক্স ও ভ্যাট প্রক্রিয়াকে সহজ করুন, আমাদের উপর ইনভেস্ট করুন। আপনাদের ফ্রিল্যান্সার বানানোর দরকার নাই, ৫০০ অ্যাপ বানানোর দরকার নাই, হাজার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট তৈরী করে হাতিয়ে নেয়ার প্রয়োজন নাই। কারণ দিনশেষে সেটা আমাদের প্রয়োজনে আসে না, পলক, জয় - এদের মত মানুষের পকেটে ঢোকে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সিটিও উইডেভস