মঙ্গলে উপনিবেশ গড়ার স্বপ্ন বুনছে আবির-মিশাল

৯ জুন, ২০২৫  
৯ জুন, ২০২৫  
মঙ্গলে উপনিবেশ গড়ার স্বপ্ন বুনছে আবির-মিশাল

মঙ্গলে উপনিবেশ গড়ার স্বপ্ন বুনছে মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আবির খান এবং সরকারি বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আলী মিশাল। সেই লক্ষে প্রথমে সেখানে গবেষকদের বসবাস উপযোগী একটি ক্যারাভান তৈরি করেছে তারা। মঙ্গলের প্রকৃতি, শক্তি, রসায়ন ও বসবাসযোগ্যতার প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে দিতে দুজন মিলে গড়ে তোলেন টিম অ্যাসট্রাল হরিজনস। বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানভিত্তিক মহাকাশ গবেষণা প্রকল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে তাদের আউটার স্পেস হ্যাবিটেশন (OSH) প্রকল্পএই অনন্য উদ্যোগের জন্য তারা পেয়েছেন ৫০টিরও বেশি জাতীয় পুরস্কার এবং ৫টির বেশি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এর মধ্যে রয়েছে- আস্ট্রোনোমিক্যাল সোসাইটি অফ ভিক্টোরিয়া এক্সপ্লোর মার্স ইনক, মার্স ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ, স্পেস ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ সম্মাননা। OSH এখন শুধুমাত্র একটি গবেষণা প্রকল্প নয়—এটি বাংলাদেশি তরুণদের বিশ্ববিজয়ের অঙ্গীকার, উদ্ভাবনের সাহস এবং আত্মনির্ভরতার প্রতীক।

এই নিশানাকে আরো উড্ডিন করতে আমরা প্রতিনিয়ত এতে নতুন নতুন ফিচার যুক্ত করছি—যেমন পোর্টেবল এনভায়রনমেন্টাল স্যুট, মোবাইল ফার্মিং ইউনিট, রিসাইক্লিং পডস, মাল্টিলেয়ার এনালাইটিক স্ক্যানার, কৃত্রিম হালকা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং ক্লাইমেট রেগুলেশন চিপ, যাতে মঙ্গলে গবেষণার সময় গবেষকরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা, স্থিতি ও ফলপ্রসূতা পেতে পারেন।  এই প্রকল্পের মাধ্যমে তারা শুধু মঙ্গল নয়, পৃথিবীর জন্যও সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে চাজানতে চান—প্রাণ কীভাবে শুরু হলো? মানুষ কীভাবে এতটা বুদ্ধিমান হলো? আর ভবিষ্যতে আমাদের বিকল্প বাসস্থান কোথায় হবে?


ঈদের ছুটিতে ডিজিবাংলাটেকডট নিউজ এর নির্বাহী সম্পাদক এস এম ইমদাদুল হক-কে লাল-সবুজের বদ্বীপ থেকে মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন ও সাহসের গল্প শোনালেন আবির মিশাল।  


প্রশ্নঃ শুরুতেই জানতে চাই, ঈদ কেমন কাটালে। কী করলে ঈদের ছুটিতে? 

আবিরঃ ঈদ এর ছুটিতে আমরা আমাদের এআই এবং ডিজিটাল সিস্টেম নিয়ে আরও কাজ করেছি এবং বর্তমানে এআই কে আরও ট্রেইন করার চেষ্টা করছি, যাতে সিস্টেমের কার্যকারিতা আরও উন্নত হতে পারে। পাশাপাশি, আমরা WICE গ্লোবাল রাউন্ড এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, যাতে বাংলাদেশের জন্য একটি ভালো স্বীকৃতি নিয়ে আসতে পারি এবং বিশ্বমঞ্চ থেকে আমাদের দেশের সম্মান বৃদ্ধি করতে। 

প্রশ্নঃ ডব্লিউআইসিই কবে, কোথায় হবে?

