ডিজিটাল অধিকার: সাইবার সুরক্ষা আইনের সংস্কার ও বুদাপেস্ট কনভেনশনের অপরিহার্যতা

বাংলাদেশের সাইবারসিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০২৪ সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ দেশটি ক্রমবর্ধমানভাবে সাইবার হুমকিপূর্ন ডিজিটাল জগতের জটিলতাগুলি মোকাবেলা করছে। জাতির ডিজিটাল কাঠামো সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, বর্তমান আইনটি তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম নয়। এটি মানবাধিকার ক্ষুন্ন করে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যথাযথ ভুমিকা পালনে অপারগ। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে তার সাইবারসিকিউরিটি আইনগুলি সংশোধন করতে হবে এবং সাইবারক্রাইমের ওপর বুদাপেস্ট কনভেনশন স্বাক্ষরের বিষয়টি জরুরী ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। এই দুইটি পদক্ষেপ গ্রহণ বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করবে, গ্লোবাল সাইবারসিকিউরিটি ইনডেক্সে (GCI) -এ বাংলাদেশের র্যাংকিং উন্নত করবে, নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে এবং সামগ্রিক সাইবারসিকিউরিটি সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।
২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত বুদাপেস্ট কনভেনশন হলো প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি যা ইন্টারনেট এবং কম্পিউটার-সংক্রান্ত অপরাধ মোকাবেলার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এটি সদস্য রাষ্ট্রগুলির সাইবারসিকিউরিটি আইনগুলির সমন্বয় সাধন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা উৎসাহিত এবং সাইবার অপরাধগুলির কার্যকর তদন্ত ও প্রসিকিউশনের জন্য একটি কাঠামো প্রদান করে। এই কনভেনশনকে বিশ্বব্যাপী সাইবারক্রাইমের বিরুদ্ধে প্রচেষ্টার একটি মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা পারস্পরিক আইন সহায়তা (MLA) এবং সাইবার তথ্য বিনিময়ের জন্য স্পষ্ট নির্দেশিকা প্রদান করে এবং যা সীমান্ত অতিক্রমকারী সাইবার হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ITU গ্লোবাল সাইবারসিকিউরিটি ইনডেক্স (GCI) পাঁচটি মৌলিক মানদণ্ডের মাধ্যমে সাইবারসিকিউরিটিতে দেশগুলির প্রতিশ্রুতি মূল্যায়ন করে: আইনগত ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, সংগঠনগত কাঠামো, সক্ষমতা বৃদ্ধি, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। বুদাপেস্ট কনভেনশনের মতো আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলির প্রতি প্রতিশ্রুত দেশগুলি সাধারণত সাইবার হুমকির বিরুদ্ধে মোকাবেলার ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতামূলক সক্ষমতার কারণে উচ্চ স্কোর অর্জন করে।
বর্তমানে, সাইবারসিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০২৪ ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা প্রদান করছে না। ডিজিটাল কার্যক্রমের বিস্তারের সাথে সাথে ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহারের ঝুঁকিও বাড়ছে। নাগরিকদের অধিকার রক্ষার জন্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাধারণ তথ্য সুরক্ষা বিধিমালা (GDPR) এর মতো বিশ্বব্যাপী মানের প্রতিপালিন নিশ্চিত করার জন্য, বাংলাদেশকে তার আইন সংশোধন করতে হবে যাতে তথ্যের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্যক্তিগত তথ্যের অ্যাক্সেসের জন্য বিচারিক অনুমোদন প্রয়োজন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং আইনটির সম্ভাব্য অপব্যবহার প্রতিরোধ করবে।
বিদ্যমান সাইবারসিকিউরিটি অ্যাক্টের অস্পষ্ট ভাষার জন্য সমালোচনা করা হয়েছে, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। সাইবারক্রাইমের বিরুদ্ধে লড়াই করা জরুরি হলেও, আইনটির প্রয়োগ ব্যবস্থা দ্বারা ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করা উচিত নয়। আইনটিতে সাইবার অপরাধের স্পষ্ট সংজ্ঞা থাকতে হবে যাতে অধিকার-কর্মী বা বিরোধীদের বিরুদ্ধে এটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা যায়। জাতীয় নিরাপত্তা এবং নাগরিক স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে অনলাইন বক্তৃতার ওপর সমস্ত নিষেধাজ্ঞা বিচারিক পর্যালোচনার আওতাভুক্ত হওয়া উচিত।
