চন্দ্রাভিলাষীদের আসমান-জমিন দীর্ঘতম ঈদ কি স্থিতি হবে জাতীয় গৌরবে?

৬ এপ্রিল, ২০২৫  
৬ এপ্রিল, ২০২৫  
চন্দ্রাভিলাষীদের আসমান-জমিন দীর্ঘতম ঈদ কি স্থিতি হবে জাতীয় গৌরবে?

আগামী ১১ ও ১২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের হান্টসভিল, অ্যালাবামায় অবস্থিত ইউএস স্পেস অ্যান্ড রকেট সেন্টারে অনুষ্ঠিত হবে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) আয়োজিত ‘হিউম্যান এক্সপ্লোরেশন রোভার চ্যালেঞ্জ ২০২৫’ (এইচইআরসি)। এই প্রতিযোগিতায় সদ্য সংযুক্ত রিমোট কন্ট্রোল বিভাগে বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধিত্ব করছে বাংলাদেশের মুন-রোভার দল ‘ড্রিমস অব বাংলাদেশ’। এই চন্দ্রভিলাষী দলটি এরই মধ্যে চাঁদের অসমতল ধূসর মাটিতে লাল-সবুজের পতাকা ওড়াতে নির্মাণ করেছে চন্দ্রযান ‘মাইরেজ ১’। 

তবে চাঁদের মাটিতে নিজেদের বিজয় কেতন ওড়াতে তাদেরকে পার করতে হবে আরো একটি ধাপ। এরইমধ্যে অবশ্য আট হাজার প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে পেছনে ফেলে এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি দলের মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন কলেজ পড়ুয়া তরুণ গবেষকদের এই দলটি। প্রতিযোগিতায় চূড়ান্তভাবে ডাক পাওয়া ৭২টি দলের মধ্যে বাংলাদেশ দলের মোট সদস্য সংখ্যা ১৫। এদের একেকজন ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ কলেজ, বিএএফ শাহীন কলেজ, ভিকারুননিসা নূন কলেজ, সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, এবং সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন  ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার্থী সানজিম হোসাইন। তবে এবারের মিশনের সিপাহশালার বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ পাবলিক কলেজের শিক্ষার্থী মাহদির ইসলাম। 

দলের সেফটি অফিসার ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী আন নাফিউ, মেকানিক্যাল লিড ঢাকার সিপিআই পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী মো. রিফাত হোসাইন, টেকনিক্যাল লিড বিএএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী মো. ইয়াসিন আরাফাত, সফ্‌টওয়্যার লিড হিসেবে আছেন ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী অর্কপ্রতীক আচার্য, দলের ইলেকট্রিক লিড হিসেবে আছেন সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মার্জিয়া আফিফা পৃথিবী। মাইরেজ-১ এর ডিজাইন লিড হিসেবে আছেন ঢাকা ইমপিরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল জুনায়েদ। অন্য সদস্যরা হলেন- ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী আয়েশা জাহার সাফা, ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী ফাতেমা জাহান শিফা, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী রুবাইয়াত এইচ রহমান ও হাসিন ইশরাক চৌধুরী তাহা।
 
দলটির ম্যানেজার ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী শামীম আহনাফ তাহমিদ। মুন ল্যান্ডার রোভার টিমের পরামর্শক হিসেবে আছেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) শিক্ষক শাহ মো. আহসান সিদ্দিক।  কোচ হিসেবে আছেন আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক মো. মঈন উদ্দিন। আর পরামর্শদাতা হিসেবে আছেন জাওয়াদ রহমান ও মো. ফয়সাল হোসেন। মেন্টর হিসেবে দলটির সঙ্গে আছেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) জাওয়াদুর রহমান ও মো. ফয়সাল হোসেন।

তবে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গত  ২৮ মার্চ বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পথে তার্কিশ এয়ারলাইন্সে ডানা মেলে মূল দলের ১২ সদস্য। বাকিদের ফ্লাইট ৭ এপ্রিল। তারা দেশে ঈদ করলেও অগ্রবর্তী দলটি ঈদ উদযাপ করেছে আকাশ-পাতাল মিলিয়ে। চন্দ্রাভিলাষের ট্রান্জিটে এশিয়া মাইনর উপদ্বীপ তুরস্কে। সেখানেই একদিনের ভিজিট ভিসা নিয়ে ঈদের নামাজ পড়েন ‘ড্রিমস অব বাংলাদেশ’ দলের সানজিম হোসাইন, মাহদির ইসলাম, আন নাফিউ, মো. রিফাত হোসাইন, মো. ইয়াসিন আরাফাত, অর্কপ্রতীক আচার্য, মার্জিয়া আফিফা পৃথিবী, আয়েশা জাহার সাফা, রুবাইয়াত এইচ রহমান, হাসিন ইশরাক চৌধুরী তাহা, শামীম আহনাফ তাহমিদ এবং আব্দুল্লাহ আল জুনায়েদ। 

