কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের ৮১তম জন্মদিন আজ ১৫ বছর ধরে ঝুলে আছে স্বাধীনতা পুরস্কার

২০ জানুয়ারি, ২০২৫ ১০:২৩  
কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের ৮১তম জন্মদিন আজ ১৫ বছর ধরে ঝুলে আছে স্বাধীনতা পুরস্কার

গ্রামীণ আবোকাঠামো বিনির্মাণের রূপকার কামরুল ইসলাম সিদ্দিক এর ৮১ তম জন্মদিন আজ। বিদেশী কোনো প্রেসকিপশন নয়; প্রতিবেশীর মোড়লিপনাকেও আমলে না নিয়ে এই নিভৃতচারী হয়ে উঠেছে কালপুরুষ। প্রবাদ প্রতিম হয়েও দীর্ঘ ১৫ বছরেও রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মনা বঞ্চিত তিনি। দফায় দফায় স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তির মনোনয়নে থেকেও অজ্ঞাত কারণে বাদ পড়েছেন চূড়ান্ত পর্বে।

সম্মুখ সমরের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং পরবর্তীতে স্বনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণের অন্যতম প্রকৌশলী ও নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনাবিদ হয়েও তাকে সম্মান না দিতে পারাকে মেনে নিতে পারছেন না কেউই। কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের ৮০তম জন্ম বার্ষিকীতে তাদের প্রত্যাশা, নাগরিক বঞ্চনার অন্ধকার সময় পেরিয়ে আসা নতুন বাংলাদেশ ২.০-এ দূর হবে এই অমর্যাদাকর অধ্যায়েরও।

সরকারি চাকরির প্রথা ভেঙ্গে স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মহাসড়ক নির্মাতা কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের ৮১তম জন্মদিনকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলেন অন্তর্বর্তী সরকারে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ। তিনি বললেন, জীবদ্দশায় এবং অবর্তমানেও এমন সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীল ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা না দেয়াটা দুঃখজনক। তাকে পুরস্কৃত করা মানে জাতীয় মর্যাদাকেই সমুন্বত করা। পরবর্তী প্রজন্মকে আলোর পথে পরিচালিত করা। উন্নয়নের গতিধারাকে টেকসই করা। কেনন, বাংলাদেশের সামাজিক প্রকৌশল জগতে তিনি অনন্য। সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীলতায় তিনি অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।

তিনি আরো বলেন, তিনি কেবল একজন প্রকৌশলীই ছিলেন না; বাংলাদেশে ক্ষুদ্র পানিসম্পদ, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ ও মাঝারি শহর অবকাঠামো প্রতিষ্ঠায় তিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ক্ষুদ্র জেলা পরিষদ থেকে এলজিইডি প্রতিষ্ঠা করে এটিকে আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন। পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় তার উদ্যোগে ঐতিহাসিক অনেক কাজ হয়েছে। নেপাল-ভুটান পানি চুক্তিতে আমরা সফলতা পেয়েছি। কিন্তু পরবর্তিতে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। অনেক প্রজেক্ট হলেও সামগ্রিক কাজ হয়নি। তিনি সড়ক উন্নয়নে যেভাবে ভূমি ব্যবহার, উন্নয়ন, অঞ্চল পরিকল্পনা, পানি নিষ্কাশন, বন্যা নিয়ন্ত্রণে দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়েছেন এখন তা দ্বিতীয় অধ্যায়ে নিয়ে যাওয়া সময় এসেছে। তাই তাকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্মরণ করি।

জন্মদিনে কর্মগুণে ভাস্বর এই ব্যক্তিত্বকে স্মরণ করে শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, স্ব স্ব পেশায় দক্ষ ও যোগ্য মানব সম্পদ তৈরী ও রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকান্ডে পেশাদারিত্বের মনোভাব প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার বাংলাদেশের আজকের অন্যতম প্রয়োজন। প্রয়াত কামরুল ইসলাম সিদ্দিক এ ক্ষেত্রে ছিলেন অগ্র চিন্তার মহানায়ক। তাকে আমরা যোগ্য সম্মান দিতে পারিনি, এটি আমাদেরই অযোগ্যতা। বাংলাদেশের ‌নবযাত্রায় সম্মান জানাবার এই ঘাটতি পূরণের মাধ্যমে নুতন প্রজন্মের সাথে এই কর্মবীরের পরিচয় করিয়ে দেওয়া জরুরি।

