সামরিক-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের নীতি-গবেষণা ও প্রস্তাবনা

গোলাম মাহফুজ জোয়ার্দার
৪ নভেম্বর, ২০২৫ ০০:৪০  
৪ নভেম্বর, ২০২৫ ১৫:০৪  
সামরিক-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের নীতি-গবেষণা ও প্রস্তাবনা

মিসাইলের মতো দূরনিয়ন্ত্রিত ক্ষেপনাস্ত্রের সঙ্গে এখন আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষুদ্র ড্রোন সামরিক সক্ষমতায় যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনায় তাই কৌশলের সঙ্গে প্রকৌশল জড়িয়ে পড়েছে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে। এক্ষেত্রে আমদানি নির্ভর যুদ্ধ সরঞ্জামের পাশাপাশি প্রযুক্তি বিনিময় ও দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে সামরিক সক্ষমতা অর্জন গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পরেও দেশের প্রতিরক্ষা খাত মূলত আমদানিনির্ভর। এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি এবং অর্থনৈতিকভাবে চাপও বটে। এমন ঐতিহাসিক মোড়ে দাঁড়িয়ে, জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে একটি আত্মনির্ভরশীল ও রপ্তানিমুখী প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। এরইমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিশেষায়িত 'প্রতিরক্ষা অর্থনৈতিক অঞ্চল' (Defence Economic Zone - DEZ) স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা এই খাতে একটি নতুন গতি সঞ্চারের ইঙ্গিত দেয়। এর মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে ড্রোন, সাইবার প্রযুক্তি ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম দেশেই উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানির সুযোগও তৈরি করবে। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদী নীতি, সরকারি সমর্থন এবং বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে, একটি সুসংগঠিত ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা শিল্প নীতি প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি, যা বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় বেসরকারি খাত ও অভিজ্ঞ সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী জাতীয় ক্ষমতা গড়ে তুলবে। 

১. সারসংক্ষেপ ও প্রস্তাবিত নীতির মূল কথা

১. ১. প্রস্তাবিত মডেল: প্ল্যাটফর্ম ও অস্ত্র উৎপাদনে বেসরকারি খাত ও সামরিক বাহিনীর ভূমিকা

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা শিল্পনীতির প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত মডেল অনুযায়ী:

বেসরকারি খাতের নেতৃত্ব: দেশের সম্ভাবনাময় বেসরকারি শিল্পগোষ্ঠী যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনের মতো প্রধান প্ল্যাটফর্ম ডিজাইন ও উৎপাদনে নেতৃত্ব দেবে। এই খাতের ব্যবসায়িক দক্ষতা, উদ্ভাবনী শক্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক চেতনা এই জটিল প্রকল্পগুলোর সফল বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব: অন্যদিকে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি - BOF, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি - BMTF) এই প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, ও ক্ষেপণাস্ত্র ডিজাইন ও উৎপাদনের দায়িত্ব পালন করবে। সামরিক বাহিনীর কৌশলগত জ্ঞান, নিরাপত্তা প্রয়োজন এবং অপারেশনাল অভিজ্ঞতা এই স্পেশালাইজড ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে কাজ করবে।

এই মডেলটি দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কের সাফল্যের মডেলের অনুরূপ, যেখানে বেসরকারি খাতের নেতৃত্বে প্ল্যাটফর্ম উৎপাদন এবং সরকারি সমন্বয়ে সাব-সিস্টেম উন্নয়ন একটি কার্যকর সমন্বয় তৈরি করেছে।

১.২. নীতি কাঠামোর মূল লক্ষ্য: আত্মনির্ভরশীলতা, রপ্তানি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা শিল্প নীতির মূল লক্ষ্য তিনটি:

কৌশলগত আত্মনির্ভরশীলতা: বিদেশি প্রযুক্তি ও আমদানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

রপ্তানি-উন্নত খাত গড়ে তোলা: আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে মানসম্মত প্রতিরক্ষা সামগ্রী রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান: প্রতিরক্ষা শিল্পকে একটি হাই-টেক শিল্প হিসেবে গড়ে তুলে দক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং জাতীয় অর্থনীতিতে একটি নতুন প্রবৃদ্ধির খাত যোগ করা।

এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য একটি ব্যাপক নীতি কাঠামোর প্রয়োজন, যা সংগঠনগত কাঠামো, অর্থায়ন কৌশল, গবেষণা ও উন্নয়ন, রপ্তানি কৌশল এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোর সমন্বয়ে গঠিত।

 ২. বাংলাদেশের বর্তমান প্রতিরক্ষা শিল্প: একটি SWOT বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নির্ধারণের পূর্বে বর্তমান অবস্থার একটি বাস্তবভিত্তিক ও গভীর বিশ্লেষণ অপরিহার্য। একটি SWOT (Strengths, Weaknesses, Opportunities, Threats) বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ খাতের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা এবং বাইরের পরিবেশের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাগুলো চিহ্নিত করতে পারি। জাতীয় প্রতিরক্ষা কলেজ (NDC) কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্যের ভিত্তিতে এই বিশ্লেষণটি উপস্থাপন করা হলো, যা একটি কার্যকর ও বাস্তবসম্মত প্রতিরক্ষা শিল্প নীতি প্রণয়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে ।

২.১. শক্তি (Strengths)

২.১.১. অভিযোজিত জনশক্তি ও কৌশলগত অবস্থান

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের অন্যতম প্রধান শক্তি হলো এর অভিযোজিত ও সম্পদশালী জনশক্তি। দেশটি শ্রম খাতে বিশ্বের অন্যতম সস্তা উৎস হওয়ায়, শিল্প উৎপাদনে শ্রম ব্যয় কম রাখা সম্ভব, যা প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা রাখে । এছাড়া, হালকা প্রকৌশল শিল্প (Light Engineering Sector) সহ বেসরকারি খাতে দক্ষ কারিগরি জনবল রয়েছে, যারা প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনে অবদান রাখার সম্ভাবনা রাখে। এই জনশক্তি দ্রুত নতুন প্রযুক্তি শিখে নিতে সক্ষম এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখিয়ে থাকে। এই অভিযোজনযোগ্যতা একটি উদীয়মান প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান, কারণ এটি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দক্ষতা নিশ্চিত করে। দেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানও একটি সম্ভাবনাময় শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যা ভবিষ্যতে আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও রপ্তানি বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে সুবিধা প্রদান করতে পারে।

২.১.২. হালকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদনে অভিজ্ঞতা 

বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই হালকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদনে কিছু পরিমাণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যা প্রতিরক্ষা শিল্পের ভিত্তি গড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি (BOF) এবং বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (BMTF) এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এই খাতে কাজ করে আসছে । এই অভিজ্ঞতা শুধু উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ব্যবস্থাপনা এবং সামরিক বাহিনীর নির্দিষ্ট প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে একটি বাস্তব জ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করেছে। এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে আরও উন্নত ও জটিল সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের পথে একটি সূচনা বিন্দু হিসেবে কাজ করতে পারে। 

২.১.৩ বিদ্যমান অবকাঠামো: বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (BMTF) ও অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি (BOF)

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হলো বিদ্যমান অবকাঠামো, বিশেষ করে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (BMTF) এবং বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি (BOF)। BMTF-এর একটি বিস্তৃত অবকাঠামো রয়েছে, যা বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে । এই প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিকদের মেশিনিং, ওয়েল্ডিং এবং ইলেকট্রনিক্সে মৌলিক দক্ষতা রয়েছে, যা নতুন উৎপাদন লাইনে দ্রুত অভিযোজনের সহায়ক। অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি (BOF) এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিজ্ঞতা এবং সামরিক বাহিনীর সাথে সরাসরি সম্পর্ক এই শক্তিকে আরও বেশি কার্যকর সহায়ক হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই অবকাঠামোকে আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তুলতে পারে।

২.২ দুর্বলতা (Weaknesses)