মিশালঃ আগামী ২১-২৬ সেপ্টেম্বর মালোয়েশিয়ায় হবে। গত ৩০ মে ঢাকা ইম্পেরিয়াল কলেজে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ পর্বে আমরা সোশ্যাল সায়েন্স ইনোভেশন, ইনোভেটিভ লাইফ সায়েন্স এবং এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স- এ সিলভার মেডেল পেয়েছি। আমরা এখন পর্যন্ত জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উৎসব, নভোথিয়েটার অ্যাস্ট্রো বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান মেলা, জাতীয় বিজ্ঞান মেলা, ৪৬ তম জাতীয় বিজ্ঞান সপ্তাহ ও বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড সহ আরও ৫০টিরও বেশি জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছি। 

প্রশ্নঃ দলের নাম Astral Horizons এর পেছনে কোনো গল্প আছে কি?

আবিরঃ "Astral" শব্দটি মহাকাশ, নক্ষত্র ও অসীম সম্ভাবনার দিকে আমাদের লক্ষ্য নির্দেশ করে, যেখানে আমরা পৃথিবী ও মহাকাশে নতুন নতুন আবিষ্কার করতে চাই। "Horizons" শব্দটি নতুন দিগন্ত এবং সীমানার বাইরে যাওয়ার প্রতীক, যা আমাদের প্রতিটি প্রকল্পের উদ্দেশ্য, যেখানে আমরা সীমাবদ্ধতা ভেঙে আরও বড় লক্ষ্য অর্জন করতে চাই। এই নামটি আমাদের মানসিকতাকেও প্রতিফলিত করে, যেখানে আমরা শুধু বর্তমানের মধ্যে আটকে না থেকে, বরং নতুন সীমানায়, নতুন জগতে পৌঁছানোর জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। Astral Horizons আমাদের দলটির দৃঢ় সংকল্পকে প্রতিফলিত করে, যা আমাদের কাছে মহাকাশের অজানা কোণে পা রাখার সাহস এবং মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য নতুন পথ তৈরি করার আগ্রহের প্রতীক।

প্রশ্নঃ আউটার স্পেস হবিটেশন এর সাথে আমাদের পরিচয় হলো কিভাবে?

মিশালঃ  আমরা Team Astral Horizons এর সদস্যরা স্কুল জীবনে থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গভীর আগ্রহী ছিলাম। কলেজে উঠার পর, আমাদের মনে হলো, পড়াশোনার পাশাপাশি এমন কিছু করা উচিত, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে বিশ্বের দরবারে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে দিতে পারি।  একদিন, আমরা একটি পোস্ট দেখলাম—"স্পেসএক্স ২০২৭ ও ২০৩১ সালে মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।" তখন আমাদের একজন বললেন, “কেমন হবে যদি মঙ্গলকেও পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য করা যেত?” সেখান থেকেই আমাদের ভাবনার শুরু।  এভাবেই আমাদের গবেষণার যাত্রা শুরু হয়। রাত-দিন আমাদের চিন্তা, পরিকল্পনা ও কাজ চলতে থাকে। কিছুই সহজ ছিল না, কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট। ধীরে ধীরে আমরা বিভিন্ন প্রযুক্তি ও নকশা তৈরি করতে শুরু করি, যার মাধ্যমে মঙ্গলে মানব বসতি গড়ার একটি ধারণা দাঁড়িয়ে যায়। আমাদের দলটির আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে এবং আমরা আমাদের স্বপ্নের দিকে একধাপ করে এগিয়ে চলি। এবং আলহামদুলিল্লাহ, এখন আমরা একটি সফল মঙ্গল মানব গবেষণা উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের প্রতিষ্ঠান এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করছে এবং জাতীয় পর্যায়ে সুনাম অর্জন করেছে। আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হলো, এই গবেষণা উপনিবেশকে আরও স্থিতিশীল ও কার্যকরী করে তোলা এবং মঙ্গল রোভার, কানেক্টর রোভার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির প্রোটোটাইপ তৈরি করা। 

প্রশ্নঃ তোমাদের আউটার স্পেস হ্যাবিটেশনের বৈশিষ্ট্য কি? 

