ফিক্সড টেলিকম সার্ভিস প্রোভাইডার লাইসেন্সিং নির্দেশিকার খসড়া প্রকাশ

নতুন লাইসেন্সিং নির্দেশিকা আইএসপিদের জন্য সুযোগ; না মৃত্যুঘন্টা?

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৮ অক্টোবর, ২০২৫ ০৬:১১  
নতুন লাইসেন্সিং নির্দেশিকা আইএসপিদের জন্য সুযোগ; না মৃত্যুঘন্টা?

নতুন টেলিকম লাইসেন্সিং নীতিমালা বাস্তবায়নের নিরিখে ২৭ অক্টোবর, সোমবার ফিক্সড টেলিকম সেবাদাতাদের লাইসেন্সিং গাইডলাইনের খসড়া প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বিটিআরসি। এছাড়াও খসড়া লাইসেন্সিং নির্দেশিকার ওপর যে কোনো পর্যবেক্ষণ, মতামত ও সুপারিশ দেয়া যাবে আগামী ৮ নভেম্বর পর্যন্ত। লাইসেন্সের ধরণ অনুযায়ী, বিদ্যমান নিয়ম ও প্রস্তাবিত নিয়মের ওপর আলাদা আলাদা মন্তব্য পিডিএফ আকারে মেইল করতে হবে। 

টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক অ্যান্ড লাইসেন্সিং পলিসি-২০২৫ এর গেজেট প্রকাশের এক মাস পূর্তির আগেই বিদ্যমান ২৬ ধরনের লাইসেন্সকে একীভূত করা ৪টি প্রধান লাইসেন্সের গাইডলাইন ৪টি স্বতন্ত্র্য লিংকে প্রকাশ করা হয়েছে বিটিআরসি’র ওয়েব সাইটে। লিংকে একে একে সংযুক্ত করা লাইসেন্সিং গাইডলাইনগুলো হলো- ফিক্সড টেলিকম সেবাদাতা (এফটিএসপি) লাইসেন্সিং গাইড লাইন; সেলুলার মোবাইল সেবাদাতাদের (সিএমএসপি) লাইসেন্সিং গাইডলাইন; আন্তর্জাতিক সংযোগ সেবাদাতাদের (আইসিএসপি) লাইসেন্সিং গাইডলাইন এবং জাতীয় অবকাঠামো ও সংযোগ সেবাদাতা  (এনআইসিএসপি) লাইসেন্সিং গাইড লাইন।

ফিক্সড টেলিকম সার্ভিস

এরমধ্যে বিদ্যমান আইএসপি ও পিএসটিএন ব্যবস্থাকে একীভূত করে নতুন “ফিক্সড টেলিকম সার্ভিস” কাঠামোতে রূপান্তর করা হয়েছে। এই রূপান্তরে এনআইসিএসপি’দের কাছ থেকে ফাইবার বা ট্রান্সমিশন সুবিধা এবং আইসিএসপি-দের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথ নেয়া ও আইপিভি৬ এ মাইগ্রেশনের বাধ্যবাধকতা বেধে দেয়া হয়েছে এফটিএসপিদের। এই লাইসেন্সধারীরা নিজেরাই স্বাধীনভাবে ফাইবার স্থাপন ও সংযোগ সঞ্চালন করতে পারবে। ইন্টারনেট ও ভয়েস পিয়ারিংয়ের জন্য নতুন ফ্রেমওয়ার্ক চালু করে বিদ্যমান আইসিএক্স ও নিক্স একীভূত হবে ফিক্সড টিলিকম সেবায়। 

খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, টেলিযোগাযোগ সেবাকে আরও স্বচ্ছ, বিনিয়োগবান্ধব ও প্রযুক্তিনিরপেক্ষ করা এই গাইডলাইনের মূল উদ্দেশ্য। এতে ন্যায্য প্রতিযোগিতা, উদ্ভাবন, মানসম্মত সেবা ও সারাদেশে সুলভ সংযোগ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষত গ্রামীণ, উপকূলীয় ও অনগ্রসর অঞ্চলে সেবার আওতা বাড়ানোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

এফটিএসপি লাইসেন্সিং গাইডলাইন অনুযায়ী, বর্তমানে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী আইএসপিদের এবার এফটিএসপি-তে রূপান্তরিত করা হবে। ১০ বছর মেয়াদী দুইটি ভাগে বিন্যস্ত এই লাইসেন্সিং কাঠামোতে বিদ্যমান ন্যাশনওয়াইড/ডিভিশনাল/ডিস্ট্রিক আইএসপি ও পিএসটিএন লাইসেন্সধারীরা নতুন এফটিএসপি (FTSP) বা ডিস্ট্রিক এফটিএসপি-তে (District FTSP) মাইগ্রেট করতে পারবে। তবে ডিস্ট্রিকএফটিএসপি’রা কেবল  জেলাভিত্তিক স্থানীয় উদ্যোক্তার মতো ইন্টারনেট ব্যবসায় করতে পারবে। লাইসেন্সিং নীতিমালা অনুযায়ী, একই প্রতিষ্ঠান একসাথে উভয় লাইসেন্স রাখতে পারবে না।  একবার মাইগ্রেশন শেষ হলে পুরনো লাইসেন্স স্থায়ীভাবে বাতিল বলে গণ্য হবে।

