তথ্য প্রযুক্তি খাতের সংস্কারে একটি কনভেনশন প্রস্তাবনা

বিগত সরকারের সময়কার (জুন ২০২৪) সময়ে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশ্বিক ডিজিটাল সূচকে বাংলাদেশ ১০০-এর মধ্যে ৬২ স্কোর করেছে যেখানে বিশ্বব্যাপী গড় স্কোর ৭৪.৮। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আই টি ইউ) আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স অনুসারে, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলির গড় স্কোর হল ৬৪.৮ ৷ সূচক অনুসারে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ। বৈশ্বিক এই সূচক অনুযায়ী বৈশ্বিক গড় এবং নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলির গড় স্কোর দুটোতেই বাংলাদেশের স্কোর কম যা চরম হতাশাজনক। এই সূচকে মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভিয়েতনাম ও ভুটানের অবস্থানও বাংলাদেশের উপরে।
আইএমএফের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রস্তুতি সূচকে জুন, ২০২৪-এ ১৭৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩তম, তালিকায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, রুয়ান্ডা, ঘানাও বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান সার্ফশার্ক ডিজিটাল কোয়ালিটি অব লাইফ ইনডেক্স ২০২৩ এর ডিজিটাল জীবনমান সূচকে বিশ্বের ১২১ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৮২তম; এক্ষেত্রে আগের বছরের চেয়ে বাংলাদেশ পিছিয়েছে পাঁচ ধাপ।
গত সপ্তাহে সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত আইসিটি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি খাতে ২০১০-২০১১ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে ২৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, কিন্তু এর ফল পায়নি দেশের মানুষ।
এমতাবস্থায়, দেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাতের এই ভগ্ন দশার উত্তরণে সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ নেওয়া সমীচিন।
(১) সাইবার নিরাপত্তা আইন: পুনর্লিখন অথবা সংশোধন
বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকার গণদাবির প্রেক্ষাপটে নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (২০১৮) রহিত করে ১৮ সেপ্টেম্বর,২০২৩ তারিখে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ নামে নতুন আরেকটি গণবিরোধী আইন প্রণয়ন করেছিল যা ছিল অনেকটা নতুন মোড়কে পুরনো ‘ঘোড়ার ডিম’ এবং আইনটি নিপীড়নমূলক চর্চা অব্যাহত রেখে এখনো অক্ষুণ্ণ রয়েছে। প্রচলিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে অনুমতি ছাড়াই যেকোনো ব্যক্তিকে আটক বা গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই আইন অনলাইন কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের সুবিধা দেয় এবং ব্যক্তির বাক্স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে। সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময়ও অসংখ্য ব্যক্তিকে এই আইনের আওতায় গ্রেফতার করা হয়েছে। এই আইনটি দ্রুত বাতিল করে বৈশ্বিক সাইবার নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি প্রকৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণীত হওয়া সকলের ঐক্যবদ্ধ দাবি।
(২) সাইবার সুরক্ষা: একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন প্রস্তাবনা
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) চেতনার পুনরুজ্জীবন হওয়া দরকার বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন । তিনি অতিশীঘ্রই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দিবেন। ভাষণে স্বভাবতই আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ইস্যু উঠে আসবে। উনার আন্তর্জাতিক যোগাযোগ দক্ষতাকে ব্যবহার করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাইবার নিরাপত্তা সহ তথ্য-প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্বের বৈষম্য বিরোধী একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশনের প্রস্তাব উনি রাখতে পারেন যার ফলে রাষ্ট্র বাংলাদেশ সাইবার হ্যাকিং বা প্রযুক্তিভিক্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধের হুমকির প্রতিরোধ গড়ার নৈতিক সমর্থন পেতে পারে। এই কনভেনশন প্রস্তাবের মাধ্যমে তিনি অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সহ আঞ্চলিক দেশগুলোকে সাইবার নিরাপত্তা সহ তথ্য-প্রযুক্তির বৈশ্বিক ব্যবহারকে বৈষম্যহীন করাতে একীভুত রাখার দৃশ্যমান দায়বদ্ধতা দেখাতে পারবেন যার সুদূরপ্রসারি প্রভাব প্রযুক্তি ব্যবসা ও কর্মক্ষেত্রে অবদান রাখবে।
(৩) ইন্টারনেট এর ব্যবহার সাংবিধানিক অধিকার
ইন্টারনেট বন্ধ করে গণহত্যা চালানোর নজির আমাদের দেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সম্প্রতি দেশের বহুল প্রচলিত একটি দৈনিকে ‘যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখা সমর্থন করেন কি?’ জরিপে ৯৪ শতাংশ মানুষ (প্রায় বাহাত্তর হাজার পাঠক) কোনোভাবেই ইন্টারনেট বন্ধের পক্ষে নন বলে মত দিয়েছেন। এপ্রেক্ষিতে আইন করে নিশ্চিত করার প্রয়োজন, বাংলাদেশের কোথাও কখনো ইন্টারনেট বন্ধ করা যাবেনা। সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট ব্যবহারকে একটি সাংবিধানিক মোলিক অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করা প্রয়োজন এবং প্রয়োজনে সংবিধানে সংযুক্ত করা যেতে পারে।
