কোন পথে স্টারলিংক
২০২৭ সালে শেষ হতে চলেছে আইএলডিটিএস নীতি ২০১০-এর অধীনে থাকা ২৬ ক্যাটাগরির তিন হাজার ২৯৯টি সেবাদাতার লাইসেন্সের মেয়াদ। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কমিশনের লাইসেন্স তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয় নন-জিওস্টেশনারী অরবিট (এনজিএসও) স্যাটেলাইট সার্ভিসেস অপারেটর লাইসেন্স। চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল একক লাইসেন্সি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই লাইসেন্স পেয়েছে স্টারলিংক সার্ভিসেস বাংলাদেশ। ১০ বছর মেয়াদী লাইসেন্স নিয়ে প্রথম বছরের চার মাসে দুই ক্যাটাগরিতে এখনো দুই হাজারের কম গ্রাহক পেয়েছে শতকোটিপতি ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠানটি।
কৃত্রিম উপগ্রহ ভিত্তিক এই ইন্টারনেট সেবা পেতে একেজন গ্রাহককে এককালীন যন্ত্রপাতি সেটআপ বাবদ গুণতে হয়েছে ৪৭ হাজার টাকা। আবাসিক গ্রাহকদের মাসিক বিল গুণতে হচ্ছে ৬ হাজার টাকা। আর আবাসিক লাইট প্যাকেজে ৪ হাজার ২০০ টাকা। বিটিআরসি’র কাছে জমা থাকা হিসাব অনুযায়ী, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্টারলিংকের গ্রাহক সংখ্যা ছিলো ১ হাজার ৮৬২। এর মধ্যে আবাসিক গ্রাহক ১ হাজার ২৫১টি।আবাসিক লাইট সংযোগ ৪৯৫টি। এছাড়াও ৫৮টি মোবাইল (রেসিডেনশিয়াল), ১১টি প্রিমিয়াম বিজনেস মোবাইল, ২০টি প্রিমিয়াম বিজনেস, ১টি প্রিমিয়াম রেসিডেনশিয়াল, ২০টি এন্টারপ্রাইজ এবং ৬টি টেস্টার গ্রাহক রয়েছে।
স্টারলিংকের রেসিডেন্স ও রেসিডেন্স লাইট সংযোগে কোনো নির্দিষ্ট ব্যবহারকারী বা ডিভাইস সংখ্যা নির্ধারিত নেই, তবে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সংযোগের সংখ্যা ব্যবহারকারীর ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে, কারণ বেশি ডিভাইস একই সময়ে ব্যবহার করলে গতি কমে যেতে পারে। তবে, স্টারলিংকের স্ট্যান্ডার্ড রাউটারে একসাথে ১২৮টি ডিভাইস পর্যন্ত সংযুক্ত হতে পারে।
বাংলাদেশে সেবা দিতে এরই মধ্যে বাংলাদেশ সাবমেরিন কোম্পানি পিএলসি থেকে ২০০ গিগাবাইট ব্যান্ডউইথ কিনেছে স্টারলিংক। এছাড়াও আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) থেকে ৮০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ নিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের গ্রাহকরা ব্যবহার করেছে মাত্র ৩০ জিবিপিএস ব্যান্ডইউথ। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে এতো ব্যান্ডউইথ কোথায় যাচ্ছে? বাংলাদেশে সেবা না বিদেশের সেবা সম্প্রসারণের ঘাঁটি হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে? না কি প্রযুক্তি সুবিধার আড়ালে বাংলাদেশের ব্যবসা সহ অন্তর্জাতিক ব্যবসায়ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে?