পরিবার পরিজন ছেড়ে হলেও তুরস্কের ইসলামী সাংস্কৃতিক আবহে ঈদটা দারুণ ভাবেই উদযাপন করেছেন বলে জানালেন মাহদির ইসলাম। বললেন, আমাদের জন্য ঈদটা ছিলো হলিস্টিক। এশিয়া-ইউরোপ মিলিয়ে হয়েছে আমাদের ঈদ। তুরস্কের সৌকর্যময় ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক আবহে তুরস্কের  সকাল ৭টায় আমরা ইস্তাম্বুলের এয়ারপোর্ট সড়কের আলি কুসজু মসজিদে ঈদের জামাতে অংশ নেই। নামাজ শেষে ভিনদেশী মুসলিম ভাইয়েরা আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে মুসাফাহ ও বুক মিলিয়ে কোলাকুলি করে। সেখানকার ঐতিহ্যবাহি ডেজার্ট উপভোগ করি আমরা। ঈদের দিন দুপুর ৩টায় ছিলো আমাদের ফ্লাইট। তাই তড়িঘড়ি করে হোটেল হয়ে বিমানবন্দরে ফেরা। নির্ধারিত ফ্লাইটে ইউএসএ-তে যাত্রা। তাই অর্ধেক ঈদ তুরস্কে আর বাকি অর্ধেকটা উদযাপন করেছি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে। আর ফ্লাইটে ছিলাম ১৩ ঘণ্টা। 

আকাশ-পাতাল মিলিয়ে এশিয়া ইউরোপে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ঈদ উদযাপন করেছে চন্দ্রভিলাষী ‘ড্রিমস অব বাংলাদেশ’ দলের ১২ সদস্য। এরপর তারা ৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই, ইউএসএ এর আমন্ত্রণে মেডিসন হাইটসে নিজেদের গবেষণা ও উদ্ভাবন তুলে ধরে স্থানিয় কমিউনিটির সামনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি পাবলিক রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয় সেন্ট্রাল মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অন মেশিন লার্নিং অ্যান্ড কম্পিউটিং  (আইসিএমএ) এর ওপর অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে দলটির পক্ষ থেকে গৃহীত দুইটি গবেষণা পত্র উপস্থাপন করেছে ৫ এপ্রিল। ৬ এপ্রিলও চলবে উপস্থাপনার কাজ। এর পর প্রকাশিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে। এরপর ৭ এপ্রিল তারা উড়াল দেবে আলাবামার হান্সভ্যালিতে।  এরপর সেই মহারণ জয় করে ঈদের আনন্দকে আরো দীর্ঘ করতে চায়  ‘ড্রিমস অব বাংলাদেশ’ দলের সদস্যরা। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে জাতির জন্য বয়ে আনতে চায় গৌরবের মহিমা। 

ড্রিমস অব বাংলাদেশের মাইরেজ-১

 কিউরিওসিটি রোভারের মতো অনেকটা, রকার-বগি সাসপেনশন সিস্টেম ব্যবহার করে দূর নিয়ন্ত্রিত রোভারটিতে রয়েছে ছয়টি চাকা। রোভারটির দৈর্ঘ্য ৭০০ মিমি, প্রস্থ ৪৬০ মিমি, উচ্চতা ২৮০ মিমি। ফ্রেম ও ভার বহনকারী কাঠামো তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম বার। এর চাকার ব্যসার্ধ ১৮০ মিমি, গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স ৩৬০ মিমি। কার্বন ফাইবার টিউব ব্যবহার করা হয়েছে এর কাঠামোগত শক্তি বাড়াতে। পলিল্যাকটিক এসিড ব্যবহার করা হয়েছে প্রোটোটাইপিং ও হালকা কম্পোনেন্টের জন্য। আর থার্মোপ্লাস্টিক পলিউরেথেন ব্যবহার করা হয়েছে চাকার নমনীয় জয়েন্ট ও প্রভাব প্রতিরোধী অংশের জন্য। রোভারটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর অত্যাধুনিক সেন্সিং এবং নেভিগেশন সিস্টেম। এতে ইন্টিগ্রেটেড স্ল্যামটেক আরপি-লাইডার সিস্টেম রয়েছে, যা ৩৬০ ডিগ্রি দৃষ্টিকোণ থেকে আশপাশের জমি ম্যাপ করতে পারে। টাইম অব ফ্লাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই লাইডার লেজার রশ্মি ছড়িয়ে বিষয়বস্তুর দূরত্ব পরিমাপ করার মাধ্যমে বিস্তৃত পয়েন্ট ক্লাউড তৈরি করে, যা প্রক্রিয়াকরণের ফলে তৈরি হয় ২ডি মানচিত্র। ইএসপিভিত্তিক মাইক্রোকন্ট্রোলার রোভারের মস্তিষ্ক হিসেবে কাজ করে এবং সব ডেটা প্রসেসিং ও রোভার নিয়ন্ত্রণের কাজও করে এটি। এর সঙ্গে সংযুক্ত একটি রিসিভার ইউনিট আছে, যা প্রধান রিমোট কন্ট্রোলারের সঙ্গে বেতার যোগাযোগ স্থাপন করে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বা ওয়াই-ফাই প্রটোকলের মাধ্যমে। রোভারটিতে আরো সজ্জিত ছয়টি ডিসি মোটর, মোটর ড্রাইভার মডিউল, উচ্চ রেজল্যুশনের দৃশ্য ধারণের ক্যামেরা সিস্টেম এবং বিশেষভাবে ডিজাইন করা পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম দিয়ে, যা লিথিয়াম পলিমার ও ১৮৬৫০ ব্যাটারির সমন্বয়ে তৈরি। এটি অন্ধকারে, ধুলাচ্ছন্ন অবস্থায়, এমনকি বৈরী আবহাওয়ায়ও সঠিকভাবে ডেটা সংগ্রহ করতে পারে। পরীক্ষাগারের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এটি তথ্য সংগ্রহে ৯৮ শতাংশ নির্ভুলতার হার অর্জন করেছে।