প্রযুক্তি ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে

২৪ অক্টোবর, ২০২৫ ১৪:৪৭  
প্রযুক্তি ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে

আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নতুন প্রজন্মকে উপযোগী করে গড়ে তুলতে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তবে এক্ষেত্রে প্রযুক্তি শিক্ষণ নয়, শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির নৈতিক প্রয়োগ শেখানোর উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। এজন্য সমন্বয় করতে হবে প্রযুক্তি ও মূল্যবোধের মধ্যে। শিক্ষা বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদদের এ সংক্রান্ত রূপরেখা প্রণয়নে নেতৃত্ব দিতে হবে।

২৪ অক্টোবর, শুক্রবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) এক অনুষ্ঠানে এমন তাগিদ দিয়েছেন বক্তারা। শিক্ষা অধিকার সংসদ আয়োজিত ‘ইয়াং এডুকেটরস সামিট-২০২৫’ এর ‘রিইম্যাজিনিং এডুকেশন ইন বাংলাদেশ টু পয়েন্ট জিরো: ভিশন টুয়েন্টি থার্টি অ্যান্ড বিয়ন্ড’ শীর্ষক মূল অধিবেশনে দেয়া বক্তব্যে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন ডিজিটাল পাঠ্যক্রম, ই-লার্নিং, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রাধিকার দেয়া এবং ছাত্রদের মধ্যে প্রযুক্তি ভীতি কাটিয়ে তুলতে পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেন তারা। সারাদেশ থেকে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।

শিক্ষা অধিকার সংসদের আহ্বায়ক ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা-গবেষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মো. নিয়াজ আসাদুল্লাহর সভাপতিত্বে মূল অধিবেশনে অতিথি হিসেবে ছিলেন মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব খ ম কবিরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম, একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. নুরে আলম সিদ্দিকী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রাজ্জাক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মো. জুলফিকার হায়দার এবং জাতীয় পাঠ্যক্রম সমন্বয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. সুলতানা রাজিয়া।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে খ ম কবিরুল ইসলাম বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পুনরায় ঢেলে সাজাতে মূল্যবোধ ও প্রযুক্তির সমন্বয়ের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, শিশুরা এখন স্কুলে যাচ্ছে না। উদ্বেগজনক হচ্ছে তারা কওমি মাদ্রাসায় যাচ্ছে। উদ্বেগের কারণ এই যে, কওমি মাদ্রাসায় তো চাকরি নেই। তাহলে অভিভাবকরা পাঠাচ্ছেন কেন? কারণ তারা মনে করছেন, স্কুলে তাদের বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটছে না। এজন্য মূল্যবোধ এবং প্রযুক্তির সমন্বয় প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারে সতর্কতার প্রয়োজনীয়তাও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। বলেন, কোন বয়সে কোন প্রযুক্তি শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে, তা আমাদের ভাবতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ায় সম্প্রতি একটি নীতি গ্রহণ করেছে যে ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের অনেক ডিভাইস তারা দেবে না। অস্ট্রেলিয়াতে এক গবেষক আমাকে বলেছিলেন, অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে শিশুদের যোগাযোগ দক্ষতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং শিক্ষক ও অভিভাবকদের নির্লিপ্ততা ও অবহেলার কারণে শিক্ষা ব্যবস্থা ধসে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমরা চাকরি করি সবাই, আমাদের ভিতরে কোনো মোটিভেশন নাই। একইসঙ্গে ভোগবাদিতায় লিপ্ত হয়ে গেছি। অভিভাবকদের কাছে জ্ঞান অর্জনের চেয়ে জিপিএ ৫ মুখ্য হয়ে গেছে। এ ছাড়া গত ১৫ বছরে শিক্ষা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যতটুকু বেঁচে আছে, তা ইনস্টিটিউশনাল না; ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু ক্ষেত্রে বেঁচে আছে। অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থার সমস্ত অংশীজনের মধ্যে আমি শিক্ষার্থীদের দোষ কম দেব।

শিক্ষকদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে কবিরুল ইসলাম বলেন, সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া ছাত্রকে টার্গেট করে ক্লাস নিন, ভালো ছাত্ররা ধীরে ধীরে শিখে যাবে।

শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে আধুনিকীকরণের পদক্ষেপ নিতে হবে উল্লেখ করে ঢাবির আইইআরের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম বলেন, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন ডিজিটাল পাঠ্যক্রম, ই-লার্নিং, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রাধিকার। গ্রাম ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তিগত শিক্ষা অনেক সীমিত। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৈষম্য, প্রযুক্তি সংকট এবং শিক্ষকদের দক্ষতার অভাব। এ সংকটগুলো দূর করতে পারলে অগ্রগতি হবে।

অধিবেশনে বক্তৃতাকালে বিগত ১৫ বছরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাগজে-কলমে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লেও বাস্তবতা ভিন্ন বলে মন্তব্য করেছেন বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রাজ্জাক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে জেলা-উপজেলায় স্কুলগুলোতে আমরা ল্যাব স্থাপন করতে পেরেছি। কিন্তু কাগজে–কলমে থাকলেও এসব ল্যাবের যথাযথ ব্যবহার হয় কিনা, এটি প্রশ্নসাপেক্ষ। আমি নিজেও একটি স্কুলের সঙ্গে আছি, যেখানে ল্যাব শোপিস মাত্র, ব্যবহারের সুযোগ নেই। বরং ছাত্ররা প্রযুক্তিভীতি কাটিয়ে উঠতে পারলেও শিক্ষকরা পেরেছেন বলে মনে হয় না। তাদের অনেক ট্রেনিংয়ের দরকার আছে।

অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে নায়েমের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মো. জুলফিকার হায়দার বলেন, এখন প্রায় প্রতি তিন দিনে একটি নতুন জ্ঞান তৈরি হচ্ছে। অথচ আমরা কেবল ভৌত অবকাঠামোর দিক থেকে প্রযুক্তিকে দেখছি, কিন্তু এভাবে আসলে প্রযুক্তি-শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি না। আমার ক্লাসে যখন এআই থাকবে, বা হাইটেক ক্লাসরুম থাকবে, তখন আমাদের পদ্ধতি পরিবর্তন হবে। এ ছাড়া টিচার্স ট্রেনিংয়ে যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, সেটি ফেইস টু ফেইস ক্লাসের উপযোগী। এ থেকে উত্তরণের পথগুলো খুঁজতে হবে আমাদের। এইটা আমাদের সাহায্য করবে না। টেকনিক্যালি এবং ক্যাপাসিটির জায়গায় নিতে হবে শিক্ষক ও প্রশিক্ষক উভয়কেই। তবে আমরা মূল্যবোধ এবং প্রযুক্তির কথা বলছি। এখানে একটা কনফ্লিক্ট (দ্বন্দ্ব) আছে। এটিকে কলাবরেশনে পরিণত করতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহার করেও তো মূল্যবোধকে প্রমোট করা যেতে পারে। এটি সরকারের দিক থেকেও রিয়ালাইজেশন এসেছে। কিছু কাজ হচ্ছে। তবে শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের সবাইকে মিলে একটা রূপরেখা দাঁড় করাতে হবে।

অবিলম্বে কারিকুলামের সংশোধন ও সংযোজনের তাগিদ দিয়ে ঢাবির আইই‌আরের সহকারী অধ্যাপক ড. নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং প্রযুক্তি শিক্ষা কারিকুলামে যুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া প্রবলেম–বেইজড লার্নিংকে প্রমোট করতে হবে। এটিকে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে হবে। তাহলে শিক্ষার্থীরা আসবে। এর সঙ্গে বেসিক সাবজেক্ট বাদ দেওয়া যাবে না। বেসিক সাবজেক্টের সঙ্গেই প্রযুক্তি ও এআই যুক্ত করতে হবে। একই সাথে তারা নৈতিকভাবে বা দক্ষতার সঙ্গে প্রযুক্তি কিভাবে ব্যবহার করবে, সেটা শেখাতে হবে। শিক্ষণে প্যারাডাইম শিফট এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।