এমন বাস্তবতায় স্টারলিংক বাণিজ্যিকভাবে আইপিএলসি (আন্তর্জাতিক প্রাইভেট লিজ সার্কিট) ব্যবহার এবং বিদেশি গ্রাহককে সেবা প্রদানের জন্য আনফিল্টারড আইপি ট্রানজিট সংযোগের অনুমতি চেয়েছে। যদিও এই সেবা তাদের লাইসেন্স ও গাইডলাইনে অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে ১৪ অক্টোবর বিটিআরসিকে একটি কারিগরি পরিকল্পনা জমা দেয় স্টারলিংক। তবে এটি নিয়ে আরও বিশদ কারিগরি ও নিয়ন্ত্রক পর্যায়ে পর্যালোচনার প্রয়োজন বলে মনে করে নিয়ন্ত্রক কমিশন।
এর আগে গত ১৩ আগস্ট, স্টারলিংখ বাণিজ্যিকভাবে আইপিএলসি সংযোগ ব্যবহার করার এবং প্রতিবেশী দেশগুলিতে বিদেশী গ্রাহকদের পরিষেবা দেওয়ার জন্য স্থানীয় অপারেটরদের কাছ থেকে আনফিল্টারড আইপি ট্রানজিট পাওয়ার অনুমতির জন্য আবেদন করেছিল।
বিটিআরসি নথি অনুসারে, এই সুবিধা পেতে স্টারলিংককে অবশ্যই দেশী এবং বিদেশী ডেটা ট্র্যাফিককে পৃথক করে এমন একটি স্পষ্ট প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। স্টারলিংক আন্তর্জাতিক প্রাইভেট লিজড সার্কিট (আইপিএলসি) সংযোগগুলি ব্যবহার করার জন্য যে আবেদন করেছে তা ডেডিকেটেড আন্তর্জাতিক ডেটা লিঙ্ক হিসেবে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশের মধ্যে সরাসরি ট্রান্সমিশনের অনুমতি। এর পাশাপাশি, স্টারলিংক স্থানীয় অপারেটরদের কাছ থেকে আনফিল্টারড আইপি ট্রানজিট অ্যাক্সেসের অনুরোধ করেছিল।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া এবং দুর্গম এলাকাকে সবসময় ইন্টারনেটে সংযুক্ত রাখতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকে বাংলাদেশের বাজার ধরার চেষ্টায় থাকা বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান স্টারলিংককে দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশে সেবা দেয়ার সুযোগ করে দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। গত ২৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সংখ্যা, কার্যক্রমসহ নানা দিক নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ৩০০তম মাসিক নিয়মিত সভায় আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে স্টারলিংকের অফিস কার্যক্রম, গ্রাহক সংখ্যা, ডেটা ট্রাফিক ও মনিটরিং ব্যবস্থা এবং দেশি-বিদেশি গ্রাহকদের সেবা প্রদানে অস্পষ্টতা ও অসংগতির বিষয় উঠে আসে।
কমিশন সভা সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ অক্টোবর স্টারলিংককে ল’ফুল ইন্টারসেপশন কমপ্লায়েন্স (এলআই কমপ্লায়েন্স) সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য জানতে চিঠি দেয় বিটিআরসি। জবাবে স্টারলিংক জানায়, লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি এনটিএমসিকে কমপ্লায়েন্স এপিআই সংক্রান্ত টুল সরবরাহ করেছে, যদিও এনটিএমসি ওই টুল পেলেও আশানুরূপভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। তবে উভয়পক্ষ এ বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা অব্যাহত রেখেছে মর্মে অবহিত করেছে।
ইন্টারনেট খাতে এলআই কমপ্লায়েন্স বলতে বোঝায়—এমন একটি প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা আইনগত অনুমতি নিয়ে কোনো ব্যবহারকারীর ইন্টারনেট যোগাযোগ বা ডেটা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এ ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো জাতীয় নিরাপত্তা, অপরাধ তদন্ত ও সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে আইনসম্মত উপায়ে তথ্য সংগ্রহের সুযোগ নিশ্চিত করা। লাইসেন্স প্রদানের সময়ে এলআই কমপ্লায়েন্সকে বাধ্যতামূলক শর্ত হিসেবে বিবেচনা করে বিটিআরসি।