বুদাপেস্ট কনভেনশন থেকে বাংলাদেশের অনুপস্থিতি আন্ত:সীমান্ত (cross-border) সাইবারক্রাইম তদন্তে দেশটির কার্যকরভাবে জড়িত হওয়ার ক্ষমতাকে খর্ব করে। সাইবার হুমকিগুলি প্রায়ই জাতীয় সীমানা লঙ্ঘন করে; সুতরাং, কার্যকর প্রতিক্রিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। বুদাপেস্ট কনভেনশন পারস্পরিক আইন সহায়তা, প্রত্যর্পণ, এবং তথ্য বিনিময়ের সুযোগ প্রদান করে, যা হ্যাকিং, অনলাইন প্রতারণা, এবং তথ্য লঙ্ঘনের মতো জটিল সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় অপরিহার্য।
বুদাপেস্ট কনভেনশন স্বাক্ষরের মাধ্যমে, বাংলাদেশের অন্যান্য দেশের সাথে সহযোগিতা করার ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সাইবারক্রাইমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বৈশ্বিক দক্ষতা এবং সম্পদ লাভ করবে। এটি ITU গ্লোবাল সাইবারসিকিউরিটি ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত করতে সহায়ক হবে, কারণ আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব বর্তমানে এর স্কোরকে হ্রাস করছে।
বুদাপেস্ট কনভেনশন গ্রহণ করা বাংলাদেশের আইনগত কাঠামোটিকে বিশ্বমানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করবে, সাইবার অপরাধগুলিকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করবে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য শক্তিশালী কাঠামো প্রতিষ্ঠা করবে। এটি আন্ত:সীমান্ত (cross-border) সাইবার অপরাধের তদন্তকে সহজতর করবে, জ্ঞানের বিনিময়কে (knowledge sharing) উৎসাহিত করবে এবং সর্বপোরি বাংলাদেশকে সাইবার হুমকি মোকাবেলায় আরও কার্যকরভাবে প্রস্তুত করবে।
এছাড়াও, সাইবারসিকিউরিটি অ্যাক্ট সংশোধন করা হলে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে আইনটির সম্ভাব্য অপব্যবহার প্রতিরোধ হবে। বুদাপেস্ট কনভেনশনের দ্বারা নির্ধারিত সুরক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে, বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারে যে তার সাইবারসিকিউরিটি ব্যবস্থা মানবাধিকার রক্ষা করে এবং জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখে।
এছাড়াও, বুদাপেস্ট কনভেনশন মেনে চলা দেশগুলি সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, প্রযুক্তিগত সহায়তা, এবং আইন প্রয়োগের প্রশিক্ষণের সুবিধা পায় যার ফলে সাইবার ঘটনাগুলির প্রতিরোধ, সনাক্তকরণ, এবং প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। কনভেনশনে যোগ দিয়ে, বাংলাদেশ তার আইন প্রয়োগের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে সম্ভাব্য সাইবার হুমকিসমূহ মোকাবেলায় আরও দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
পরিশেষে, বুদাপেস্ট কনভেনশন স্বাক্ষর বাংলাদেশে গ্লোবাল সাইবারসিকিউরিটি মাপকাঠির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার সংকেত দেবে, ফলে আন্তর্জাতিক অবস্থান উন্নত হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগের জন্য দেশটি আরও আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হবে। বৈশ্বিক ব্যবসাগুলি প্রায়শই বিনিয়োগের জন্য দৃঢ় সাইবারসিকিউরিটি কাঠামো সহ দেশগুলি সন্ধান করে। অতএব, বুদাপেস্ট কনভেনশনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সাইবার সিকিউরিটি আইন বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং আইনের সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে।
সাইবারসিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০২৪ একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবে তথ্যের গোপনীয়তা, মানবাধিকার, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংক্রান্ত বিষয়গুলির সমাধানে বর্তমান আইনটি যথাযথ নয়। সুতরাং, নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনটির সম্ভাব্য অপব্যবহার প্রতিরোধ এবং সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মত বিষয়গুলো বিবেচনা করে আইনটির সার্বিক সংশোধন অত্যাবশ্যক। বুদাপেস্ট কনভেনশন স্বাক্ষরের মাধ্যমে, বাংলাদেশের সাইবারসিকিউরিটি কাঠামো উন্নত হবে, GCI র্যাংকিং-এ বাংলাদেশের অবস্থান অগ্রসর হবে এবং দেশের সাইবারক্রাইমের বিরুদ্ধে লড়াই করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এই সংস্কারগুলি কেবল জাতির ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করবে তা নয়, বরং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতি বৃদ্ধি করবে এবং দেশের উদীয়মান অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : আইসিটি পরামর্শক