নতুন ‘স্ক্যামার’ নেক্সট সিইও!

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৭ অক্টোবর, ২০২৫ ১৩:৩৬  
২৭ অক্টোবর, ২০২৫ ১৪:৩৮  
নতুন ‘স্ক্যামার’ নেক্সট সিইও!

অন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যখন অনলাইনে জুয়া বন্ধে রেড এলার্ট চলছে, তখন ফেসবুকে বিনিয়োগ সংগ্রহের নামে চলছে চাতুর্যপূর্ণ কৌশল। শতভাগ মুনাফা সঙ্গে বাংলাদেশ সহ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির অংশীদার হওয়ার প্রলোভন দিয়ে চলছে ‘ক্যাপিট্যাল ফিশিং’।  কমপক্ষে ৬ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করলে মাসিক নুন্যতম ৫০ হাজার টাকা মুনাফা ও আমেরিকায় নিবন্ধিত কোম্পানির শেয়ার এবং আমেরিকা ভ্রমনের ইনভাইটেশন দিচ্ছে নেক্সট সিইও ইউএসএ এলএলসি নামের একটি কোম্পানির নামে। এছাড়াও বাংলাদেশে নিবন্ধিত নেক্সটসিইওএলটিডি কোম্পানিটি যৌথমূলধনী ব্যবসায় হিসেবে নিবন্ধিতহলেও মূলত এটি এক ব্যক্তির প্রযুক্তি নির্ভর মার্কেটিং ফাঁদ হিসেবে বেরিয়ে এসেছে ডিজিবাংলাটেক.নিউজ এর অনুসন্ধানে। এই কোম্পানিটির একপাতার ওয়েবসাইটের দৈন্যদশাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কোম্পানির অন্তঃসার শুন্যতা।

তবে টিভি অভিনেতা রকি খানের উপস্থাপনায়  ‘মাত্র ৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেই পাচ্ছেন প্রতিমাসে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার আয়। বাংলাদেশে ২টি এবং আমেরিকায় একটি লাইসেন্স প্রাপ্ত কোম্পানি। ২০১৯ সাল থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার আয়। আপনার ইনভেস্টমেন্ট শতভাগ সুরক্ষিত। ৬ লাখ টাকায় আজীবন মাসিক আয়। মাত্র এক লাখ টাকা ডাউনপেমেন্ট করেই আমেরিকার কোম্পানির শেয়ার। আজই ইনভেস্ট করলেই ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পাবেন ইনভাইটেশন লেটার। সাত দিনের মধ্যে পাবেন ক্যালিফোর্নিয়া অফিস ভিজিটের সুযোগ।’ 

এছাড়াও সোশ্যাল হ্যান্ডেলে এই কোম্পানিতে চাকরির বিজ্ঞাপনেও বিস্মিত হতে পারেন চাকরি প্রার্থীরা। এই কোম্পানি থেকে নিয়োগ দেয়ার জন্য কলসেন্টার এজেন্টের মাত্র ৫ ঘণ্টার বেতন অফার করা হয়েছে ১৫০০-২২০০ ডলার বা ১ লাখ ৮০ থেকে ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। ডেটা এন্ট্রি স্পেশালিস্টের ৫ ঘণ্টার বেতন ১২০০-১৮০০ ডলার। এছাড়াও ডিজিটাল মার্কেটারের একই সময়ের বেতন ২৫০০ থেকে ৪৫০০ ডলার! 

সোশ্যাল হ্যান্ডেলে এমন বিজ্ঞাপন বা প্রচারণা দেখে চোখ ছানাবড়া না হয়ে উপায় নেই। সঙ্গত কারণেই বিজ্ঞাপনে প্রতারণার ফাঁদে জড়াচ্ছেন অনেকেই। খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, বিনিয়োগ করতে এরই মধ্যে অনেকেই কল সেন্টারে যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন। প্রলোভনে পা দেয়েছেন এদের বেশির ভাগই। প্রকাশ্যে নাম না প্রকাশ করে বিনিয়োগের পুরো বিষয়টি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। কেউ আবার বিজ্ঞাপনের নিচেই তীর্যক মন্তব্য করে সতর্ক করতে শুরু করেছেন। কিন্তু সেসব মন্তব্য বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকছে না। ডিলিট করে দেয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতে প্রশ্ন জেগেছে, এটা কি নতুন কোনো স্ক্যাম? 

