স্মরণ

কামরুল ইসলাম সিদ্দিক: কে বলে তুমি নেই

১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ০২:৩৮  
১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১১:৪২  
কামরুল  ইসলাম সিদ্দিক: কে বলে তুমি নেই

২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ৬৩ বছর বয়সে তিনি পাড়ি জমান স্রষ্টার সান্নিধ্যে। রাষ্ট্রিয় সম্মাননা শেষে, লাল- সবুজের পতাকায় আবৃত হয়ে সওয়ার হন অনন্ত যাত্রায়। গ্রমাীণ উন্নয়নের বাতি জ্বেলে অখন্ড অবসরে তিনি ঘুমুচ্ছেন রাজধানীর বনানী কবরস্থানে।  

দোআ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিবসটি পালিত তার প্রতিষ্ঠিত এলজিইডিতে। সীমবত পরিসরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন সেই স্মৃতিতেও ধূলি জমছে। বিশ্বব্যাংকের চোখে ‘ম্যাজিক বয়’ খ্যাত এই কীর্তিমানকে ভুলতে বসেছে নতুন প্রজন্ম। অমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধে রত এই বীর সেনাকে দফায় দফায় ‘স্বাধীনতা’ পদকের প্রস্তাবিত তালিকা থেকে বাদ পড়েছে তার নাম। 

কিন্তু গ্রমাীণ অবকাঠামোর পরতে পরতে এখনো স্বাক্ষর বহন করছে তার কর্ম। দেশীয় প্রযুক্তিতে বন্যা প্রতিরোধ,খড়া মোকাবেলায় উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশ্বকে হতবাক করে দিয়ে তিনিই প্রথম তৈরি করেন উপজেলা এবং ইউনিয়ন বুক, ডিজিটাইজড ম্যাপ, এম আই এস এবং জি আই এস আর রিমোট সেন্সিং। তিনিই প্রথম সরকারি দপ্তরে বাধ্যতামূলকভাবে কম্পিউটার ব্যবহার শুরু করেন। সরকারি সেবাকে সহজলভ্য করতে চালু করেন ডিজিটাল সেবা। বিদেশি কনসাল্টেন্ট নির্ভরতা কমিয়ে দেশেই প্রকৌশলী পেশাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যান।  বিনয়ী, সৎ এবং নীতিনিষ্ঠ এই মানুষটি সহকর্মী ও অধীনস্থদের কাছে ছিলেন অভিভাবকের মতো। তিনি সবসময় বলতেন—‘উন্নয়ন শুধু কাগজে-কলমে নয়, মানুষের জীবনে দৃশ্যমান হতে হবে।’

কর্মজীবনে এলজিইডি-এর মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে এখনো তিনি কিংবদন্তী তুল্য। গণপূর্ত, পিডিবি, ডিটিসিবি, প্রাইভেটাইজেশন কমিশন, কোথায় নেই তার ছোঁয়া। একজন মেধাবী প্রকৌশলী, দক্ষ প্রশাসক ও উন্নয়ন-দূরদর্শী হিসেবে তিনি বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছেন। তাঁর চিন্তা, কর্ম এবং নিষ্ঠা আজও প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগায়।

  • এলজিইডি প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালীকরণে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

  • ঢাকা শহরের আধুনিক পানি সরবরাহ ব্যবস্থার স্থপতি ছিলেন তিনি।

  • গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে তাঁর অবদান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে স্থায়ী ছাপ ফেলেছে।

  • সততা, কর্মনিষ্ঠা ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারার জন্য তিনি ছিলেন প্রশাসনিক মহলে এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।

 আজকের মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে ছিলো তারই নকশাকৃত ঢাকা পরিবহন সমন্বয় বোর্ডের (ডিটিসিবি)  কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) । কিন্তু তিনি ব্যক্তিবন্দনার ব্রাকেট বন্দী ছিলেন না। দলীয় ও অংশগ্রহণমূলক উদ্যোগের জনপ্রিয় উদ্যোক্তা ‘কিউআইএস’ হিসেবেই ছিলেন সমধিক পরিচিত। ছিলেন নিভৃতচারী ব্যতিক্রমী সরকারী আমলা। দেশে বোর্ড অব অ্যাক্রিডিটেশন ফর ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনিক্যাল এডুকেশন এর বিকাশে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ- আইইবি-কে শক্ত ভীতের ওপর দাঁড় করিয়ে তিনি দেশের প্রকৌশল খাতে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন জীবদ্দশাতেই। ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে তার সুদূর প্রসারী বিশেষজ্ঞ ভাবনা তাক লাগিয়েছে বিশ্বকে। তার বহু কীর্তি সারাদেশের গ্রামে আর শহরে রয়ে গেছে, বহু যুগ ধরে থাকবে। এসব করতে গিয়ে তিনি অনেকের চক্ষু-শূল হয়েছেন। তবে মাঘে-মহিষে এক ঘাটে পানি পান করানোর মোতো কূটনৈতিক ধী-শক্তি ছিলো তার প্রখর। ফলে তার সময়ে বিশ্বব্যাপী তিনি খ্যাতি অর্জন করেন সহজেই। রাষ্ট্র ও সরকারের সীমা রেখায় তিনি ছিলেন নাছোর বান্দা। তাইতো সময়ের নিয়মে সরকার বদলালেও নিজ অবস্থানে অনঢ় থেকেছেন; হেটেছেন ঋজু পথে; নত হননি, আপোস কিংবা তেলবাজিও করেননি। ভালোবেসে এগিয়ে গেছেন দুর্গম পথ। কঠীনেরে ভালোবেসে করেছেন কোমল।

ঝাকড়া চুল। সুগভীর দৃষ্টি। ঠোঁট জোড়া স্মিত হাসি। আচরণে ছিল না উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার ঠাঁট-বাট। স্মার্ট ব্যক্তিত্ব গুণে ‘বড় স্যার’ খ্যাত এই ক্ষণজন্মা। ১৯৪৫ এর মন্বন্তরের ২০ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার কৃষি উন্নয়ন সংগ্রামী মরহুম নুরুল ইসলাম সিদ্দিক ও সমাজ সেবী রত্নগর্ভা মা হামিদা সিদ্দিকের কোল জুড়ে আলো জ্বেলে পৃথিবীতে এসেছিলেন তিনি। এরপর ১৯৬২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পুরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ জয়ের পর মনোনিবেশ করেন দেশ গড়ার যুদ্ধে। এরপর ১৯৭৭ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিংয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর যেনো ঠিক এলেন আর জয় করলেন। দিগ্বিজয়ীর মতো এখনো উজ্জ্বল তারার মতো দেশের প্রকৌশলী ও প্রশাসকদের মধ্যে  আলো ছড়াচ্ছেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। আজ তার অন্তর্ধানের ১৭তম বছর। 

গীতি কবিতায় পরিচিতদের মনের গহীনে তিনি এখনো দীপ্যমান। কবির ভাষায়- তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা, কে বলে তুমি নেই, তুমি আছো মন বলে তাই। তুমি রবে নিরবে, হৃদয়ে মম- এমন ভোলোবাসায় তিনি বেঁচে থাকবেন তার কর্মে।