আবিরঃ  এটি একটি ‘গবেষণাযোগ্য হ্যাবিট্যাট কলোনি’। এখান থেকে বিজ্ঞানীরা মঙ্গলের প্রকৃতি, শক্তি, রসায়ন এবং বসবাসযোগ্যতা নিয়ে গবেষণা করতে পারেন। আমাদের বিশ্বাস, চাঁদের মতো মঙ্গলেও গবেষণা শুরু হলে, মানব জাতির জ্ঞান মহাকাশ সম্পর্কে বহুগুণে বাড়বে, যেমনটা ঘটেছিল স্পেস স্টেশন তৈরি হওয়ার পর ০.০৪% থেকে ৪% পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার সময়। আমাদের তৈরি মডেলটি টিকে আছে পাঁচটি বৈজ্ঞানিক স্তম্ভের ওপর: সায়ানোব্যাকটেরিয়া দিয়ে অক্সিজেন তৈরি, হাইড্রোপনিক চাষে খাদ্য উৎপাদন, মঙ্গল-মাটির বিষাক্ততা দূরীকরণ, পানি ও বর্জ্য পুনঃব্যবহার ব্যবস্থা এবং AI-নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। তবে এখানেই শেষ নয়—আমরা মডেলটিকে শুধু কনসেপ্ট পর্যায়ে রাখিনি; আমরা পুরো সিস্টেমের জন্য থ্রিডি ডিজাইন, থ্রিডি ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং বাস্তব জীবনে উপযোগী করার জন্য থ্রিডি প্রিন্টিং ফর্ম্যাটে মাস্ক ডিজাইনও করেছি, যা মঙ্গলের অ্যাসিডিক বাতাস ও কম প্রেশারে টিকে থাকার উপযোগী করে তৈরি।

আমরা এই হ্যাবিট্যাট মডেলের সমস্ত ঝুঁকি বা ভয়াবহতা-ও বিশ্লেষণ করেছি—যেমন মঙ্গলের ভূমিকম্প, অ্যাস্ট্রাল রেইন, উল্কাপিণ্ড বৃষ্টি, সৌরঝড়, এসিড রেইন ইত্যাদি সব কিছুর জন্য পৃথক পৃথক সম্ভাব্যতা মূল্যায়ন ও প্রতিরোধমূলক ডিজাইন তৈরি করেছি। প্রতিটি ঝুঁকির জন্য আমরা সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবভিত্তিক সমাধানও নির্ধারণ করেছি, যেমন ভূকম্পন সহনীয় শক-অ্যাবজার্বিং বেজ ফ্লোর, সৌরঝড় প্রতিরোধে আর্টিফিশিয়াল ম্যাগনেটিক শিল্ড, উল্কাবৃষ্টির জন্য উচ্চ ঘনত্বের শেল্টার ওয়াল এবং অ্যাসিড রেইনের জন্য কেমিক্যাল রেজিস্ট্যান্ট কভারিং সিস্টেম।

প্রশ্নঃ দেশ, বিশ্ব কিংবা এই মর্ত রেখে মহাকাশে চোখ গেলো কিভাবে?

মিশালঃ আমরা পাঁচজন বন্ধু স্কুল জীবন থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে ভীষণভাবে আগ্রহী ছিলাম। কলেজে ওঠার পর আমাদের মনে হলো, পড়াশোনার পাশাপাশি এমন কিছু করা উচিত, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে বিশ্বের দরবারে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে দিতে পারি। এই সময়ই আমাদের সামনে আসে একটি পোস্ট—"২০২৭ ও ২০৩১ সালে স্পেসএক্স মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।" তখন আমাদের একজন বন্ধু বলল, "কেমন হতো যদি মঙ্গলকেও পৃথিবীর মতো করা যেত?" সেখান থেকেই আমাদের ভাবনার শুরু। যদি এত কিছু সম্ভব হয়, তাহলে মঙ্গলকে বাসযোগ্য করা কেন সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব।  এই ভাবনা থেকেই আমরা গবেষণা শুরু করি। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা অনেকাংশেই সফল হই এবং বর্তমানে আমরা একটি সফল মঙ্গল মানব গবেষণা উপনিবেশ (Mars Human Research Colony) গড়ে তুলেছি। আমরা আমাদের দেশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করছি এবং আমাদের প্রতিষ্ঠানকেও জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক সুনাম এনে দিয়েছি। আমাদের সামনে এখন লক্ষ্য হলো, এই গবেষণা উপনিবেশকে কীভাবে আরও স্থিতিশীল করা যায়, সেই লক্ষ্যে কাজ করা। পাশাপাশি আমরা আমাদের তৈরি করা মঙ্গল রোভার, কানেক্টর রোভার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির প্রোটোটাইপ তৈরি করছি। যদি আমরা যথাযথ সহযোগিতা পাই, ইনশাআল্লাহ আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিতে সক্ষম হবো।

প্রশ্নঃ পৃথিবীতে তো অনেক জায়গা আছে, যেগুলিকে তুলনামূলকভাবে কম খরচে এবং কম পরিশ্রমে বাসযোগ্য করা সম্ভব, তাহলে মঙ্গলে কেন যেতে হবে?”

