স্টারলিংক নয়, ফ্রিল্যান্সাররা চায় রিয়েল আইপি

১৩ জুন, ২০২৫  
১৩ জুন, ২০২৫  
স্টারলিংক নয়, ফ্রিল্যান্সাররা চায়  রিয়েল আইপি

প্রযুক্তিতে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘরে বসে বৈদেশিক মুদ্রায় আয় করা এই মুক্তপেশাজীবিদের সংগঠন  বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বিএফডিএস)। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা. তানজিবা রহমানবাজেট প্রস্তাবনা পরবর্তী সমসাময়িক বেশি কিছু প্রশ্নের সাবলীল জবাব দিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ডিজিবাংলাটেকডটনিউজ নির্বাহী সম্পাদক এস এম ইমদাদুল হক


ডিবিটেকঃ প্রথমেই আসছে বাজেটে ফ্রিল্যান্সারদের আশা-নিরাশার বিষয়টা একটু বলুন?

তানজিবাঃ বাজেটে সবচেয়ে আশার বিষয় হলো-ফ্রিল্যান্সাররা ইনসেন্টিভ পাবে। কিন্তু এ বছরেরও সে জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষেত্রে দেশে লিগ্যাল পথে টাকা আনার ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ ইনসেন্টিভ দেয়ার কথা থাকলেও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এটা বাস্তবায়িত হলে ফ্রিল্যান্সাররা সিংহভাগ টাকা লিগ্যাল চ্যানেলে দেশে নিয়ে আসতো। এখন পর্যন্ত এক্সচেঞ্জ লস বা সোর্স ট্যাক্সের ওপর সরকার কোনো পরিপত্র জারি করেনি। ফলে অনেক ব্যংক এখনো এনবিআর এর মতো সোর্স ট্যাক্স কেটে নিচ্ছে। অনেক ব্যাংক ফ্রিল্যান্সারদের হয়রানি করছে। কাগজপত্র নিয়ে হয়রানি করছে

ডিবিটেকঃ তাহলে তো বাজে্ট ফ্রিল্যান্সার বান্ধব নয়!

তানজিবাঃ নতুন অগ্রগতির কথা চিন্তা করলে আসলে বাজেটটি আইসিটি বান্ধব নয়

ডিবিটেকঃ এবার বহুল আলোচিত স্টারলিংক বিষয়ে জানতে চাই। এটি ফ্রিল্যান্সিংয়ে কতটা প্রভাব ফেলবে?

তানজিবাঃ যে সকল ফ্রিল্যান্সার অলরেডি অন্টারপ্রেনিউর হয়ে গেছে তাদের জন্য ভালো অপারচুনিটি হলেও এটা সাধারণ ফ্রিল্যান্সারদের খুব একটা সুবিধা দেবে না। এটা দেশের মাত্র ৫ শতাংশ ফ্রিল্যান্সার ব্যবহার করতে পারবে। তাই আমরা চাই., শেয়ারড আইপি না দিয়ে আমাদের যেন রিয়েল আইপি দেয়া হয়। তবেই আমরা ভালো ইন্টারনেট সেবা পাবো। ভালো ভাবে ফ্রিল্যান্সিং করতে পারবো।  

ডিবিটেকঃ চারদিকে এখন এআই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।  বাংলাদেশের ফ্লিল্যান্সাররা এক্ষেত্রে কেমন করছে?

তানজিবাঃ এআই নিয়ে কাজ করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সফলতার হার কাঙিক্ষত পর্যায়ে নেই। ফলে দেশের বেসিক লেভেলের এআই ফ্রিল্যান্সাররা এখন সাফার করছে। কেননা, যারা আগে বেসিক লেভেলের ডিজাইন করতো ক্যানভাতে এখন সে সকল ডিজাইন অ্যাড হয়ে গেছে। এজন্য তাই আলাদা করে ফ্রিল্যান্সার হায়ার করার দরকার নেই। একই অবস্থা ওয়েব ডেপলপমেন্টের ক্ষেত্রে। বেসিক অ্যাপ যারা বানায় তাদের কাজও নেই বললেই চলে। এসব ক্ষেত্রে আগের চেয়ে ২০ শতাংশ কাজ কমে গেছে। 

ডিবিটেকঃ তাহলে এখন মোট ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা কি কমে গেলো?

