স্বপ্ন ছাপিয়ে ঠিকই উড়লেন ফরিদপুরের মারুফ

দারিদ্র্যের কারণে উচ্চমাধ্যমিক শেষে পার হতে পারেননি কলেজের চৌকাঠ। গ্রামে ফিরে করছেন এসি, ফ্রিজ মেরামতের কাজ। তাই বলে আকাশে ওড়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হতে দেননি ঠিকই। কক্সবাজারে গিয়ে প্যারাফ্রাইংয়ে গুণতে হয় হাজার তিনেক টাকা। সেখানে যেতে খরচ আরো কয়েক হাজার। তাই বাজার থেকে মাছ কিনে খাওয়ার চেয়ে নিজের জালে ধরে ইচ্ছে মতো খাবার পথে হেঁটেছেন এই তরুণ। নিজ গ্রামে ইলেক্ট্রিক মাস্টার হিসেবে পরিচিত এই অদম্যশক্তির অধিকারী তরুণের নাম মারুফ হোসেন মোল্লা (২১)।
ফরিদপুর জেলার সদরপুরের চরবিষ্ণুপুর ইউনিয়নের খেজুরতলা গ্রামের মাজহার মোল্লার ছেলে। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। তবে এই ছোট ছেলেটিই করে দেখালেন বড় কাজ। নিজেই পূরণ করলেন আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। তবে এ জন্য তাকে ব্যয় করতে হয়ে প্রায় এক বছর। সবচেয়ে কম খরচে কিভাবে আকাশে ওড়া যায় তার খোঁজ-খবর করতে শুরু করেন ইন্টারনেটে। ঘাঁটা ঘাঁটি করেন ইউটিউব। জানতে পারেন, প্যারাক্লাইডার নামে একটি জিনিস আছে যা প্যারা মটোর দিয়ে চলে। এটা বিদেশ থেকে আনতে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা লাগে। তখন নিজেই বানানোর চিন্তা করেন মারুফ। এরপর শুরু হয় গবেষণা। তারপর সত্যি সত্যি বানিয়ে ফেলেন প্যারাস্লাইডার।
যদও ২০২২ সালে এসএসসি পাস করে ঢাকার একটি কলেজে ভর্তি হলেও পরিবারের দারিদ্র্যের কারণে পড়ালেখার পাঠ ঘুচেছে মারুফের। পরিবারের দায়িত্ব নিতে শুরু করেন ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ। তারপও স্বপ্ন পূরণে দমে যাননি। জানালেন, আকাশে ওড়ার স্বপ্ন পূরণ করতে প্যারাগ্লাইডারটিতে প্যারাসুটের কাপড় হিসেবে ব্যবহার করেছেন রেইনকোরেটর কাপড়। আর ডানার নকশা ও নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করেছেন রক সুতা। আর এই কাঁচামাল দুটো ঢাকা থেকে কিনেছেন। ব্যবহার করেছেন পুরোনো বাইকের ইঞ্জিন। সব কিছু সেটআপ করে প্যারাগ্লাইডারটি বানাতে সব মিলিয়ে ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বিপরীতে নিজের তৈরি এই প্যারাগ্লাইডার দিয়ে গত প্রায় আড়াই মাসে আকাশে উড়েছেন ১০০বারের অধিক বার। উঠেছেন ৭০ থেকে ৮০ ফুট উচ্চতায়।
মারুফ বললেন, একটা সময় গ্যাস বেলুন বা ঘুড়ি দিয়ে ওড়ার চিন্তা-ভাবনা করতাম। কিন্তু ওইভাবে সফল হইনি। পরে কক্সবাজারের প্যারাসেইলিং কারার বিষয় জানতে পারি। কিন্তু তারা ৫ মিনিট উড়তে ২৫০০-৩০০০ টাকা নেয়। সেটাও আবার স্পিড বোর্ডের সাহায্যে। তখন আমি পিঠের সাথে ইঞ্জিন বেধে কোনো কিছুর সাহায্য ছাড়া ওড়ার পরিকল্পনা করি। প্রথমে আমি রিমোট কনট্রোল একটি প্যারাগ্লাইডার বানাই। ওটা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এক বছর আগে বড় প্যারাগ্লাইডার বানানো শুরু করি। এরপর পইলটিংয়ের অভিজ্ঞতা না থাকায় কয়েকদিন প্রাক্টিস করে অবশেষে ঠিক ঠাক উড়তে সক্ষম হই। তবে পরবর্তীতে এর ইঞ্জিনে কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়। ফলে আমাকে দড়ির সাহায্যে টেনে বাতাসের বিপরীতে স্লাইডিং করে উড়তে হয়। এখন দেশের পর্যটন এলাকায় পর্যটকরা যেন পাখির মতো ওপর থেকে সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন সেই কাজটা করতে চাই।
এ বিষয়ে মারুফ মোল্লা বলেন, মাত্র এক লাখ টাকায় বাণিজ্যিক ভাবে দেশেই প্যারাগ্লাইডার তৈরি করতে পারবো। তাই এখন এর নিরাপত্তার বিষয়টা জোরদার করতে হবে। তাই যদি সরকারের সহযোগিতা পাই, তবে আরও বড় প্যারাগ্লাইডার তৈরি করব এবং তা বাজারজাত করব। তাই আমি চাই সরকার বা প্রশাসন যেন আমাকে বাধা না দেয়।
