মাছ চাষে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও ভর্তুকির আহ্বান

মাছ চাষে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও ভর্তুকির আহ্বান
২৯ নভেম্বর, ২০২৫ ০০:০৭  
২৯ নভেম্বর, ২০২৫ ০৯:১১  

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া খাদ্য যেন রোগের উৎস না হয়, তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে মাছ চাষে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। একইসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত সরকারি ভর্তুকি নিয়েও নিজের আক্ষেপের কথা তুলে ধরেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, কৃষিতে আমরা প্রায়ই ভর্তুকির কথা শুনি, কিন্তু মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত তা থেকে বঞ্চিত। এই খাতেও ভর্তুকি দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এছাড়াও দেশের সামগ্রিক পুষ্টিচিত্র নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ‘গড় হিসাবের’ ওপর নির্ভরতাকে একটি বিপজ্জনক প্রবণতা হিসেবে অভিহিত করেছেন সরকারের এই উপদেষ্টা। 

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) আয়োজিত চার দিনব্যাপী ‘কৃষি ও খাদ্যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও কর্মশালার দ্বিতীয় দিন,২৮ নভেম্বর, শুক্রবার  প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমন মন্তব্য করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা।

অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও কৃষি খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

‘জাতীয় প্রাণী সম্পদ সপ্তাহ : পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রাণি ও মৎস্য খাত’ বিষয়ক সেমিনারে  একুয়াকালচারে অনিয়ন্ত্রিত ফিড ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে ভবিষ্যতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এসব বিষয়ে এখনই নিয়ন্ত্রণ জরুরি। 

দেশের সামগ্রিক পুষ্টিচিত্র নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় গড় হিসাবের ওপর নির্ভরতা একটি ‘বিপজ্জনক প্রবণতা’। ধনী মানুষের আয় দিয়ে গরিব মানুষকে বিচার করবেন না। কৃষিতে আমরা ভর্তুকির কথা শুনি। কিন্তু প্রাণি ও মৎস্য সম্পদে আমরা ভর্তুকি পাই না। এ খাতেও ভর্তুকি দরকার।

ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করে উপদেষ্টা বলেন, একুয়াকালচারে অনিয়ন্ত্রিত ফিড ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে ভবিষ্যতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এসব বিষয়ে এখনই নিয়ন্ত্রণ জরুরি। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশে যেসব প্রাণিসম্পদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সেগুলোর অনেকগুলোই আমাদের দেশে টিকে আছে। দেশি জাতের মাছ, মাংস ও প্রাণিসম্পদ বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ, যেগুলো রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি।

গ্রামীণ খাদ্যব্যবস্থার বৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে ফরিদা আখতার বলেন, উৎপাদনকারী জেলার মানুষও অনেক সময় নিজ এলাকার দেশীয় মাছ খেতে পারেন না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সুনামগঞ্জে দেশীয় মাছের স্বাদ অত্যন্ত ভালো হলেও অনেক সুনামগঞ্জবাসী এখন একোয়াকালচারের পাঙ্গাশ খেতে বাধ্য হচ্ছেন। এসব বাস্তব তথ্য সাংবাদিকদের তুলে ধরার আহ্বান জানান তিনি।

 বিএজেএফ’র সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীনের সভাপতিত্বে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফ, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর সাবেক মহাপরিচালক ড. কাজী ইমদাদুল হক, এসিআই এগ্রিবিসনেসেস প্রেসিডেন্ট ও গ্রুপ উপদেষ্টা ড. ফা হ আনসারী, আস্থা ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন চৌধুরী, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ সাজেদুল করিম সরকার। 

বিএজেএফ সাধারণ সম্পাদক আবু খালিদের সঞ্চালনায় সম্মেলনে সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা ও সুনীল অর্থনীতি নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্প পরিচালক মো. জিয়া হায়দার চৌধুরী।

বক্তব্যে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজেদুল করিম সরকার বলেন, পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) এখন পর্যন্ত ৯৭টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদনে জেনেটিক উন্নয়ন, ফডার (ঘাস চাষ) প্রযুক্তি ও আধুনিক গবেষণার ফলে দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের সক্ষমতা বহুগুণ বেড়েছে।

মাছের খাদ্য রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে আস্থা ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের উৎপাদিত ফিশ ফিড এখন আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি হচ্ছে, যা দেশের রপ্তানি খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তবে এ খাতকে টেকসই করতে ফিশ ফিডের জন্য বিশেষ রপ্তানি প্রণোদনা নীতির প্রয়োজন রয়েছে।

ভ্যালু চেইন শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়ে এসিআই এগ্রিবিজনেসের প্রেসিডেন্ট ও এসিআই লিমিটেডের গ্রুপ উপদেষ্টা ড. ফা হ আনসারী বলেন, কৃষি ভ্যালু চেইন শক্তিশালী হলে কৃষকের ওপর মধ্যস্বত্বভোগীদের চাপ কমবে এবং খাদ্যপণ্যের দামের অস্থিরতাও নিয়ন্ত্রণে আসবে। গবেষণা থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ পর্যন্ত সমন্বিত ব্যবস্থাপনার ওপর তিনি গুরুত্ব দেন।

দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা নীতির তাগিদ দিয়ে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. কাজী ইমদাদুল হক বলেন, কৃষিকে টেকসই করতে উৎপাদনের পাশাপাশি ভ্যালু চেইন শক্তিশালী করা এবং গবেষণায় দীর্ঘমেয়াদি নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষিজমি হ্রাস ও মূল্যনীতির দুর্বলতা বড় চ্যালেঞ্জ বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

বিএজেএফ'র চার দিনের এ সম্মেলনে কো-স্পন্সরশীপে রয়েছে আস্থা ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এছাড়াও সহযোগীতায় রয়েছে এসিআই এগ্রিবিজনেসেস, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, লাল তীর সিডস লিমিটেড, ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স এ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ; বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বন অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
ডিবিটেক/এফএস/ইকে