তানজিবাঃ না, বাংলাদেশে মোট ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা এখন ১০ লাখের মতো। কারণ প্রতি বছরই এখানে নতুন এক লাখ ফ্রিল্যান্সার যুক্ত হয়। আবার পুরোনো এক লাখের মতো ঝড়ে যায়। 

ডিবিটেকঃ ফ্রিল্যান্সারদের এআই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আগাম দক্ষতা উন্নয়নে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বিএফডিএস) কী করছে?

তানজিবাঃ বিএফডিএস বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাজুয়েশন ভিত্তিক ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য অ্যাডভান্সড লেভেলের কোর্স করছে। ন্যাশনাল ও পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ করাচ্ছে। সব শেষ গত বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন তিনটি কলেজে কর্মশালা করিয়েছি। গ্রিন ইউনিভার্সিটি, নর্থসাউথ ও ইউআইইউ-এ কর্মশালা থেকে যে ফিডব্যাক পেয়েছি, তাতে দেখেছি, গ্র্যাজ্যুয়েট অরিয়েন্টড ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফলতা বাড়ছে। এই যেমন- কেউ যদি অ্যাকাউন্টিংয়ের শিক্ষার্থী হয় তবে সে সেই ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সিংয়ে ভালো করছে। 

ডিবিটেকঃ সামনে বিপিও সম্মেলন। এই সম্মেলনগুলো ফ্রিল্যান্সারদের কতটা এনহেন্স করবে?

তানজিবাঃ কিছুটা অ্যাওয়ারনেস বাড়বে, এটা তো স্বাভাবিক। 

ডিবিটেকঃ বাংলাদেশের বেকার তরুণদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং একটা আশার আলো হিসেবে দেখা হয়। কেক্ষেত্রে এর এর ভবিষ্যত কি?

তানজিবাঃ বেকার তরুণ নয়- যে নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে; যারা গ্র্যাজুয়েশন করেছে; আগে গ্র্যাজুয়েশন করেছে, তাদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং এর ভবিষ্যত অনেক উন্নত। কারণ, আপনি যদি এখন থেকে টেক ওরিয়েন্টেড না হন, আগামী ৫ বছরে কিন্তু অনেকেই আমরা তার জব ও ব্যবসা থেকে পড়ে যাবো। অলরেডি সফটওয়্যার খাতে বিশাল ফল হয়েছে। সেই জায়গা থেকে চিন্তা করলে বাকি খাতগুলো যেমন- ব্যাংকিং সিকিউরিটি, এল লগারিদম, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কিংবা বড় ধরনের এআই ভিত্তিক কাজগুলো আসতে শুরু করবে তখন আপ টু ডেট না থাকলে যে কেউ হুমকীতে পড়বে। দক্ষতা অর্জন করতে না পারলে আগামী প্রজন্ম হুমকীর মুখে পড়বে।

ডিবিটেকঃ দেশের ফ্রিল্যান্সিং উন্মাদনায় কি এখন ভাটা পড়ছে?