বিষয়টি অনুসন্ধানে নেমে প্রথমেই বিজ্ঞাপন নিয়ে সন্দেহ জাগে এই প্রতিবেদকের। এরপর যোগাযোগ করা হয় অফার দেয়া নেক্সট সিইও লিমিটেড কোম্পানির সিইও মোঃ লিমন মিয়ার সঙ্গে। ঘণ্টাব্যাপী নানা প্রশ্নের মুখে বেরিয়ে এসেছে তার শিকারি কৌশল। তিনি বলেন, নেক্সটি সিইও কোম্পানিটি একক মালিকানাধীন। তবে লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন নিতে নিজেরই অফিস অ্যাসিস্টেন্টকে ১০ শতাংশ শেয়ার দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে রয়েছে তার আরো একটি কোম্পানি। কোনো বিনিয়োগকারী যখন ৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করবেন তাকে তখন বাংলাদেশ ও ক্যালিফোর্নিয়ার মালিকানার অংশীদার করা হয়। তখন কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার হিসেবে আমরা তাকে সেখানে ভিজিটের জন্য ইনভাইটেশন লেটার এনে দেই। পুরো বিষয়টিই স্ট্যাম্পে এফিডেভিড করে করা হয়। 

তিনি বলেন, প্রতিদিন ৫-৭ জন ক্লায়েন্ট পাচ্ছি। পোস্ট দিতেই ১৫-২০ জন বিনিয়োগকারী আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিনিয়োগকারীরা আমাকে বিশ্বাস করছে। যারা রাজি হচ্ছেন তাদের আমি স্ট্যাম্পে ‘ডিড শেয়ার’ চুক্তি করে প্রতিমাসে ৬ লাখ টাকা বিনিয়োগে প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকা রিটার্ন এবং ৩০ হাজার টাকা প্রফিট দিচ্ছি। 

কিন্তু শেয়ার বিক্রি কি শুধু এফিডেভিড করে হয়? বাংলাদেশী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির শেয়ার কিনতে বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমতি লাগে না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, যেহেতু লিমিটেড হতে হলে একজনে হয় না। তাই আমি আমার অফিসসহকারীকে ১০ শতাংশ শেয়ার দিয়ে নিবন্ধন করেছি। কোম্পানি বড় করতে এবং তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কাজ করছি। বিনিয়োগ সংগ্রহে প্রমোশন অফার হিসেবে বাংলাদেশে ও আমেরিকার কোম্পানির কথা বলেছি। এখানে বিনিয়োগকারীর চুক্তিটি হয় ব্যক্তি লিমনের সঙ্গে। কোম্পানি এখানে গ্যারান্টি হিসেবে কাজ করে। আমেরিকার কোম্পানির মালিক হবেন না। 