আবিরঃ  হ্যাঁ, পৃথিবীতে সত্যিই এমন অনেক জায়গা আছে, যেমন সাহারা মরুভূমি বা অ্যান্টার্কটিকা, যেগুলিকে তুলনামূলকভাবে কম খরচে বাসযোগ্য করা সম্ভব। কিন্তু আমরা মঙ্গলে যাচ্ছি না স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বা সেখানেই থাকার জন্য। আমরা যাচ্ছি গবেষণার উদ্দেশ্যে।

মানুষ জ্ঞান অর্জন করতে ভালোবাসে, নতুন কিছু জানতে ও শিখতে ভালোবাসে, এবং সেই জ্ঞানকে নিজের ও মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহার করতে চায়। আজ থেকে একশো বছর আগেও আমাদের ‘আউটার স্পেস’ সম্পর্কে জ্ঞানের পরিমাণ ছিল মাত্র ০.৪%। কিন্তু আধুনিক টেলিস্কোপ ও মহাকাশ স্টেশনগুলোর কারণে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪%-এ। আর যদি আমরা মঙ্গলে গিয়ে গবেষণা করতে পারি এবং একটি বাসযোগ্য উপনিবেশ গড়ে তুলতে পারি, তাহলে সেই জ্ঞান কয়েকশো গুণ বৃদ্ধি পাবে। আমরা নতুন শক্তির উৎস, নতুন খনিজ, নতুন উপাদানের খোঁজ পেতে পারি—যেগুলো এতদিন মানুষের দৃষ্টির অগোচরে ছিল। আশাকরি, এই জ্ঞান ও সম্পদ পৃথিবীর উন্নয়নেও কাজে লাগবে। একইসাথে আমরা জানতে পারবো কীভাবে মঙ্গলকে একটি বাসযোগ্য গ্রহে রূপান্তর করা যায়, যা ভবিষ্যতের মানবজাতির জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে।

প্রশ্নঃ "আউটার স্পেস হ্যাবিটেশন" (OSH) প্রকল্পের মূল লক্ষ্য কী এবং এটি মহাকাশ অনুসন্ধান ক্ষেত্রে কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ?

মিশালঃ  OSH প্রকল্পটি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্প যা মঙ্গলগ্রহে গবেষণার জন্য একটি টেকসই এবং নিরাপদ বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে কাজ করছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য মঙ্গল গ্রহে স্থায়ী বসবাস নয়, বরং বিজ্ঞানীদের জন্য একটি গবেষণাযোগ্য হ্যাবিট্যাট তৈরি করা, যেখানে তারা মঙ্গলের প্রকৃতি, শক্তি, রসায়ন এবং বসবাসযোগ্যতার উপর গবেষণা করতে পারেন। প্রকল্পটি পাঁচটি বৈজ্ঞানিক স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে: সায়ানোব্যাকটেরিয়া দিয়ে অক্সিজেন উৎপাদন, হাইড্রোপনিক চাষে খাদ্য উৎপাদন, মঙ্গল-মাটির বিষাক্ততা দূরীকরণ, পানি ও বর্জ্য পুনঃব্যবহার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এই প্রকল্পটি শুধুমাত্র একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা নয়, এটি একটি ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রযুক্তির উন্নতির প্রতীক।

প্রশ্নঃ OSH প্রকল্পে মহাকাশে বসবাসের জন্য ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কীভাবে করা হয়েছে, বিশেষ করে মঙ্গল গ্রহের প্রতিকূল পরিবেশে?

