‘চিকিৎসা শিক্ষায় ইসলামী নীতিমালা সংযোজনই টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থার পথ’

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় ইসলামী নীতিমালা সংযোজনই হতে পারে মানবতার জন্য একটি নৈতিক ও টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থার পথ। ইসলামী চিকিৎসা শিক্ষা বিজ্ঞানের সাথে মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটায়। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি চিকিৎসককে এমনভাবে গড়ে তোলা হয়, যাতে সে কেবল রোগ নয়, সমাজ ও নৈতিকতার সুস্থতাকেও গুরুত্ব দেয়। আর তাওহিদ হল ইসলামী চিকিৎসা জ্ঞানের ভিত্তি; যা মানুষ, সমাজ ও চিকিৎসাকে এক সূত্রে গেঁথে দেয়।
বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএমইউ)- তে “ইভোলিউশন অব ইসলামিক মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড এথিকাল প্র্যাকটিস” শীর্ষক সেমিনারে কীনোট স্পিকার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ও ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (আইআইআইটি) এর সেক্রেটারি জেনারেল প্রফেসর ড. ওমর হাসান কাসুলি এসব কথা বলেন।
স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ-এর লেকচার হলে শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, অনুষ্ঠিত সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. শাহিনুল আলম। বক্তব্য রাখেন প্রো ভাইস চ্যান্সেলর (গবেষণা ও উন্নয়ন) প্রফেসর ড. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, প্রো ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. আবুল কালাম আজাদ, বিআইআইটি'র সিনিয়র একাডেমিক ফেলো প্রফেসর ড. আবু খলদুন আল-মাহমুদ এবং বিএমইউ'র ট্রেজারার প্রফেসর ড. নাহরিন আখতার। সেমিনারে প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষকমণ্ডলী, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
প্রফেসর ড. ওমর হাসান কাসুলি ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক চিকিৎসা শিক্ষার বিকাশ, নৈতিক চর্চার ঐতিহাসিক বিবর্তন, নীতি অনুশীলনের গুরুত্ব, ইসলামী দর্শনের আলোকে পেশাগত দায়িত্ববোধ, চিকিৎসা পেশায় আধ্যাত্মিক চেতনার ভূমিকা, মেডিসিনের ইসলামীকরণ এবং চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কের মানবিক দিকগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চিকিৎসা শিক্ষায় ইসলামী জ্ঞান, নৈতিকতা, ইসলামী মূল্যবোধ সংযোজন অত্যন্ত সময়োপযোগী; যা চিকিৎসা পেশাকে আরও মানবিক ও দায়িত্বশীল করে তুলবে। চিকিৎসকদের নৈতিক চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ চিকিৎসা পেশাকে আরও অর্থবহ করে তোলবে। এজন্য ভবিষ্যতে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ইসলামি শরিআহ'র পাঁচটি মূল লক্ষ্যের আলোকে ইসলামের নীতি বিদ্যা। লক্ষ্যগুলো হচ্ছে: দীন বা ধর্ম, জীবন বা প্রাণ, বংশধর, বুদ্ধিমত্তা/আকল এবং সম্পদের সংরক্ষণ। একজন চিকিৎসককে সকল কাজ ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য কিনা তা ওই পাঁচটি লক্ষ্য পূরণ সাপেক্ষে বিবেচনা করতে হবে। এ পাঁচটি লক্ষ্য অর্জনে চিকিৎসকের কর্মপদ্ধতি আবার পাঁচটি প্রায়োগিক পূর্বশর্ত পূরণ করতে হবে। এ পাঁচটি পূর্বশর্ত হচ্ছে কাসদ (উদ্দেশ্য), সফলতা সম্পর্কে ইয়াকিন (সন্দেহাতীত নিশ্চিন্ততা), দারার বা সম্ভাব্য ক্ষতি বিবেচনা, মাশাক্বাত বা অভাব বা কষ্টকর পরিস্থিতি বিবেচনা, উরফ বা একই কাজের পূর্ব চর্চার নজির। বস্তুত: মাকাসিদ আল শরিআহ এবং কাওয়ায়িদ আল শরিআহ'র নির্দেশনায় ইসলামের নীতিবিদ্যা বা এথিক্স ইউরোপীয় এথিক্স-এর চেয়ে আরও বিস্তৃত এবং এর ভিত্তি অনেক দৃঢ় ৷
তিনি বলেন, ইসলাম আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে জীবন ও জ্ঞানের সব ক্ষেত্রকে পরিচালিত করে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে চিকিৎসাবিদ্যারও ইসলামায়ন অপরিহার্য। ইসলামিক মেডিসিন বা চিকিৎসা সার্বজনীন নৈতিক মূল্যবোধভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, যা কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৯৬০–৭০-এর দশকে ইসলামিক মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনগুলোর মাধ্যমে মুসলিম চিকিৎসকদের মধ্যে একটি নতুন চেতনার সূচনা ঘটে, যা ১৯৯৫ সালে মালয়েশিয়ায় “ইসলামিক মেডিসিন” ধারণাকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ইসলামিক হাসপাতাল ও শারিয়াহ-সম্মত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেগুলো ইবাদত-বান্ধব পরিবেশ, আধ্যাত্মিক স্বাচ্ছন্দ্য এবং নৈতিক চিকিৎসা অনুশীলন নিশ্চিত করছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় এসব হাসপাতাল সরকারিভাবে শারিয়াহ-কমপ্লায়েন্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। চিকিৎসা-নৈতিকতার নতুন জটিল বিষয়- যেমন অঙ্গ প্রতিস্থাপন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা জীবনরক্ষাকারী প্রযুক্তি-শুধু প্রচলিত ফিকহ দ্বারা সমাধান সম্ভব নয়; বরং “মাকাসিদ আল-শারিয়াহ” বা ইসলামী উদ্দেশ্য-তত্ত্বের আলোকে নতুন ইজতিহাদ প্রয়োজন।”