কোম্পানির ভ্যালুয়েশন কিংবা এতো প্রফিট কীভাবে আসে বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমরা এই কোম্পানি থেকে ২৭ ধরনের ব্যবসা করি। তবে বিভিন্ন কোম্পানিকে আইটি সাপোর্ট দেয়া, ডিজিটাল মার্কেটিং, সেলার তৈরি ও ড্রপ শিপিং কাজ ছাড়া অন্য বিষয়ে খুব বেশি খোলাসা করেননি তিনি। তবে তার স্থাবর কোনো সম্পদের কথা বলতে না পারলেও নিজ এলাকা কুড়িগ্রামের রাজিবপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করতে জায়গা খুঁজছেন বলে জানান। কিন্তু কী ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় তা যেমনটা বলতে পারেননি, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নেয়ার প্রক্রিয়া বিষয়েও স্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারেননি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয় থেকে স্নাতক করা ২৪ বছর বয়সী এই যুবক। তার দাবি, অ্যামাজান ও স্পটিফাই  হতে তিনি ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করেছেন। নিজের ডিজিটাল মার্কেটিং শক্তি দিয়ে সেলার তৈরি করছেন। ৩০০ জনের বেশি উদ্যোক্তা ও প্রফেশনালকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে লিমন বলেন, আমি তরুণদের অনলাইনে ট্রেনিং করাই। এআই টু ডিজিটাল ট্রেনিং করাই। ইতিমধ্যেই ৪০০ জনকে প্রশিক্ষণ করিয়েছি। আমার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সেরা গ্যাজেটের মতো ই-কমার্স গড়ে উছেছে। এছাড়াও রিভেলওয়ে ফ্যাশন, সারা আইটি, এ কে এলিগ্যোন্টস,  স্বপ্ন ইলেকট্রনিক্স এর মতো ৫০০ কোম্পানিকে আমরা এই কোম্পানি থেকে আইটি সাপোর্ট দেই। ২০২৩ সালে ড্রপ শিপিং শুরু করি। প্রশিক্ষণ দিয়ে ২০ ডলার করে একজন সেলারের পেছনে বুস্ট করি। এমন ২০০ জন সেলার আমার ড্রপশিপিংয়ে কাজ করছে। এখানে আমার মুনাফা ২০০ শতাংশ।

ফেসবুকে সরব থাকলেও ওয়েবসাইট অচল কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডেভলপমেন্টের কাজ চলছে। তবে লিমনের ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত নেক্সটসিইও এর ওয়েব ঠিকানা অনুসন্ধানে দেখা গেছে এই ডোমেইনটি তিনি  থার্ড পার্টি দিয়ে কিনেছেন। কথার ফুলঝুড়ি আর বিপনন কৌশলে তরুণ ও বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করলেও বাস্তবতায় অনেক লুকোছাপ বেরিয়ে এসেছে। 

যদিও লিমন বারবার এই প্রতিবেদককে তার ধানমন্ডির অফিস ভিজিটের আহ্বান জানিয়ে মিরপুরে নেক্স সিইও এর আরেকটি অফিস থাকার কথা জানিয়েছিলেন লিমন। তার দাবি, অনুযায়ী শিয়ালবাড়িতে একটি গোডাউন থেকে ড্রপশিপিং করেন। সবগুলো ব্যবসায়ে অংশীদারিত্ব দিতে বিনিয়োগকারীদের ৬ লাখ টাকা বিনিয়োগে একটি শেয়ার দিচ্ছেন। তবে একজনকে সর্বোচ্চ তিনটি শেয়ার দেন। আর এই বিনিয়োজিত অর্থ দুই বছর ছয় মাসের মধ্যে ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। প্রতি বছরে জুলাই-আগস্ট ক্লোজের পর নতুন বিনিয়োগকারী নেন। 