আবিরঃ  OSH প্রকল্পে মহাকাশে বসবাসের জন্য একাধিক ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে এবং প্রতিটি ঝুঁকির জন্য সমাধান প্রস্তাব করা হয়েছে। মঙ্গলের ভূমিকম্প, সৌর ঝড়, উল্কাবৃষ্টি, এসিড রেইন ইত্যাদি প্রাকৃতিক ঝুঁকি সনাক্ত করা হয়েছে এবং তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন, ভূমিকম্পের জন্য শক-অ্যাবজার্বিং বেজ, সৌরঝড়ের জন্য কৃত্রিম চৌম্বক শিল্ড, উল্কাবৃষ্টির জন্য হাই-ডেনসিটি সুরক্ষা দেয়াল এবং এসিড রেইন প্রতিরোধে কেমিক্যাল রেজিস্ট্যান্ট আচ্ছাদন ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রশ্নঃ  OSH প্রকল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) কীভাবে কাজ করে এবং এর ভূমিকা কী?

মিশালঃ OSH প্রকল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) মহাকাশ হ্যাবিট্যাটের জীবন-সমর্থন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। AI মঙ্গল গ্রহের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে, অক্সিজেন উৎপাদন, পানি পুনঃব্যবহার, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যান্য সিস্টেম মনিটর করে। এটি একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা তৈরি করে, যা জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। AI-এর মাধ্যমে গবেষকদের জন্য কাজের সুবিধা এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যার ফলে তারা দীর্ঘমেয়াদী মহাকাশ অভিযানে নিরাপদ থাকতে পারবেন।

প্রশ্নঃ  OSH প্রকল্পটি কীভাবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলির কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং বাংলাদেশের জন্য এটি কী অর্থ বহন করে?

আবিরঃ OSH প্রকল্পটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলির কাছ থেকে প্রশংসা এবং স্বীকৃতি পেতে সক্ষম হয়েছে, কারণ এটি শুধুমাত্র একটি বৈজ্ঞানিক মডেল নয়, এটি উদ্ভাবন এবং বাংলাদেশি তরুণদের দক্ষতার উদাহরণ। কোনও সরকারি বা কর্পোরেট সহায়তা ছাড়া আমরা এই প্রকল্পটি সম্পন্ন করেছি, যা আমাদের দলের প্রচেষ্টা এবং স্বপ্নের ফল। এই স্বীকৃতিগুলি বাংলাদেশের তরুণদের জন্য একটি নতুন দিশা দেখিয়েছে, যে তারা আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণায় নেতৃত্ব দিতে পারে।

প্রশ্নঃ  OSH প্রকল্পের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী এবং এটি মানবজাতির মহাকাশে সম্ভাবনা ও ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে কীভাবে সাহায্য করতে পারে?

মিশালঃ OSH প্রকল্পের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো আরও উন্নত প্রযুক্তি এবং নতুন বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালানো, যাতে মঙ্গলে গবেষণা কার্যক্রম আরও কার্যকর ও নিরাপদ হতে পারে। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে আমাদের প্রকল্পটি NASA বা SpaceX-এর মতো বড় মহাকাশ সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাস্তবায়ন হবে। OSH প্রকল্প মানবজাতির মহাকাশে গবেষণার জন্য একটি নতুন দিশা দেখাবে, যা মঙ্গল গ্রহে বাসযোগ্য কলোনি গঠন এবং নতুন শক্তির উৎস খোঁজার কাজে সহায়তা করবে।

প্রশ্নঃ OSH প্রকল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) কীভাবে কাজ করে এবং এটি কীভাবে হ্যাবিট্যাট পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে?

আবিরঃ OSH প্রকল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, বিশেষত পুরো হ্যাবিট্যাটের জীবন-সমর্থন ব্যবস্থা পরিচালনা ও নিরীক্ষণে। AI সিস্টেমটি পুরো পরিবেশকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে—যেমন অক্সিজেন স্তর, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, পানি ও বর্জ্য পুনঃব্যবহার এবং আলো নিয়ন্ত্রণ। এই প্রযুক্তি গবেষকদের কাজ সহজ করে, কারণ এটি রিয়েল-টাইম সেন্সর ডেটা বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে পারে, ফলে জীবন-সাপোর্ট সিস্টেম সবসময় স্থিতিশীল থাকে। 