২.২.১ উন্নত প্রযুক্তি ও গবেষণা-উন্নয়নে ঘাটতি

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো উন্নত প্রযুক্তি ও গবেষণা-উন্নয়ন (R&D) খাতে সুস্পষ্ট ঘাটতি। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী একটি অত্যন্ত একচেটিয়া ও নিয়ন্ত্রিত, যেখানে নতুন প্রযুক্তি অর্জন করা কঠিন এবং ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের বর্তমান প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই উৎপাদন-কেন্দ্রিক, যেখানে নতুন ডিজাইন ও উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা কাঠামো ও বিনিয়োগের অভাব রয়েছে। এই প্রযুক্তিগত ব্যবধানের ফলে দেশটি স্টেট-অফ-দ্য-আর্ট প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনে পিছিয়ে পড়েছে এবং বিদেশি প্রযুক্তির ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই নির্ভরতা শুধু আর্থিকভাবে চাপ সৃষ্টি করেনি, জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও একটি ঝুঁকি তৈরি করেছে, বিশেষ করে যখন প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশগুলোর সাথে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

২.২.২. সামরিক বাহিনীর ম্যানুফ্যাকচারিং সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের মূল ভার সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ন্যস্ত। যদিও এই প্রতিষ্ঠানগুলো নির্দিষ্ট কিছু পণ্য উৎপাদনে সক্ষম, তাদের উৎপাদন ক্ষমতা, প্রযুক্তিগত জটিলতা এবং বাজার-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রধানত সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য কাজ করে, যার ফলে বাণিজ্যিক উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া, একটি সম্পূর্ণরূপে সামরিক নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা ও দক্ষতার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, যা একটি গতিশীল প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য অপরিহার্য।

২.২.৩. বেসরকারি খাতের সীমিত অংশগ্রহণ ও নীতিগত অস্পষ্টতা

বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় বেসরকারি খাত, বিশেষ করে হালকা প্রকৌশল, জাহাজ নির্মাণ, সামরিক যান উৎপাদন প্রতিরক্ষা শিল্পে তাদের অংশগ্রহণ সীমিত করেছে । এই সীমাবদ্ধতার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো একটি সুস্পষ্ট ও অনুকূল নীতিগত কাঠামোর অভাব। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর জন্য প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগের পথ স্পষ্ট নয়, লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া জটিল, এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর ও বিদেশি অংশীদারিত্বের নীতিমালা অস্পষ্ট। ফলে, এই খাতের বিশাল সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। একটি সমন্বিত ও উদার নীতি গ্রহণের মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে এই শিল্পে সম্পৃক্ত করা গেলে, দেশের প্রতিরক্ষা উৎপাদনে বৈচিত্র্য, উদ্ভাবন ও দক্ষতা বৃদ্ধি পেতে পারে।

২.৩. সুযোগ (Opportunities)

২.৩.১. বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর

বিশ্বব্যাপী প্রতিরক্ষা শিল্পে অফসেট (Offset) নীতির একটি বৃদ্ধি পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে অস্ত্র ক্রয়ের শর্ত হিসেবে বিক্রেতা দেশ ক্রেতা দেশে কিছু পরিমাণ প্রযুক্তি হস্তান্তর, যৌথ উৎপাদন বা বিনিয়োগের অঙ্গীকার করে । বাংলাদেশ তার বর্ধমান প্রতিরক্ষা ক্রয় বাজেটের সুযোগ নিয়ে এই ধরনের চুক্তি আদায় করতে পারে। এতে করে দেশে উন্নত প্রযুক্তি প্রবেশের পথ সুগম হবে এবং স্থানীয় শিল্পের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া, বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (FDI) আকর্ষণের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করলে, আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে তাদের উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে আগ্রহী হতে পারে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হবে।

২.৩.২. আঞ্চলিক বাজারে রপ্তানির সম্ভাবনা

এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও অস্ত্র রপ্তানির একটি বর্ধমান বাজার তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ যদি নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে (যেমন: হালকা অস্ত্র, গোলাবারুদ, সামরিক যান, ড্রোন, যুদ্ধজাহাজ) প্রতিযোগিতামূলক মূল্য ও গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে এই বাজারে প্রবেশের একটি ভালো সুযোগ রয়েছে। এতে করে প্রতিরক্ষা শিল্পটি শুধু সামরিক বাহিনীর চাহিদা মেটানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, একটি রপ্তানি-উন্নত খাতে রূপান্তরিত হতে পারে। এই রপ্তানি আয় দেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন প্রবাহ যোগ করবে এবং প্রতিরক্ষা শিল্পের টেকসইতা নিশ্চিত করবে।