গ্রামীণ ব্যাংক এর নোবেল প্রাপ্তিতে সমান অংশীদার এলজিইডি ও কামরুল ইসলাম সিদ্দিক

নতুন বাংলাদেশে কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে অচিরেই স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হবে বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এবং বারডেম এর পরিচালনা বোর্ড সদস্য মো: শহিদুল হাসান। তার মতে, এলজিইডি’র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক এর নোবেল প্রাপ্তিতে সমান অংশীদার নিভৃতিচারী এই প্রবাদ পুরুষও।

তিনি বলেছেন, ভার্সেটাইল প্রতিভার অধিকারি ছিলেন কমরুল ইসলাম সিদ্দিকী। অনেক কিছুতেই পথিকৃত তিনি। এলজিইবি-তে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটার ব্যবহার করে চমকে দিয়েছিলেন তিনি। উনি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য আমৃত্যু কাজ করেছেন। এ জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতেন সবসময়। আরবান ট্রান্সপোর্ট বোর্ড গড়ে তুলেছিলেন। বাংলাদেশের আজকের মেট্রোরেল, পাতাল রেল তারই ফসল। উন্নত সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ বিনির্মাণে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে রাবার ড্যাম ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি খরা মৌসুমে সেচ ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। উন্নত সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা উপহার দিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে সঠিক বিনিয়োগ ও বিপননের সুযোগ করে দিয়ে গ্রামের মানুষের আর্থসামাজিব জীবন বদলে দেয়ার জন্য অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছেন। মেয়েদের ক্ষমতায়নের জন্য তাদের কর্মসংস্থানে রুরাল ট্রান্সপোর্ট ও মার্কেটিং এবং ওয়াটার সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট, জিআইএস সিস্টে চালু ইত্যাদি নানা উদ্ভাবনী কাজ তিনি করেছেন। এসব কাজের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি আনতে সচেষ্ট ছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে গ্রামীণ ব্যাংক এর নোবেল এর এলজিইডি ও কামরুল ইসলাম সিদ্দিক সমান অংশীদার। আমৃত্যু তিনি একজন আমলা হয়েও আইনের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে দেশের কল্যাণে নিরত ছিলেন। কেবল স্বপ্ন বুনে নয়; প্রতিটি কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনীতিকরা সেই ক্রেডিট নিয়ে নেয়। ফলে গত ১৫ বছরে তিনি স্বাধীনতা পদকটাও পাননি।

‘তবে নতুন বাংলাদেশে নতুন আশায় এবারও আমরা চেষ্টা করছি। অন্তবর্তী সরকার প্রধান নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মাদ ইউনূসও তাকে খুব ভালোভাবে জানেন। অতীতে তিনি তার কাজের প্রশংসাও করেছেন। আশাকরি, এবার আমরা রাষ্ট্রীয় ভাবে তাকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করতে পারবো- যোগ করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, কামরুল ইসলাম ১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নূরুল ইসলাম সিদ্দিক এবং মাতা বেগম হামিদা সিদ্দিক। কামরুল এই দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান। তিনি কুষ্টিয়াতে প্রাথমিক ও ১৯৬০ সালে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরে ১৯৬২ সালে কুষ্টিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ৩০ এপ্রিল যুদ্ধে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকৌশলী হিসেবে তিনি মুক্তি বাহিনীকে সহায়তা প্রদানে বিভিন্ন রাস্তা ও সেতুর নকশা প্রণয়ন করে যুদ্ধের অপারেশনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথমে পল্লী কর্মসূচির উপ-প্রধান প্রকৌশলী এবং পরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের আওতায় নগর নির্মাণ কর্মসূচির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী ব্যুরোতে প্রকৌশল উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার পর তিনি প্রতিষ্ঠানটির কাঠামোগত সংস্কার সাধন করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি এর প্রধান ছিলেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০০ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, ২০০০ সালে যমুনা সেতু ডিভিশন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব, ২০০০ থেকে ২০০১ পর্যন্ত গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের সচিব, ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বেসরকারীকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান এবং ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০৩ থেকে ২০০৪ মেয়াদে গ্লোবাল ওয়াটার পার্টনারশিপ-দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের চেয়ায়পার্সন ছিলেন তিনি। আর ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ৬৩ বছর বয়সে একমাত্র ছেলে সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকের বাসায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন৷