AI ব্যবহৃত হয়েছে মাল্টি-লেভেল অ্যানালাইটিক স্ক্যানার এবং ক্লাইমেট রেগুলেশন চিপে, যা হ্যাবিট্যাটের পরিবেশগত তথ্য সংগ্রহ করে, বিশ্লেষণ করে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, যদি অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পায়, তাহলে AI সেটি শনাক্ত করে সায়ানোব্যাকটেরিয়ার ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এটি শুধু সময় ও শ্রম বাঁচায় না, বরং বিপদ এড়াতে গবেষকদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করে। ভবিষ্যতে আমরা চাই এই AI আরও উন্নত করে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যেখানে এটি শুধু হ্যাবিট্যাট পরিচালনা নয়, বরং গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করেও নতুন সিদ্ধান্ত দিতে পারবে। 

প্রশ্নঃ ডটা সেটগুলো কোথায় সংরক্ষিত হচ্ছে? এআই এজেন্ট তৈরি হয়েছে? 

মিশালঃ আমরা ক্লাউড প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছি ডাটা সংরক্ষণের জন্য। AWS এবং Google Cloud এর মতো নিরাপদ এবং স্কেলেবল ক্লাউড সেবাগুলি আমরা ব্যবহার করছি, যেখানে আমাদের রিয়েল-টাইম ডেটা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিরাপদভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে। এই ডেটাগুলো সহজেই অ্যাক্সেসযোগ্য এবং দ্রুত বিশ্লেষণযোগ্য, যা আমাদের কাজের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে।  এআই এজেন্ট সম্পর্কে বললে, আমরা বর্তমানে এআই এবং মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছি এবং এর প্রাথমিক সংস্করণ তৈরি হয়েছে। আমাদের এজেন্ট রিয়েল-টাইম ডেটা বিশ্লেষণ করে মঙ্গলগ্রহে বসবাসযোগ্য পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে। আমরা নিয়মিতভাবে এই সিস্টেমটি ট্রেনিং এবং আপডেট করছি, যাতে এটি আরও সঠিক এবং কার্যকরী হয়। ভবিষ্যতে, আমরা আরও উন্নত ফিচার যোগ করার পরিকল্পনা করছি।

প্রশ্নঃ এজেন্ট নিয়ে কাজের অগ্রগতি কি?

আবিরঃ এজেন্ট নিয়ে আমাদের কাজের অগ্রগতি বলতে হলে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং মেশিন লার্নিং (ML) ব্যবহার করে একটি এজেন্ট-ভিত্তিক সিস্টেম তৈরি করেছি, যা রিয়েল-টাইম ডেটা বিশ্লেষণ করে এবং পুরো পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ, যেমন অক্সিজেন উৎপাদন, পানি পুনঃব্যবহার, খাদ্য উৎপাদন এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ মনিটর করে। এই সিস্টেমটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম, উদাহরণস্বরূপ, যদি অক্সিজেনের স্তর হ্রাস পায়, এটি সায়ানোব্যাকটেরিয়ার ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে।

আমরা এজেন্ট সিস্টেমটি নিয়মিত ট্রেইন করছি, কারণ এই প্রযুক্তি আগে কোথাও বাস্তবিকভাবে প্রয়োগ হয়নি। এর মাধ্যমে, আমাদের সিস্টেম গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হল ফলস-নেগেটিভ ও ফলস-পজিটিভ কমানো এবং সিস্টেমের কার্যকারিতা আরও উন্নত করা।

আমরা নতুন M1 ও M2  ফিচার যোগ করার চেষ্টা করছি, যা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের অ্যাকুরেসি বাড়াবে এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করবে। এছাড়া, ক্লাউড কম্পিউটিং ও ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেম ব্যবহার করে ডেটা প্রসেসিং আরও স্কেলেবল এবং ফাস্ট করতে কাজ করছি। আমাদের গবেষণার মাধ্যমে, আমরা এই সিস্টেমকে আরও নির্ভুল এবং এফিশিয়েন্ট করতে সক্ষম হব।

প্রশ্নঃ OSH প্রকল্প কীভাবে মঙ্গলের ঝুঁকি, যেমন ভূমিকম্প, ধূলিঝড় এবং অতিবেগুনি রশ্মি (UV) থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে?

