৭ ঘণ্টা পর মতিঝিল–শাহবাগ রুটে মেট্রোরেল চালু
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড পড়ে একজন নিহত হওয়ার ঘটনায় সাত ঘণ্টা চলাচল বন্ধ থাকার পর সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে শাহবাগ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল পুনরায় শুরু হয়েছে।
২৬ অক্টোবর, রবিবার মেট্রোরেল সেবা চালু সংক্রান্ত তথ্য জানিয়ে মেট্রোরেলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এরআগে দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বেলা ৩টার দিকে আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত রুটে মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়।
পোস্টে জানানো হয়েছে, মেট্রোরেলের যাত্রী সাধারণের জন্য জানানো যাচ্ছে, বিকেল ৩টা থেকে উত্তরা–আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল সেবা চালু করা হয়েছে। মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মেট্রোরেল সেবা সোয়া ৭টার দিকে পুনরায় শুরু হয়েছে।
এদিকে মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে পথচারী নিহতের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ।
কমিটিতে কারিগরি ও প্রকৌশলগত পর্যালোচনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং সামরিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট (এমআইএসটি)-এর বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন—বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম তৌফিক হাসান, এমআইএসটি-এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জাহিদুল ইসলাম এবং ডিএমটিসিএল-এর লাইন-৫ প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব। উপসচিব আসফিয়া সুলতানা কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।
কমিটি গত ১৮ সেপ্টেম্বর সংঘটিত পূর্ববর্তী দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধকল্পে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা প্রস্তুত এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করাও কমিটির কাজের অন্তর্ভুক্ত।
কমিটিকে আগামী ২ (দুই) সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পেশ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পরপরই সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজসহ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং ডিএমটিসিএলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
অপরদিকে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে নিহত আবুল কালামের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সড়ক ও রেল উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি আরও বলেন, নিহতের পরিবারে কর্মক্ষম কোনো ব্যক্তি থাকলে তাকে মেট্রোরেলে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। দুর্ঘটনাস্থল ফার্মগেট স্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এ তথ্য জানান।
এর আগে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট মেট্রো স্টেশন সংলগ্ন বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সামনে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে আবুল কালাম নামে এক যুবকের ওপর। ৫০ কেজি ওজনের একটি বিয়ারিং প্যাড উপর থেকে পড়ে তাকে থেঁতলে দেয়। ঘটনাস্থলেই নিহত হন। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশরপাটি গ্রামের ছেলে আবুল কালাম। দুর্ঘটনার সময় আবুল কালামের পকেটে থাকা পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল ২০৩৩ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ২০২৫ সালের ২৬ অক্টোবরেই নিভে গেল তার জীবনপ্রদীপ।
কিন্তু এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার আগের রাতে আবুল কালামের ফেসবুক পোস্টটি ইতোমধ্যেই ভাইরাল হয়ে গেছে। শনিবার (২৫ অক্টোবর) রাতে তিনি লিখেছিলেন, ‘ইচ্ছে তো অনেক। আপাতত যদি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে পারতাম।’ পরবর্তী দিন দুপুরে এই পোস্টের সত্যিকারের তাৎপর্য প্রকাশ পেল— দুর্ভাগ্যবশত জীবন আর তাকে ধৈর্য ধরতে দেয়নি।
তারেক আজিজ নামের একজন বন্ধু ও সহকর্মী পোস্টটি শেয়ার করে লিখেছেন, সি এম আজাদ আবুল কালাম ভাইয়ের ফেসবুকের শেষ পোস্ট। আজকে মেট্রো রেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে তিনি নিহত হয়েছেন। কিছু মৃত্যু মেনে নিতে খুবই কষ্ট হয়।
ফার্মগেট এলাকায় স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই ধরনের যন্ত্রাংশের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। কেউ যেন আর এমন দুর্ঘটনার শিকার না হন।
দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো আবুল কালাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে শুরু করেন জীবনসংগ্রাম। সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে ২০১২ সালে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান তিনি। সেখান থেকে ফিরে ২০১৮ সালে পাশের গ্রামের আইরিন আক্তারকে বিয়ে করেন। নারায়ণগঞ্জের জলকাঠি এলাকায় ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন। ছেলে আব্দুল্লাহর বয়স ৫ বছর, আর মেয়ে সুরাইয়া আক্তারের বয়স ৩ বছর। ঢাকায় একটি ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনা করতেন। তার ব্যস্ত ব্যবসায়িক জীবনের কারণে ফার্মগেট এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন।
প্রসঙ্গত, ঘাতক মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড বা কম্পন নিয়ন্ত্রণ স্প্রিং মূলত ট্রেন চলাচলের সময় লাইনের কম্পন শোষণ করে কাঠামোর স্থিতি বজায় রাখে। এসব যন্ত্রাংশের বোল্ট সংযোগ মাসিকভাবে পরীক্ষা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সেই নিয়মটি ঠিকঠাক মানা হয়নি। দীর্ঘদিনের কম্পনের কারণে স্প্রিংটি আলগা হয়ে পড়ে।