পুরোনো থেকে নতুন লাইসেন্সিংয়ে আসতে হলে এফটিএসপি-দের আবেদন বাবদ ৫০ হাজার এবং লাইসেন্স ফি বাবদ ২৫ লক্ষ টাকা জমা দিতে হবে বিটিআরসি-তে। সঙ্গে ব্যাংক গ্যারান্টি থাকতে হবে ২৫ লক্ষ টাকার। বার্ষিক ফি দিতে হবে ১০ লক্ষ টাকা। প্রথম বছর রাজস্ব ভাগ না করতে হলেও পরের বছর থেকে বার্ষিক মোট রাজস্বের ৫.৫ শতাংশ রাজস্ব ভাগাভাগি ছাড়াও সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলে জমা দিতে হবে বার্ষিক মোট রাজস্বের ১ শতাংশ। এই নিয়ম জেলা পর্যায়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্যও একই। তবে ডিস্ট্রিক এফটিএসপি-দের আবেদন ফি বাবদ ১০ হাজার টাকা, লাইসেন্স ফি বাবদ ২ লক্ষ টাকা এবং বার্ষিক ফি দিতে হবে ১ লক্ষ টাকা। 

আইএসপি’দের মৃত্যুঘণ্টা?

ইন্টারনেট সেবা দিতে এই ফি অন্যয্য বলে মনে করছেন ইন্টারনেট সেবাতারা। একইসঙ্গে রাজস্ব ভাগাভাগিতে ইন্টারনেটের দাম অনেক বেড়ে যাবে বলে মনে করেন আইএসপিএবি মহাসচিব নাজমুল করিম ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার বলার পর চড়া লাইসেন্স ফি’র সঙ্গে বছরে বছরে ৫.৫ শতাংশ রাজস্ব ভাগাভাগি এবং মুনাফার ১ শতাংশ এসওএফ ফান্ডে জমা দিলে ইন্টারনেটের দাম আর সস্তা থাকবে না। এটি বিলাসী পণ্যে রূপ নেবে। তখন একদিকে সাধারণ গ্রাহকরা বঞ্চিত হবেন; অন্যদিকে ব্যবসায় সঙ্কোচনের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে নতুন বেকারত্ব সৃষ্টি হবে। এর ওপর মোবাইল অপারেটরদের হটস্পট ও ওয়াইফাই ইন্টারনেট সেবা দেয়ার সুযোগ করে দিয়ে মূলত দেশীয় ‘উদ্যোক্তাদের মৃত্যুঘণ্টা’ বাজানোর আয়োজন হয়েছে নতুন গাইডলাইনে। 

সূত্রমতে, এমন পরিস্থিতিতে ২৯ অক্টোবর, বুধবার জরুরী ইসি বৈঠকে বসছেন আইএসপিএবি নেতারা। এরপরের দিন এই খসড়া নিয়ে সাধারণ সভা করে বিটিআরসি-তে নিজেদের মতামত জানাবেন আইএসপিএবি ব্যবসায়ীরা। অবশ্য গত ২২ সেপ্টেম্বর গেজেট পাশের পরই ‘টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক অ্যান্ড লাইসেন্সিং’ নীতিমালাকে বৈষম্যমূলক বলে জানিয়েছিলেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। 

তবে ব্যবসায়ীদের ভয় না পেয়ে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেছেন “এটি লাইসেন্সিংয়ের ক্ষেত্রে স্তরায়ন ও মধ্যস্বত্ত্বভোগী কমিয়ে এবং প্রতিযোগিতামূলক সেবা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রখবে। এতে সরকারের রাজস্ব না কমিয়েও গ্রাহকদেরকে সুলভ মূল্যে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।” 

নতুন লাইসেন্সপ্রাপ্তির যোগ্যতা
কোম্পানি, পার্টনারশিপ বা একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান (আরজেএসসি নিবন্ধিত) আবেদন করতে পারবে।
ফিক্সড টেলিকম সার্ভিস-এর ক্ষেত্রে আর্থিক সামর্থ্য, প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও ন্যূনতম মূলধন নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অপারেটর, এনআইসিএসপি বা আইসিএসপি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান নতুন এফটিএসপি লাইসেন্স পাবে না।
বিদেশি মালিকানা সর্বোচ্চ ৮৫%, স্থানীয় অংশীদারিত্ব ন্যূনতম ১৫% বাধ্যতামূলক।

এই লাইসেন্সের প্রাথমিক মেয়াদ পরবর্তী সময়ে প্রতি ৫ বছর অন্তর নবায়ন করতে হবে। নবায়নের জন্য মেয়াদ শেষের অন্তত ১৮০ দিন আগে আবেদন জমা দিতে হবে।  সেবা দেয়ার আগে গ্রাহকদের সাথে চুক্তিতে সেবার গুণমান স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় কনটেন্টের ক্ষেত্রে ন্যূনতম যৌক্তিক অনুপাত হতে হবে ১:৪। 

এছাড়াও এফটিএসপি’দের প্রথম বছরে অন্তত একটি জেলা এবং ৫ম বছরে ৩২ জেলায় বাধ্যতামূলকভাবে সংযোগ দেয়ার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে নতুন গাইড লাইন। এক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ের এফটিএসপিদের ৫ বছরে অন্তত ৮০০ গ্রাহক থাকতে হবে। রোলআউট লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হলে ব্যাংক গ্যারান্টি বাজেয়াপ্ত হবে। একইভাবে দুর্গম ও অনগ্রসর এলাকায় সেবা দিলে প্রণোদনা দেওয়ার আভাস রয়েছে। এছাড়াও এফটিএসপি ও ডিস্ট্রিক এফটিএসপি–রা চাইলে সাইবারক্যাফে পরিচালনা করতে পারবে। তবে প্রতিটি ব্যবহারকারীর নাম–এনআইডি অনুযায়ী নিবন্ধন করা এবং ক্যাফেতে সিসিটিভি স্থাপন ও নিষিদ্ধ কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের দায় এই সেবাদাতার ওপরই বর্তাবে।