২.৪. হুমকি (Threats)

২.৪.১. প্রযুক্তিগত নির্ভরতা ও আমদানি ঝুঁকি

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাত বিদেশি প্রযুক্তি ও উপকরণের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল। এই নির্ভরতা একটি বড় ঝুঁকি, কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতি, নিষেধাজ্ঞা বা সরবরাহকারী দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে যেকোনো সময় এই প্রযুক্তি বা উপকরণের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে করে দেশের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই, এই প্রযুক্তিগত নির্ভরতা কমিয়ে আনা এবং স্থানীয়ভাবে প্রযুক্তি উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।

২.৪.২. আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা

বিশ্ব প্রতিরক্ষা বাজারে ইতোমধ্যেই অনেক প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড় রয়েছে, যারা উন্নত প্রযুক্তি, বিশাল উৎপাদন ক্ষমতা এবং বিস্তৃত বিপণন নেটওয়ার্কের মালিক। বাংলাদেশের মতো একটি নতুন খেলোয়াড়ের পক্ষে এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা এবং নিজের অবস্থান তৈরি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। সফল হতে হলে, বাংলাদেশকে অবশ্যই নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে হবে এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্য ও গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, বিদেশি বাজারে প্রবেশের চেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে।

২.৪.৩. দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব

প্রতিরক্ষা খাতটি স্বাভাবিকভাবেই একটি গোপনীয় ও নিয়ন্ত্রিত খাত, যেখানে স্বচ্ছতার অভাব দুর্নীতির ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। ক্রয় প্রক্রিয়া, ঠিকাদারি ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা না থাকলে, দুর্নীতি ও অর্থের অপব্যবহারের সম্ভাবনা থাকে। এই ধরনের অনিয়ম শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি করে না, বরং প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের আস্থা হ্রাস করে। তাই, একটি দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।

৩. আন্তর্জাতিক তুলনামূলক বিশ্লেষণ: সফল প্রতিরক্ষা শিল্পের মডেল

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্প নীতি প্রণয়নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে তাদের প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তুলেছে। এই অধ্যায়ে আমরা দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা শিল্পের মডেল বিস্তারিতভাবে তুলে ধরব।

৩.১ দক্ষিণ কোরিয়া: বেসরকারি খাত-নেতৃত্বাধীন সাফল্যের গল্প

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পের উত্থান একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্যের গল্প, যেখানে সরকারি নীতি, বেসরকারি খাতের উদ্যোগ এবং একটি রপ্তানি-কেন্দ্রিক কৌশল একসাথে কাজ করেছে। ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা হ্রাসের পর কোরিয়া নিজস্ব প্রতিরক্ষা সক্ষমতা গড়ে তোলার ওপর জোর দেয় । এই লক্ষ্যে ২০০৬ সালে প্রতিরক্ষা অর্জন কর্মসূচি প্রশাসন (Defense Acquisition Program Administration - DAPA) প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা প্রতিরক্ষা শিল্পের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করে ।

৩.১.১.সরকারি নীতি ও DAPA-র ভূমিকা

দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার প্রতিরক্ষা শিল্পকে একটি জাতীয় কৌশলগত খাত হিসেবে গণ্য করে এবং এটি উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। DAPA-র প্রতিষ্ঠা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা প্রতিরক্ষা সংগ্রহ প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীভূত করে এবং শিল্পের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করে । সরকারি নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো "Defense Innovation 4.0" উদ্যোগ, যার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), কোয়ান্টাম প্রযুক্তি এবং অন্যান্য উদীয়মান প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ানো হয়েছে । এছাড়া, সরকার স্থানীয় পর্যায়েও প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশে উদ্যোগ নিয়েছে। 

উদাহরণস্বরূপ, সাউথ কিয়ংসাং প্রদেশে "Defense Industrial Development Plan" নামে ২০২৩-২০২৭ সালের জন্য ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে । এই উদ্যোগগুলো প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য একটি শক্তিশালী ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছে।

৩.১.২. বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী ও স্টার্ট-আপের অংশগ্রহণ