তানজিবাঃ ফ্রিল্যান্সিংয়ে ভাটা পড়েনি। যেটাতে পড়েছে, সেটা হলো- যে ধরনের কর্ম আগে খুব সহজে পাওয়া যেতো, কম পয়সায় বাংলাদেশীরা সেগুলো করে দিতো। এআই এবং আধুনিক প্রযুক্তির কারণে বর্তমান সময়ে যে কাজ দেয়া হচ্ছে তাতে আগে তৈরি করা ফ্রিল্যান্সাররা তেমন একটা কাজ পাচ্ছে না। যার কারণে ফ্রিল্যান্সিংয়ে ভাটা পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। 

ডিবিটেকঃ বিভিন্ন মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সারদের লাখপতি-কোটিপতি হওয়ার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। অনেক গল্পও ছাপা হচ্ছেএর অর্থ ফ্রিল্যান্সিং বর্তমানে জীবিকার সবচেয়ে নিরাপদ একটি মাধ্যম। 

তানজিবাঃ যে ভাবে ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিষয়টি প্রচার করা হয়, সেটা ঠিক না। যারা নিশ চুজ করে দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের দক্ষতা আপগ্রেডেশনের মধ্যমে চলছেন তারা স্টিল নাও কাজ পাচ্ছেন। আর লাখপতি-কোটিপতি হওয়াটা একটা রেগুলার ইস্যু। কেননা তারা রেমিটেন্স ইনকাম করেন। তাই তারা কম কাজ করেও মাস ও বছর শেষে কোটিপতি হতে পারেন। তবে সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার চেয়ে নিরাপদ ফ্রিল্যান্সিং ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। যারা এখন ফ্রিল্যান্সিং করছে তাদের মধ্যে সাসটেইনেবল ক্যারিয়ার গ্রাফ তৈরি করতে হবে। প্রতিবছর এক থেকে দেড় লাখ নতুন ফ্রিল্যান্সার মার্কেটে ঢুকছে। ইথিক্যাল প্রাক্টিসের কারণে কিন্তু প্রায় ২০-৩০ হাজার ফ্রিল্যান্সার ঝড়ে যায়। প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে আরো ৩০ শতাংশ ঝড়ে পড়ে। বাকি ফ্রিল্যান্সাররা ঝড়ে যায় কাজ না পাওয়ায়। কাজ পেতে হলে আপ টু ডেট স্কিলিং ট্রেনিং করাতে হবে। আমরা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যে ধরনের ট্রেনিং দিয়ে আসছি তা খুবই বেসিক পর্যায়ের। এগুলোর কাজ এখন ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটে নাই। 

ডিবিটেকঃ এই অবস্থাকে টেকসই করতে আমাদের করণীয় কি বলে মনে করেন?

তানজিবাঃ রেগুলার স্কিল আপগ্রেডেশন, ইন্টারন্যাশনাল মেন্টরশিপ হায়ার করার প্লাটফর্ম এবং সাথে ইনসেন্টিভ ও পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে শুরু করে সোর্স ট্যাক্স এবং বাকি প্রমোশন ব্র্যান্ডিংয়ের খরচ কমানোর বিভিন্ন খাত যদি নির্দিষ্ট করে তৈরি করা যায়, তবে বাংলাদেশেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের ফ্যাক্টরি তৈরি সম্ভব। আমরা এখনো কন্টেন্ট রাইটিংয়ে হিউজ মার্কেট ধরতে পারিনি। বিশ্বের ২৫৩টি মার্কেট প্লেসে ১০২৩ রকমের ফ্রিল্যান্সিং আছে। যেগুলো হাইলি পেইড সেগুলো এখনো আমরা ধরতে পারিনি। সেজন্য ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং চালু করা দরকার। কেননা টেকসই করতে ফ্রিল্যান্সিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিদেশীরা যত দিন যাচ্ছে ট্যাক্স থেকে সরে আসার জন্য তারা তত বেশি ফ্রিলান্সারদের দিয়ে বেশি কাজ করাচ্ছে। 

ডিবিটেকঃ বলা হচ্ছে, ফ্রিল্যান্সিং কেরানি বানাচ্ছে, উদ্ভাবনায় পিছিয়ে দিচ্ছে...