এদিকে, একই তারিখে লাইসেন্সের ক্লজ-৫ অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থিত সব গ্রাহককে স্টারলিংক স্থাপিত আর্থ স্টেশন এবং দেশীয় আইআইজি অপারেটরের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা ও মনিটরিংয়ের জন্য যথোপযুক্ত টুলস সরবরাহের জন্য অনুরোধ করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্টারলিংকের পক্ষ থেকে অবহিত করা হয়, তারা বিটিআরসিকে এনটিএমসির মতো একই ‘কমপ্লায়েন্স এপিআই টুলস’ সরবরাহ করতে পারে। এনটিএমসি জানায়, ‘কমপ্লায়েন্স এপিআই টুলস’ থেকে তারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে না।
স্টারলিংকের উত্তর এবং এনটিএমসি কর্তৃক ‘কমপ্লায়েন্স এপিআই টুলস’-এর কারিগরি জটিলতা সম্পর্কে পর্যালোচনার জন্য গত ২১ অক্টোবর বিটিআরসি এবং এনটিএমসির মধ্যে মতবিনিময় সভা হয়। স্টারলিংক কর্তৃক প্রদত্ত এপিআই থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এনটিএমসি এবং কমিশন যে উদ্দেশ্যে মনিটরিং টুলস চেয়েছে, তা পূরণ হচ্ছে না মর্মে প্রতীয়মান হয়। এনটিএমসি প্রতিনিধি জানান, ‘কমপ্লায়েন্স এপিআই টুল’ থেকে তারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে না।
একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কমিশনের সভা সূত্রে জানা গেছে, স্টারলিংকের বিদেশি (রোমিং) গ্রাহকরা যখন বাংলাদেশে অবস্থান করেন, তখন তাদের ইন্টারনেট সেবা দেশের ভেতরে স্থাপিত গ্রাউন্ড স্টেশন ও পপের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে কি না—তা নিশ্চিত নয়। স্টারলিংক এ বিষয়ে এখনো স্পষ্ট তথ্য দেয়নি। তবে এ বিষয়ে স্টারলিংক থেকে স্পষ্ট উত্তর জানতে চায় বিটিআরসি।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সরকারি নথি অনুযায়ী, রফতানি করা ডেটা বাংলাদেশি গ্রাহক বা বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশিদের সেবা দেবে না তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রস্তাবিত রফতানি অবশ্যই প্রতিবেশী দেশগুলিতে স্টারলিংকের বিদেশী গ্রাহকদের সেবা দেওয়ার মধ্যে কঠোরভাবে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।
পাশাপাশি কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এসব আইপিএলসি এবং আনফিল্টারড আইপি ব্যবহারের মাধ্যমে কোনো বাংলাদেশি গ্রাহককে সরাসরি সেবা দেওয়া হবে না। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানকে কারিগরিভাবে দেখাতে হবে, কীভাবে তারা বিদেশি ও দেশীয় গ্রাহকের ডেটা আলাদা রাখবে এবং পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করবে। স্টারলিংক সার্ভিসেস বাংলাদেশ লিমিটেডকে অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্থানীয় ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আনফিল্টারড ব্যান্ডউইথ রফতানির বিষয়ে আরও ব্যাখ্যা চাওয়া হবে।
বিটিআরসি’র এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, লাইসেন্সপ্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠানের দপ্তরে কার্যক্রম না থাকলে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং করা সম্ভব হয় না। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তবে তা যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়।
এ বিষয়ে আইএসপিএবি মহাসচিব নাজমুল করিম ভূঁইয়া বলেছেন, দেশীয় উদ্যোক্তা ধ্বংসের পাশাপাশি তরুণ সমাজ বিপথগামী হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে বাংলাদেশে স্টার লিংক এর কার্যক্রমে। তাই নন-জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট অরবিট (এনজিএসও) লাইসেন্স কাঠামোতে বাণিজ্যিক আইপিএলসি ব্যবহার বা ক্রস-বর্ডার ডেটা সঞ্চালনের কোনো অনুমতি নেই। স্টারলিংককে কোনো ভাবেই এই অনুমোতি দেয়া উচিত নয়। এতে দেশীয় ইন্টারনেট ব্যবসায় শতভাগ বিদেশী নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।







