চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে চারদৃষ্টিকোণে সাইবার হুমকির উত্থান
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা 4IR-এর অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে তথ্য-প্রযুক্তি। আর 4IR একদিকে যেমন তথ্য-প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সুসংগঠিত হচ্ছে; তেমনই তথ্য-প্রযুক্তির সামগ্রিক পরিসর তথা সাইবার স্পেসকে বাড়িয়েছে বহুগুণে। এই মিথস্ক্রিয়ায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আর তথ্য-প্রযুক্তি হয়েছে একে অন্যের পরিপূরক।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অন্যতম প্রধান প্রযুক্তির মধ্যে আছে উচ্চ গতির ইন্টারনেট সংযোগ, ক্লাউড প্রযুক্তি, ডেটা সায়েন্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI), রোবোটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংস (IIoT) ইত্যাদি। এই প্রযুক্তিগুলোর অনেক কিছুই হবে ক্লাউড নির্ভর। সঙ্গত কারণেই তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহারের সাথে সাথে বাড়ছে সাইবার থ্রেট। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, ততই বাড়ছে সাইবার হুমকির ধরন। এই যেমন- এন্টি-ভাইরাস সফটওয়্যারগুলো প্রতিদিন কাজ করেছে নতুন নতুন ভাইরাস আর ম্যালওয়ার (ক্ষতিকারক সফটওয়্যার) এর বিরুদ্ধে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিকাশের সাথে সাথে মূলত চারটি দৃষ্টিকোণ থেকে সাইবার হুমকির উত্থান দেখা যায়। প্রথমত, দিনের পর দিন বাড়ছে সাইবার হুমকির পরিসর। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হাতিয়ার হিসাবে যেই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলোর কারণে পূর্বের তুলনায় এখন অনেক বেশি সংখ্যক ডিভাইস ও অবকাঠামো সাইবার স্পেসের সাথে যুক্ত হচ্ছে। বিশেষ করে ট্র্যাডিশনাল IoT ডিভাইস ছাড়াও একের পর এক যুক্ত হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল IoT এবং সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেমস।
দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে সাথে সাইবার অপরাধীরা ক্রমশ আরো বেশি দক্ষতা অর্জন করছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তিগুলোর দুর্বলতা খুঁজে বের করতে এবং সেটা কাজে লাগিয়ে আক্রমণ করার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর ক্লাউডের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে বহুলাংশে।
তৃতীয়ত, সাইবার অপরাধীদের মোটিভ এবং সংযুক্ত আক্রমণের দক্ষতা এখন আগের থেকে অনেকে বেশি। অপরাধীরা এখন বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে সুসংগঠিত ভাবে আক্রমণ করছে, এমনকি আক্রমণের পূর্বে প্রস্তুতিকালে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সহ নানাবিধ কৌশল প্রয়োগ করছেন তারা।
চতুর্থত, ইদানীং ডেটা ও ইনফরমেশনের উপর আগ্রহ বাড়ছে সাইবার অপরাধীদের।
র্যানসমওয়ার সহ বিভিন্ন ক্ষতিকর অনাকাঙ্ক্ষিত সফটওয়্যার বা ম্যালওয়ার ব্যবহার করে ডাটা আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় বা ডাটা চুরি করার হার বেড়েছে অনেক। নিরাপত্তা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ক্যাস্পারিস্কির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সাড়ে তিন লক্ষের বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারি র্যানসমওয়ার আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
এছাড়া ২০২২ সালে আগের বছরের তুলনায় নিদেনপক্ষে ২০ শতাংশ বেড়েছে সাইবার আক্রমণ।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে (4IR) সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পদক্ষপ গ্রহণ করছে। কিছু দেশ, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন, সাইবার নিরাপত্তা গবেষণা এবং উন্নয়নে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে। এছাড়া সিঙ্গাপুর, ইসরায়েল সহ বিভিন্ন দেশ সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক দক্ষ জনবল তৈরিতে মনোনিবেশ করছে। আবার অন্য কিছু দেশ, যেমন এস্তোনিয়া এবং ডেনমার্ক, জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কৌশল বিকাশে মনোনিবেশ করছে।
এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। সরকার সাইবার নিরাপত্তাকে দেশের জন্য অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয়েছে “বাংলাদেশ সাইবার সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি ২০২১-২০২৫” এবং প্রণীত হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি। স্ট্র্যাটেজিতে উদীয়মান প্রযুক্তি যেমন বিগ ডাটা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, IoT, ব্লক চেইন ইত্যাদির জন্য ভিন্ন নীতিমালা ও আইনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হয়। এছাড়া সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞে জনবল বৃদ্ধির স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের জন্য আলাদা আলাদা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যদিও কৌশলপত্রে মোটাদাগে উদীয়মান প্রযুক্তি ও জনবল তৈরির কথা বলা হয়েছে, কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপর আলোকপাতের অভাব সমন্বয়হীনতার লক্ষণ মাত্র।
অন্যদিকে এখন পর্যন্ত সরকার চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এবং তার নিরাপত্তা নীতিমালা সংক্রান্ত কোনও কৌশলপত্র তৈরি করেনি। একইসাথে স্মার্ট বাংলাদেশের ব্যানারে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে; তার প্রায় সবগুলোই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে সংযুক্ত এবং ডিজিটাল পরিসেবা ও অর্থনীতি নির্ভর। স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম স্তম্ভ হিসাবে স্মার্ট ইকোনমির কথা বলা হচ্ছে। স্মার্ট ইকোনমি যদি নির্মাণ করতে হয়ে তাহলে অবশ্যই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পর্যাপ্ত বিকাশ প্রয়োজন। স্মার্ট ইকোনমির ভিত্তি হবে স্মার্ট সাপ্লাই এবং প্রোডাকশন চেইন ম্যানেজমেন্ট, ব্লকচেইন এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) ইত্যাদি।
প্রথাগত দিকে থেকে বাংলাদেশের সাইবার সিকিউরিটি অনুশীলন খুব উন্নত মানের না হলেও মোটা দাগে সন্তোষজনক। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ই-গভরনেন্স একাডেমি এক জরিপে জানায় জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের প্রাপ্ত নম্বর ৬৭.৫৩ এবং আন্তর্জাতিক রাঙ্কিং এ ৩৫তম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
নির্দ্বিধায় এগুলো আশাব্যাঞ্জক। এই অর্জনের পেছনে বিভিন্ন পলিসি পেপার প্রণয়ন ও একাধিক সংস্থা স্থাপন যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি, ন্যাশনাল CIRT, ইত্যাদির ভূমিকা প্রধান। কিন্তু IoT বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল IoT এর নীতিমালায় সাইবার সিকিউরিটি সংক্রান্ত আলোচনার অভাব দেখা যায়।
এক পাক্ষিকভাবে সাইবার সিকিউরিটির সব দায়িত্ব সরকার বা নীতিনির্ধারকদের ওপর বর্তালেও চলবে না। সরকার যে নীতিমালা বা আইন তৈরি করবে সেটা অনেকক্ষেত্রে হতে পারে আরোপিত। এই ভাবনা থেকে উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তিবিদদের স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
সাইবার সিকিউরিটি এখন শুধুমাত্র প্রযুক্তিবিদদের বা ব্যবহারকারিদের বিষয় নয়।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, স্মার্ট বাংলাদেশসহ সব কিছুই এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি নির্ভর। এই অবস্থায় সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা একান্ত প্রয়োজন, অন্যথায় ব্যাপক পরিসরে বাড়বে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ঝুঁকি। মনে রাখতে হবে একটি শিল্প বিপ্লবের ফলে অর্থনৈতিক কাঠামোর পাশাপাশি পরিবর্তিত হয় সমাজ কাঠামো এবং মননশীলতা।
লেখক: তথ্য-প্রযুক্তিবিদ এবং বাংলাদেশ সিস্টেম এডমিনিস্ট্রেটরস ফোরাম-এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক







