ভেষজ মোবিল উদ্ভাবনে আশরাফ আলীর তেলেসমাতি

৭ মে, ২০২৫  
৮ মে, ২০২৫  
ভেষজ মোবিল উদ্ভাবনে আশরাফ আলীর তেলেসমাতি

ঝোপঝাড়ে থাকা আগাছার সঙ্গে ভেরেন্ডা গাছের ফল ব্লেন্ড করে ও জ্বালিয়ে ‘ভেষজ ইঞ্জিন ওয়েল’ উদ্ভাবন করেছেন নীলফামারীর ডিমলার বালাপাড়া ইউনিয়নের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হাজী আশরাফ আলী। এরই মধ্যে তার প্রতিবেশী ও এলাকাবাসী স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এই ‘ভেষজ মোবিল’ ব্যবহারও শুরু করছেন। অর্ধেক খরচের এই ভেষজ মোবিল-কে তারা আশরাফ আলীর তেলের তেলেসমাতি হিসেবেই দেখছেন।

তেলটি ব্যবহার করে স্থানীয় মোটরসাইকেল মেকানিক আনিসুর রহমান গণমাধ্যম কর্মীদের জানিয়েছেন, আশরাফ আলীর তৈরি ইঞ্জিন অয়েল তিনি অনেকবার বিভিন্ন মোটরসাইকেলে ব্যবহার করেছেন। কোনো ত্রুটি পাননি। আর সাধারণ ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা বলছে, আশরাফ আলীর ভেষজ মবিলের ব্যবহারে ধোঁয়া কিছুটা বেশি হয়। তবে ইঞ্জিনের পারফরম্যান্স ভালো ছিল। তাদের মতে, আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় এই তেল আরও কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব করা সম্ভব।

উদ্ভাবন বিষয়ে ডিজিবাংলাটেক এর সঙ্গে আলাপকালে উদ্ভাবক আশরাফ বললেন, ছোটবেলায় যখন গরুর গাড়ির চাকায় তখন ভেন্নার তেল ব্যবহার করতে দেখেছি। এরপর সেনাবাহিনীতে চাকরির সময়ে এই তেল গাড়িতেও ব্যবহার করা যায় কি না তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছি। ভেরেন্ডার বীজ থেকে তেলের উপাদান করে এর মান যাচাইয়ে সায়েন্স ল্যাবে গিয়ে পরীক্ষাও করিয়েছি। তখন দেখতে পেলাম এই তেলের অ্যাসিড ভ্যালু অনেক বেশি। এরপর অনেক গবেষণা শুরু করে এতে এসিডের মাত্রা দশমিক ৯ এ নামিয়ে আনতে পেরেছি। অপরিশোধিত অবস্থায় এতে এসিড মান ২৮ এর বেশি ছিলো। তেলটি উৎপাদনের পর পরীক্ষামূলক ভাবে বেশ কয়েকজন ব্যবহারও করেছেন। এদের মধ্যে মোটর টেকনিশিয়ানও আছেন। আর এখন আমি নিজের মোটর সাইকেলে ব্যবহার কারি। তেল কিনি না। নিজের উৎপাদিত এবং পেটেন্ডকৃত পিএস লুব্রিকেন্ট দিয়ে মোটরসাইকেল চালাচ্ছি। 

বাংলাদেশ জ্বালানি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে পরীক্ষার প্রতিবেদন বলছে, এই ভেষজ তেলে এসিড ভ্যালু ছিলো ৯.৩৭৭১ এবং ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে জিএম মান ০.৯৫৪৪৭। তবে বাংলাদেশ বিজ্ঞান শিল্প গবেষণা পরিষদের নিরীক্ষা বলছে, তেলটি আরো পরিশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। 