খেজুরতলা গ্রামের বাসিন্দা সাজ্জাদুর রহমান (৩৮) বলেন, আমি ঢাকায় থাকি। তবে সম্প্রতি বাড়িতে গিয়ে মারুফকে প্যারাগ্লাইডিং করতে দেখেছি। বিষয়টি যদিও আলাদা আলাদা পণ্য বাজার থেকে কিনে কিনে সেটিং করেছে তবুও এটি প্রশংসা করার মতো। কারণ এটি সফলভাবে একজন মানুষকে নিয়ে আকাশে উড়তে পেরেছে।
তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি যন্ত্রটিকে যদি সুন্দরভাবে সফলভাবে বাজারে আনার উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকার নেয়, তাহলে কম টাকায় অনেক ভালো জিনিস ক্রেতারা পাবেন। পাশাপাশি দেশ ও মারুফ নিজে আর্থিকভাবে উপকৃত হবেন।
খেজুরতলা গ্রামের লোকজন জানিয়েছেন, ছোটবেলা থেকেই কিছু না কিছু তৈরি করত মারুফ। এরপর হঠাৎ দেখা গেল যে প্যারাগ্লাইডারে আকাশে উড়ছেন তিনি। এসব দেখে গ্রামের অনেকেই এখন গর্ব প্রকাশ করছেন। এছাড়া মারুফ অনেক পরিশ্রম করে এয়ারকুলার ও ইলেকট্রিক্যাল থেরাপি মেশিন তৈরি করেছেন।
ওই গ্রামের আরেক বাসিন্দা ইমরান (২৯) মিয়া বলেন, আমরা প্রথম প্রথম ওর ওই কাজ দেখে ভেবেছি সফল হবে না। তবে প্রথম যেদিন ও আকাশে উড়েছে। সেদিন আমরা অবাক হয়েছি। এ নিয়ে গ্রামের লোকজন গর্ববোধ করছে।
এ নিয়ে চরবিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমি প্রথমে মিডিয়ার মাধ্যমে মারুফের আবিষ্কার সম্পর্কে জেনেছি। মোবাইল দেখে দেখে যে ভালো জিনিস আবিষ্কার করা যায় বা ভালো কিছু করা যায় তার কাছ থেকে তরুণ প্রজন্ম শিখতে পারে। আমি তার খোঁজখবর নেব এবং সরকারিভাবে তাকে যেন তার এই আবিষ্কারের ধারা ধরে রাখতে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয় সে জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সদরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাকিয়া সুলতানা বলেন, মারুফ নিজের চেষ্টায় যেটি বানিয়েছে সেটি সত্যিই প্রশংসা করার মতো। আমি তার এই প্যারাগ্লাইডার সম্পর্কে জেনেছি। এটি দেখে আমার মনে হয়েছে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম তার থেকে শিখতে পারে এবং চেষ্টা করলে যে সফল হওয়া যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ মারুফ।
তিনি আরও বলেন, মারুফ যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে ট্রেনিং পায় সে অনেক দূরে যেতে পারে বলে আমার ধারণা। তাই মারুফ সম্পর্কে খুব দ্রুত আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানাবো।
প্রসঙ্গত, প্যারাগ্লাইডার হচ্ছে হালকা, অবাধে উড়া, পা ব্যবহার করে চালু করা একধরনের গ্লাইডার এয়ারক্রাফট। যেহেতু গ্লাইডার হচ্ছে ইঞ্জিনবিহীন বিমান, তাই প্যারাগ্লাইডারে কোনো ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয় না। ১৯৫২ সালে ডোমিনা সি. জালবার্ট বহু সেলবিশিষ্ট নিয়ন্ত্রিত গ্লাইডিং প্যারাশুট এবং পার্শ্বিক উড্ডয়নের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার উন্নয়ন করেন। এর আগে এরোফয়েল আকৃতির সেল সংযোগে প্যারাফয়েল আবিষ্কার করেন কানাডিয়ান ডোমিনা জালবার্ট। ১৯৬৩ সালের ১০ জানুয়ারি এর প্যাটেন্টন্টও নেন তিনি। প্রায় একই সময়ে ডেভিড বারিশ নাসা স্পেস ক্যাপসুল এর উন্নয়নের জন্য “সেইল উইং”(সিঙ্গেল-সারফেস উইং) এর উন্নতিকরণের কাজ করছিলেন। এমন বাস্তবতায় ১৯৫৪ সালে ফ্লাইট ম্যাগাজিন এর একটি লেখায় ওয়াল্টার নিওমার্ক ধারণা করেছিলেন, এমন একটা সময় আসবে যখন একজন গ্লাইডার পাইলট পাহাড়ের উপর হতে কিংবা ঢালের মাথা হতে গ্লাইডার নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে আকাশে উড্ডয়ন করবে।