তানজিবাঃ ফিল্যান্সিং কখনো কেরানি বাানায় না। এরা কখনো কারো চাকরি করে না। কারো নির্দিষ্ট টাইম টেবিলে বাধা থাকে না। সে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা নিয়ে কাজ করে। সেটা হওয়ার জন্য অনেক সাধনা দরকার। তাই প্রত্যেক ফ্রিল্যান্সারকে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কিন্তু যে ধরনের ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে, সে ধরনের ব্র্যান্ডিং কিন্তু ঠিক না। ফ্রিল্যান্সাররা চাকরিজীবি তৈরি করে। আর উদ্ভাবনার মাধ্যমে রেমিটেন্স আসতেও পারে, নাও পারে। কিন্তু ফ্রিল্যান্সাররা ঠিকই  রেমিটেন্স আনবে। দিস ওয়ান ইজ মাস্ট। 

ডিবিটেকঃ কিন্তু প্রযুক্তি তো শৈল্পিকতা দখল করছে নতুন অ্যাপ, চিঠি লেখার মতো চিন্তা করার ক্ষমতাও হারাচ্ছে

তানজিবাঃ আপনি দেখবেন, এআই দিয়ে কোনো কনটেন্ট করা হলেও সেটাতে কিন্তু হিম্যনওয়েড টাচ দিতে হয়। হিম্যনওয়েড শৈল্পিকতার চাহিদা এখন পর্যন্ত ক্লায়েন্টদের মধ্যে আছে। শৈল্পিকতা ছোঁয়া সারা জীবনই থাকবে। সেটা ইউনিক। ইউনিক জিনিসের মূল্য সবসময় বেশি

ডিবিটেকঃ বাংলাদেশে এখন কোন ধরনের ফ্রিল্যান্সিং বেশি হচ্ছে? পরিমাণ কেমন? সামনে সবচেয়ে বেশি চাহিদা হবে কোন বিষয়ে?

তানজিবাঃ এআই বেইজড ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির কাজে সামনে বেশি চাহিদা তৈরি হচ্ছে। এআই আসার কারণে ফ্রন্ট এন্ডের কাজ সহজ হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ব্যাক এন্ডের কাজ। ব্যাক এন্ডে কমান্ড দেয়ার দক্ষতা তাই এখন বেশি দরকার।

ডিবিটেকঃ টেকিনিক্যাল স্কিল ও সফট স্কিল নিয়ে আমাদের ফ্রিল্যান্সারদের অবস্থান কোন পর্যায়ে রয়েছে?

তানজিবাঃ এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান খুব একটা ভালো না

ডিবিটেকঃ ফ্রিল্যান্সিং থেকে সবশেষ বাংলাদেশের আয় কত?

তানজিবাঃ গত বছরে আমাদের ফ্রিল্যান্সাররা ১.৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে

ডিবিটেকঃ জুলাই অভ্যুত্থানে  ক্ষতিগ্রস্ত ফ্রিল্যান্সাররা কি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে? ফ্রিল্যন্সিং এর বৈশ্বিক বাংলাদেশের ভাব মর্যাদা এখন কোন পর্যায়ে আছে? আমাদের অবস্থান এখন কোন ধাপে রয়েছে?

তানজিবাঃ কেউ ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে। কিন্তু কিছু কিছু ফ্রিল্যান্সার এখন কাজের অভাবে ভূগছে। আর যেহেতু রিভিউগুলো পড়ে গিয়েছে, সেহেতু কাজ পেতেও কষ্ট হচ্ছে। বৈশ্বিক অবস্থানে সংখ্যার দিক দিয়ে আমরা অনেক এগিয়ে আছি। কিন্তু কোয়ালিটির দিক দিয়ে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। দক্ষতা, সংখ্যা ও আয়ের ভিত্তিতে র‌্যাংকিং না হওয়ায় এটা বলা যাচ্ছে না। 

ডিবিটেকঃ ছুটির মধ্যেও সময় করে প্রশ্নের উত্তর দেয়ায় আপনাকে ধনব্যাদ

তানজিবাঃ আপনাকে এবং ডিজিবাংলা’র পাঠককে ঈদের শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।