(৪) অবকাঠামোগত সংস্কার
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় হলেও টিয়ার ফোর ডেটা সেন্টার উদ্যোগের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং প্রকল্পের অপচয় নিয়ে কথা উঠছে। ভেন্ডরগুলোর সঙ্গে অসম চুক্তি করা হয়েছে, ওপেনসোর্স প্রযুক্তিকে না রেখে প্রোপাইটরি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানদের সাথে বৈষম্য চুক্তি করার অভিযোগ এসেছে যা যথার্থ পর্যালোচনাযোগ্য। হাইটেক পার্ক উচ্চপ্রযুক্তির প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত না হয়ে দালান তৈরির সংস্থা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় জমি অধিগ্রহণ ও দালান এবং অপ্রয়োজনীয় ভৌতকাঠামো তৈরি করা হয়েছে যার ব্যবহার নেই বললেই চলে। অবকাঠামো খাতে মিররিং ক্যাপাবিলিটিসহ ক্লাউড ডাটা সেন্টার নির্মাণ করার মাধ্যমে এর বহুবিধ সুবিধাকে উন্মুক্ত করা যায়। এ ক্ষেত্রে তথ্য সুরুক্ষা, হাই ব্যান্ডউইথ এবং দ্রুত একসেস এর প্রযুক্তিগত বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সাম্প্রতিক ফলাফল নিরীক্ষণ করে পরিকল্পনা আনয়ন জরুরি । ডাটা সেন্টারের মাধ্যমে ডাটা লোকালাইজেশন (স্থানীয়করণ) বাড়াতে পারলে, বাইরের দেশে ক্লাউড, জিপিইউ ভাড়াবাবদ যে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়, তার সাশ্রয় ঘটবে।
(৫) বৈদেশিক মুদ্রা আনয়ন:
বাংলাদেশে এখনো আমাজন, পেপাল, গুগল পে, আইক্লাউড/অ্যাপল পে প্রভৃতি ফাইনেন্সিয়াল পেম্যান্ট সার্ভিস নেই। সাম্প্রতিক অতীতে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে এসব সার্ভিস আসার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ এ সার্ভিসগুলো দেশে চালুর ব্যবস্থা করলে শুধু ফ্রিল্যান্সাররাই নয়, অনেক প্রযুক্তিবান্ধব সার্ভিস রফতানি মুখর হয়ে উঠবে। নীতিমালা জোরদারের মাধ্যমে সরকারের আয় খাত সমৃদ্ধ হবে।
(৬) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা নীতিমালা ও ব্যবহারকে উৎসাহীত করণ
বৈশ্বিক প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বার সাথে এগিয়ে চলার মানসিকতা নিয়ে নীতিমালা আনয়ন অত্যাবশ্যক। ডিফফেইক প্রযুক্তির মাধ্যমে কন্ঠস্বর, ভিডিও বিকৃতি করে বিভিন্ন অপপ্রচারের বিরুদ্ধে নীতিমালা ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বার ব্যবহারিক দিক পাঠ্যপুস্তকে সম্পৃক্ত করে প্রযুক্তির ইতিবাচক উপকারিতার মাধ্যমে সবাই উপকৃত হবে। এ ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বার আন্তর্জাতিক নীতিমালার সাথে সংযুক্তি জরুরি।
(৭) জনবান্ধব রেগুলেটরি ও লাইসেন্সিং
রেগুলেটরি রিফর্ম কে সুবিবেচনা করা উচিত। অভিজ্ঞ, অংশীদারদের মতের ভিক্তিতে রেগুলেটরি কে জনবান্ধব ও সুব্যবসা ও সুউদ্যোগ বান্ধব করা সমীচীন। লাইসেন্সিং মডেল গুলো সহজ, দ্রুত ও বৈষম্যহীন করে বিটিআরসি , এনটিএমসির মত প্রতিষ্ঠানগুলো কে জ্ঞান নির্ভর ও জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার মাধ্যমে ভাল পরিবর্তন আনা সম্ভব।
(৮) বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি, সাইবার অনিয়মের সুর্নিদিষ্ট সুতদন্ত ও বিচার
বিগত দশকে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে অনিয়ম ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থ পাচার (বিশেষত বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি) সহ প্রচুর অনিয়মের সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনার মাধ্যমে প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে আস্থা, জবাবদিহিতা স্থাপিত হবে।
(৯) ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা প্রবিধান
সাম্প্রতিক অতীতে দেখেছি, যতই আইন থাকুক না কেন ফোনে আড়িপাতা সহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন (GDPR) এর আদলে ব্যক্তিগত তথ্য অর্জন এবং প্রক্রিয়াকরণের জন্য নির্দেশিকা সরকার রাষ্ট্রীয় বা দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে প্রস্তাবনা আনয়ন করতে পারে। এতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যারা মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে কাজ করে তারা নিয়মের মধ্যে থাকবে এবং জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে।
নিঃসন্দেহে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সম্ভাবনা অনেক। কিন্তু জুজুর ভয় ও সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গল্প শুনিয়ে এ খাতকে এতদিন ঝাপসা করে রাখা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে- তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ভারতের রপ্তানি ১৯৮ বিলিয়ন ডলার, ভিয়েতনামের ৩০ বিলিয়ন, ফিলিপাইনের ১৮ বিলিয়ন, পাকিস্তানের ৩ বিলিয়ন আর বাংলাদেশ এখনো ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশে। ‘একসেস টু ফাইন্যান্স’ এর জনবান্ধব উদ্যোগ, দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজনে আইসিটি ক্যাডার সৃষ্টি, সচেতনতা, বিকেন্দ্রীয়করণ কে উৎসাহিত করার মাধ্যমে তথ্য-প্রযুক্তি খাতের দৃশ্যমান সংস্কার সম্ভব এবং এর ফলে বাংলাদেশ ২.০ এর অগ্রযাত্রা তরাণ্বিত হবে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস ফোরাম (বিডিসাফ)