মিশালঃ আমরা এই ঝুকি থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছি এবং অন্য প্রযুক্তি কে আরও উন্নত করেছি যার ফলে আমাদের প্রকল্পটি অন্য সকল প্রকল্প থেকে আলাদা এবং যার ফলে আমরা আমাদের গবেষণা গুলোকে প্রকাশ করতে পারছি । ভূমিকম্প (Marsquake) থেকে সুরক্ষায় জিওলজিক্যাল ম্যাপ বিশ্লেষণ করে ধূলিঝড় বা ভূমিকম্পের সম্ভাবনা খুবই কম এমন অঞ্চলটি নির্বাচন করা হয়েছে। ধূলিঝড়ের প্রতিরোধের সমাধানে, আমরা একটি বিশেষ ডিভাইস তৈরি করেছি যা ১০ মিটার ব্যাসার্ধ এলাকা থেকে বিদ্যুৎচালিত আয়ন শোষণ করতে সক্ষম।  আর অতিবেগুনি রশ্মি (UV) থেকে সুরক্ষায় OSH প্রকল্পে একটি ত্রিস্তর গ্লাস ডোম তৈরি করা হয়েছে, যার মধ্যে ১০ মিটার গভীর পানি থাকবে। এছাড়াও যেহেতু মঙ্গলে বায়ুচাপ পৃথিবীর তুলনায় মাত্র ০.৬%, যা মানুষের শরীরের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। তাই OSH প্রকল্পে, ১০ মিটার পানির স্তর ব্যবহার করে আমরা গণিতের মাধ্যমে চাপ সমানীকরণ করেছি, যা পৃথিবীর মতো সুষম চাপ তৈরি করে। এর ফলে, গবেষকরা মঙ্গলের কঠিন পরিবেশে নিরাপদে গবেষণা চালাতে সক্ষম হন।

প্রশ্নঃ মহাকাশে বসবাসের ঝুঁকি মোকাবেলার মতোন পৃথিবীর বিরূপ প্রতিবেশ নিয়ে কোনো ভাবনা আছে কি?

আবিরঃ পৃথিবীতে পরিবেশগত সংকট যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, বায়ু দূষণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানবজাতি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। মহাকাশে বসবাসের জন্য আমরা যে প্রযুক্তি তৈরি করছি, তা পৃথিবীর সমস্যাগুলোর সমাধানে কার্যকরী হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মঙ্গল গ্রহে পানি পুনঃব্যবহার, অক্সিজেন উৎপাদন এবং হাইড্রোপনিক চাষ প্রযুক্তি যা পৃথিবীর অপেক্ষাকৃত অনুর্বর বা মরুভূমির মতো এলাকা, যেখানে প্রচুর পানি বা মাটি নেই, সেখানে খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং কৃষি সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা পাওয়া যাবে।  এছাড়া, মঙ্গলে ধূলি প্রতিরোধ এবং UV রশ্মি শোষণ প্রযুক্তি তৈরি হচ্ছে, যা পৃথিবীতেও টর্নেডো, ঘূর্ণিঝড় বা অতিবেগুনি রশ্মির কারণে প্রভাবিত অঞ্চলে প্রয়োগ করা যেতে পারে। মঙ্গলে তৈরি হওয়া এই প্রযুক্তিগুলি পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যেমন পানির স্তর দিয়ে অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ এবং বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখা। উপকরণ ও সম্পদ খোঁজার ক্ষেত্রেও মহাকাশ গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মঙ্গল গ্রহের খনিজ ও শক্তির উৎস সম্পর্কে গবেষণা, পৃথিবীতে নতুন শক্তির উৎস এবং মিনারেল রিসোর্স আবিষ্কারের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। পৃথিবী থেকে প্রাপ্ত উৎসগুলোকে যদি আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে পৃথিবীকে আরও টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী করে তোলা সম্ভব হবে। মহাকাশ গবেষণা শুধু মহাকাশে বসবাসের উপযোগিতা খুঁজে পাচ্ছে না, বরং পৃথিবীর পরিবেশের উন্নতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি সরবরাহ করছে, যা ভবিষ্যতের প্রেক্ষিতে পৃথিবীকে আরো টেকসই এবং বাসযোগ্য করে তুলবে।