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ঢাকায় তার যে অফিস রয়েছে সেখানে ২০-২৫ জন কাজ করেন। এর বাইরেও লিমনের রয়েছে ৩ জন বডিগার্ড। এরা হলেন- আশরাফ উদ্দিন রিপন, সাগর আলী ও রুপস মাহমুদ। এদের নামে কর্মচারীদের গায়ে হাত তোলায় মোহাম্মদপুর থানায় জিডি রয়েছে। এছাড়াও নেক্স সিইও লিমিটেড নামের কোম্পানিটির ধানমন্ডির মোড়-এ যে শেয়ার অফিস থেকে নোটিশ দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। কো-ওয়ার্কিং স্পেস এর পরিবেশ নষ্ট করার কারণে মোড় কতৃপক্ষ তার সাথে হওয়া সকল চুক্তি বাতিলের বিষয়টি নিশ্চি করেছেন মোড় ধানমন্ডি ২৭ এর অফিস সহকারী মোঃ ইমন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নেক্সটসিইও ইউএসএ কোম্পানিটি চলতি বছরের ২২ মে নিবন্ধিত হয়েছে একটি তৃতীয় পক্ষেরে  বিজনেস রকেট ইনকরপোরেশনের মাধ্যমে। এই ধরনের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মালিকানা থাকে লুকানো। ফলে এই কোম্পানির মালিক যে মোঃ লিমন মিয়া তা সার্টিফিকেট দিয়ে নিশ্চিত করা যাবে না। তাছাড়া এজেন্টদের মাধ্যমে গঠিত কোম্পানিগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই কোনো স্থায়ী ভিত্তি থাকে না। অথচ লিমন ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের এই নামে কোম্পানি আছে এমন একটি সনদ শেয়ার করে প্রলুবদ্ধ করছেন।  ২০১৯ সাল থেকে ব্যবসায় করেন ধুয়ো তুলে  এমন অনেক বিষয়ই এই ব্যাবসায় প্রক্রিয়াকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখাই সঙ্গত। মিরপুরের অর্কিড কমিউনিটি সেন্টারে সাত তলায় আমার আরও একটা আউটলেট আছে। শিয়াল বাড়ীতে গোডাউন আছে। সব মিলিয়ে আমার বার্ষিক আয় ৬ মিলিয়ন ডলার।

আবার বিনিয়োগ ফেরত দেয়ার বিষয়ে শতভাগ নিশ্চয়তা দিলেও কাদের এ পর্যন্ত মুনাফা দিয়েছেন এবং বিনিয়োগ ফেরত দিয়েছেন তা বলতে পারেননি। বলেছেন, অনেকেই তার এখানে বিনিয়োগ করছেন। তিনি এর মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন। বেকারদের অনলাইনে ট্রেনিং দিচ্ছেন। তবে ব্যাচে নয়, সোলো ট্রেনিং দেন। এ বিষয়টিও তার কার্যক্রম নিয়ে সন্দেহের জন্ম দেয়।  একইভাবে তার কাজের পরিসির, ক্লায়েন্ট প্রোফাইল নিয়ে শতভাগ মুনাফার কোনো বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি পাওয়া যায়নি অনুসন্ধানে। ফলে এমন চটকদারি বিজ্ঞাপনকে অনলাইন স্ক্যাম হিসেবে শঙ্কা খাত সংশ্লিষ্টদের। মনে করিয়ে দিচ্ছে পূর্বের ইভ্যালি থেকে ডেসটিনি, ইউনিপে টু ও যুবকের নাম।   

পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, প্রতিযোগিতামূলক এই সময়ে ৬ লাখ টাকায় মাসে ৫০ হাজার টাকা ‍মুনাফা দেয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তব সম্মত নয়। তাদের শঙ্কা, শুরুতে দুই চারজনকে টাকা দিয়ে তা প্রচার করে বিনিয়াগকারী শিকার করে কোম্পানিটি হঠাৎ করেই হাওয়া হয়ে যেতে পারে। নয়তো কারো কালো টাকা সাদা করতে এই পথ বেছে নেয়া হয়েছে।  এক্ষেত্রে বিনিয়োগ পেতে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোম্পানির অংশীদার হিসেবে ইনভাইটেশন এনে দেয়ার প্রলভোন দেয়া হচ্ছে। 

পুরো বিষয়টি ‘শতভাগ স্ক্যাম’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রযুক্তিবিদ ফাহিম মাশরুর এবং টেলিকম বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির। বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনের অধীনে আনার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তারা বলেছেন, সারা বিশ্বেই অনলাইনে এমন স্ক্যাম সাস্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। এ বিষয়ে ক্ষতির মুখে পড়ার আগেই সচেতন হতে হবে।