কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনা ও ঝুঁকি: জাতিসংঘে বাংলাদেশের বার্তা ও প্রেক্ষাপট বাস্তবতা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি, সম্ভাবনা, স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি ও মানব শ্রমের সংকট নিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে গত শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রি.) প্রদত্ত ভাষণে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence) অগ্রগতি ও সম্ভাবনাকে স্বাগত জানালেও স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তার (Autonomous Intelligence) ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ডক্টর ইউনূস কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় বিকাশ এবং এর বহুমাত্রিক প্রয়োগে বাংলাদেশ বিশেষভাবে আগ্রহী উল্লেখ করে বলেন, “আমাদের তরুণ সমাজ জেনারেটিভ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সম্ভাবনা নিয়ে উচ্ছ্বসিত। একজন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে তারাও চায় নতুন পৃথিবীতে নিয়োজিত হতে, কর্মক্ষম হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে। বাংলাদেশের মতো বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠীর দেশ যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগজনিত অর্জিত সুফল থেকে পিছিয়ে না পড়ে, বিশ্ব সম্প্রদায়কে তা নিশ্চিত করতে হবে। “
একই সঙ্গে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে যাতে মানব শ্রমের চাহিদা কমে না যায় এবং বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমতা নিশ্চিত হয়, সেই আশাবাদ ব্যক্ত করে ভাষণে তিনি বলেন ''নিশ্চিত করতে হবে যেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে কর্মক্ষেত্রে মানুষের চাহিদা সংকুচিত হয়ে না যায়।”
বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে প্রতিবছর লক্ষাধিক তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, সেখানে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং এআই-এর অগ্রগতির ফলে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অপরিহার্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুফল সবাই যেন অর্জন করতে পারে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং নতুন ধরনের জ্ঞান-বিনিময়ের সুযোগ তৈরির প্রয়োজনীয়তার উপর তিনি তাঁর প্রদত্ত ভাষণে গুরুত্ব তুলে ধরেণ।
এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের চাহিদার সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জনে প্রস্তুত হতে হবে। স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তার (Autonomous Intelligence) ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভাষণে তিনি বলেন “আমরা অটোনমাস ইন্টেলিজেন্স অর্থাৎ যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই নিজের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সম্প্রসারিত করতে পারে, মানুষের কোনও হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে, তার ব্যাপারে আমরা বৈজ্ঞানিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, তারা যেন এক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার আগে মানুষের ওপর এর প্রভাব সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে অগ্রসর হন। আমাদের ধারণা, অটোনমাস ইন্টেলিজেন্স মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। “
বাংলাদেশের প্রতিনিধি, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো উন্নত বিশ্বের আলোচিত এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশের তরুণদের অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি, তিনি এই প্রযুক্তির বৈষম্যমূলক ও একপাক্ষিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক করে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার আহবান জানিয়েছেন। তাঁর এই প্রাজ্ঞ দিকনির্দেশনা বাংলাদেশকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে গেছে, যেখানে দেশটি বিশ্ব প্রযুক্তি নীতি এবং প্রযুক্তি রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে নিম্নোক্ত পর্যবেক্ষণ গুলো সুবিবেচনা করা যেতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের চলমান সংকট মোকাবিলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই প্রযুক্তি আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে আরও নির্ভুল, দ্রুত এবং সহজলভ্য করে তোলার মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বে মানুষকে ভালোভাবে প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ করে দেয়, যা জীবন এবং সম্পদ রক্ষায় সহায়ক।
সম্প্রতি গুগলের অর্থায়নে তৈরি এআই-ভিত্তিক আবহাওয়া মডেল কার্যকারিতার দিক থেকে প্রচলিত পদ্ধতিগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। ব্রিটেনের আবহাওয়া অফিসের মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আবহাওয়ার পূর্বাভাসে একটি বিপ্লব আনতে সক্ষম। ভারতের আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি)ও গাণিতিক মডেলের সাথে এআই এবং অত্যাধুনিক পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক যোগ করে আরও উন্নত ও নির্ভুল পূর্বাভাসের পথে এগিয়ে চলার পরিকল্পনা করেছে। এটি আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবস্থায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে, যা মানুষকে আগাম প্রস্তুতি নিতে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও দক্ষ করে তুলবে।
কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রান্তিক কৃষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপকারে আসতে পারে। এটি সঠিক আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রদান ছাড়াও কৃষকদের সেচ এবং ফসল রোপণের সময় নির্ধারণে সাহায্য করে। এছাড়াও, এআই-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনগুলি রোগ ও পোকামাকড় শনাক্ত করতে সক্ষম, ফলে সময়মত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। সঠিক পরিমাণে সেচ ও সার ব্যবহারে সহায়তা করে, এআই উৎপাদন খরচ কমায় এবং ফসলের গুণগত মান বাড়ায়। কৃষকদের বাজারমূল্য পূর্বাভাসের মাধ্যমে ন্যায্য মূল্য পেতে সহায়তা করে এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে পরামর্শ পাওয়ার সুযোগ তৈরি করে। এভাবে, এআই প্রান্তিক কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং তাদের কাজকে সহজ করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ট্রাফিক বিভাগে উল্লেখযোগ্যভাবে সাহায্য করতে পারে। এটি ট্রাফিকের প্রবাহ বিশ্লেষণ করে সঠিক সময়ে সিগন্যাল পরিবর্তন করে যানজট কমাতে সহায়তা করে। এআই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা পূর্বাভাস দিতে পারে, যা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোরদার করে। যানবাহনের স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণের মাধ্যমে এটি ট্রাফিক পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে, যা আমাদের দৈনন্দিন যাতায়াতে সুবিধা প্রদান করে। এইভাবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে আরও মানবিক, দক্ষ এবং নিরাপদ করে তোলে, আমাদের যাতায়াতের অভিজ্ঞতাকে উন্নত করতে ভূমিকা রাখতে পারে।
এছাড়া আমাদের স্বাস্থ্য খাতের সরকারি হাসপাতালের উপাত্তগুলো সংরক্ষণ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ রূপরেখা সৃষ্টি করা যায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) কম্পিউটার সিস্টেমকে ব্যবহার করে মানুষের মতো চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, ও ব্যবসায় কার্যকরী সমাধান প্রদান করে। অন্যদিকে, স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তা (Autonomous Intelligence) AI-এর একটি উন্নত রূপ, যেখানে সিস্টেমগুলি স্বাবলম্বীভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখে এবং মানবীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজ করে। এটি বিশেষ করে ড্রোন, রোবট ও স্বায়ত্তশাসিত যানবাহনে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে কৃত্রিম ও স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। দেশের তরুণদের মধ্যে প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে এবং AI কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবহন খাতে নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। তবে, স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তার কারণে শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে সঠিক নীতিমালা এবং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃত্রিম ও স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তার নিরাপদ ব্যবহার জরুরি।
সংগতকারণে ডক্টর ইউনূস অটোনোমাস ইন্টেলিজেন্স বা স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যা বাংলাদেশের জন্য বৈশ্বিক নেতাদের কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা তৈরি করেছে। আমরা প্রত্যাশা করি বৈশ্বিক নেতারা এই প্রযুক্তির উন্নয়ন ও প্রয়োগে নৈতিকতা এবং দায়িত্বশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করবেন যাতে অটোনোমাস ইন্টেলিজেন্সের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের শ্রমবাজারে না পড়ে। বাংলাদেশ প্রযুক্তি ও জ্ঞানের বিনিময়ে সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক সহায়তার প্রত্যাশা করছে, যা উন্নত দেশগুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগে গবেষণা ও উন্নয়নে সহায়ক হবে। এছাড়া, সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বৈশ্বিক নেতাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি এআই নীতি ও পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে, যাতে অটোনোমাস ইন্টেলিজেন্সের নিরাপদ এবং মানবিক ব্যবহারের জন্য একটি সুরক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। বাংলাদেশের লক্ষ্য হল প্রযুক্তির এই যুগে একটি সুস্থ এবং টেকসই শ্রমবাজার গড়ে তোলা, যা যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করবে।
বিশ্বের প্রধান দেশ ও সংস্থাগুলি, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং সমাধানে একত্রে কাজ করার জন্য সম্মত হয়েছেন। এআই-এর মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য এবং গুজব তৈরির সম্ভাবনা একটি গুরুতর সমস্যা, যা নির্বাচনের ফলাফলকেও প্রভাবিত করতে পারে। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দল এআই নিয়ন্ত্রণের ভিন্ন পন্থা উপস্থাপন করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এআই আইন প্রবর্তনে আগ্রহী হলেও যুক্তরাজ্য এআই শিল্পের দ্রুত পরিবর্তনের কারণে কঠোর আইন প্রয়োগে দ্বিধায় রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এআই এজেন্ডা নির্ধারণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে এআই সিস্টেমের পরীক্ষার ফলাফল সরকারে জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন, এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস একটি এআই নিরাপত্তা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন ইতিমধ্যে।
ডক্টর ইউনূস তার প্রদত্ত জাতিসংঘের ভাষণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি কেবল আঞ্চলিক নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক দিকই শুধু তুলে ধরেননি; বরং তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো সমসাময়িক প্রযুক্তিগত ও রাজনৈতিক বিতর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। এই আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু নিজেকেই উপকৃত করবে না, বরং বিশ্বের প্রযুক্তিক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোও নতুন সুযোগের সন্ধান পাবে। ফলে, বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এভাবে, এই আলোচনা কেবল দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বৈশ্বিক প্রযুক্তি উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সাধারণ সম্পাদক; বাংলাদেশ সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস ফোরাম (বিডিসাফ)