এ বিষয়ে  বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) অবসরপ্রাপ্ত মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. নাইমুল হক  জানিয়েছেন, ভেরেন্ডা গাছ থেকে প্রাপ্ত তেলে ইঞ্জিন অয়েলের প্রাথমিক সব গুণ রয়েছে। তবে এতে কিছু অতিরিক্ত উপাদান থাথায় সঠিকভাবে পরিশোধন প্রয়োজন। তাহলে অ্যাসিড ভ্যালু কমে যাবে। তখন ইঞ্জিনে কার্বন জমার সম্ভাবনা কমে যাবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটালিয়নের ভেহেইকেল সেকশন থেকে অবসরে নেয়া উদ্ভাবক আশরাফ আলী বলেন, আমাদের দেশে কিংবা পাশের দেশ সব খানেই সব সধরনের মেশিনারিজেই ইঞ্জিন ওয়েল ব্যবহার করা হয়। তবে সবাই আমদানি করে। এই ইঞ্জিন ওয়েল আমার একমাত্র আবিষ্কার। ঝোপঝাড়-জঙ্গলের আগাছার মধ্যে এটি এম্নিতেই হয়। এটা উৎপাদন করতে গিয়ে দেখেছি খরচও অনেক কম আসে। যেখানে আমদানীকৃত ইঞ্জিন ওয়েলের দাম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পড়ে এখানে সেই খরচ পড়ে ২০০-২৫০ টাকা। 

তিনি জানিয়েছেন, ২০০৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই ভেষজ ইঞ্জিন মোবিলের উদ্ভাবন করেন তিনি। ২০০৮ সালে এই ভেষজ মবিল বাংলাদেশ জ্বালানি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা করা হয়। প্রথম পরীক্ষায় অ্যাসিডের মাত্রা কিছুটা বেশি থাকলেও পরবর্তীতে রিফাইনিংয়ের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করে একই বছর তিনি এই আবিষ্কারের পেটেন্টও নেন। তবে উন্নত প্রযুক্তিতে এই তেল রিফাইন করা গেলে এটা পৃথিবীর সেরা ইঞ্জিন ওয়েল হতে পারে বলে মনে করেন এই ইঞ্জিন। 

আলাপকালে জানাগেলো, তিন বছর বয়সী একেকটি ভেরেন্ডার এক মণ বীজ থেকে ৩ থেকে সাড়ে তিন কেজি পিএস লুব্রিকেন্ট (আশরাফ আলীর উদ্ভাবিত ভেষজ ইঞ্জিন ওয়েল) উৎপাদিত হচ্ছে। লাল এবং সাদা ভেদে তেল উৎপাদনে আধা কেজির হেরফের হয়। 

এ কাজে উদ্ভাবক চাইলেই সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন নিলফামারীর জেলা প্রশাসক মোঃ নায়িরুজ্জামান। তিনি বলেছেন, উনি আমাদেরকে লিখলে আমরাও এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে লিখবো। তখন এটা কিভাবে এক্সপ্লোর করা যায় তা ওনারা দেখবেন। 

প্রসঙ্গত, ভেন্নার তেল বর্ণহীন, স্বতন্ত্র স্বাদ এবং গন্ধ বিশিষ্ট। এটির বাষ্পীভবন মান ৩১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৫৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এবং ঘনত্ব ৯৬১ kg/m3। প্রাচীনকাল থেকেই গ্রামে গঞ্জে ভেরেন্ডের তেল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এই ভেষজ উদ্ভিদটি সম্পর্কে জানাশোনা কম থাকায় এটি নিয়ে উচ্চ বাচ্চ তেমন একটা হয় না। তবে এই তেলের উপজাতসমূহ সাবান, পিচ্ছিলকারক, হাইড্রোলিক এবং ব্রেকের তরল, রং, আবরণ, কালি, ঠান্ডা প্রতিরোধী প্লাস্টিক, নাইলন, ফার্মাসিউটিকাল ঔষধ এবং সুগন্ধি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।  

আবহমান বাংলায় ঢেকিতে কিংবা পাটায় ভেন্ডার বীজ বেটে পরে আগুনে জ্বালীয়ে ভেন্ডার তেল উৎপাদন করা হতো। তখন পেট ফাঁপায়, ক্রিমি উপদ্রবে, বৃদ্ধি বা বাতজ রোগ, কোথাও কেটে গেলে, কোনো জায়গা পুড়ে গেলে এটি ব্যবহৃত হতো। ইংরেজিতে এই তেলটি ক্যাস্টর ওয়েল নামে পরিচিত।