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পে বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীগুলো এবং স্টার্ট-আপগুলো উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। Hanwha, Hyundai Rotem, LIG Nex1, এবং Korea Aerospace Industries (KAI) এর মতো বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রতিরক্ষা খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে । এই কোম্পানিগুলোর বিক্রয় ২০২৪ সালে ৪৩.১ ট্রিলিয়ন ওয়ান (প্রায় ৩০.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ছাড়িয়ে গেছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ১৬% বেশি । একইসাথে, সরকার উচ্চ প্রযুক্তির স্টার্ট-আপগুলোকে উৎসাহিত করছে। EYL এবং Boss Semiconductor এর মতো স্টার্ট-আপগুলোকে জাতীয় কৌশলগত প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা তাদের সরকারি প্রকল্পে অংশগ্রহণে সুবিধা দেয় এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হয় । এই সমন্বিত পদ্ধতি প্রতিরক্ষা শিল্পে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত উন্নতিকে ত্বরান্বিত করেছে।

৩.১.৩. রপ্তানি-কেন্দ্রিক কৌশল: পরিসংখ্যান ও সাফল্য

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পের সাফল্যের মূলে রয়েছে এর রপ্তানি-কেন্দ্রিক কৌশল। ২০২০-২০২৪ সময়কালে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের দশম বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা বিশ্ব বাজারের ২.২% দখল করে । ২০২২ সালে দেশটির অস্ত্র রপ্তানি রেকর্ড ১৭.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে যায় । K2 Black Panther ট্যাংক, K9 Thunder হাউইটজার, এবং FA-50 যুদ্ধবিমানের মতো পণ্যগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। পোল্যান্ডের সাথে ২০২২ সালে ৩.৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি চুক্তি ছিল দেশটির সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা রপ্তানি চুক্তি । দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্যের পেছনে কার্যকর কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রযুক্তি হস্তান্তর, স্থানীয় উৎপাদনের সুযোগ, এবং ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য কাস্টমাইজেশন ।

সাল          রপ্তানি পরিমাণ (মার্কিন ডলারে)         মন্তব্য

২০২১           ৭.৩ বিলিয়ন                             ২০২০ সালের তুলনায় ১৫০% বৃদ্ধি

২০২২           ১৭.৩ বিলিয়ন                            রেকর্ড রপ্তানি, পোল্যান্ডের সাথে বড় চুক্তির কারণে

২০২৩          ১৩.৫ বিলিয়ন                            ২০২২ সালের তুলনায় কিছুটা হ্রাস

 

৩.২. তুরস্ক: কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ও রপ্তানি

তুরস্ক তার প্রতিরক্ষা শিল্পে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে এবং একইসাথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ন্যাটো সদস্য হিসেবে তুরস্ক উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে অ্যাক্সেস পায়, তবে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় রপ্তানিকারকদের মতো কঠোর শর্ত আরোপ করে না, যা এটিকে অনেক ক্রেতার কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে ।

৩.২.১. SSB-এর মাধ্যমে সরকারি সমন্বয়

তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের সমন্বয় সাধন করে প্রেসিডেন্সিয়াল ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি (Presidency of Defense Industry - SSB)। এই সংস্থা প্রতিরক্ষা প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা এবং বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত। SSB-এর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের একটি সমন্বিত ও কার্যকর কাঠামো গড়ে তুলতে সহায়তা করে।

৩.২.২. বেসরকারি কোম্পানির উত্থান: Baykar-এর উদাহরণ

তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। Baykar Teknoloji-এর মতো কোম্পানি বিশ্ববাজারে সাড়া ফেলেছে। Baykar-এর Bayraktar TB2 ড্রোন ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহারের পর বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পায় এবং অনেক দেশ এই ড্রোন কিনতে আগ্রহী হয় । সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০২৩ সালে ১২০টি Bayraktar TB2 ড্রোনের জন্য প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি চুক্তি করে । এই সাফল্য তুরস্কের বেসরকারি খাতের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে তুলে ধরে।

৩.২.৩. সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনে সাশ্রয়ী ও কার্যকর সমাধান

তুরস্ক তার প্রতিরক্ষা পণ্যগুলোকে সাশ্রয়ী মূল্যে এবং উচ্চ মানসম্পন্ন হিসেবে উপস্থাপন করে। Altay মেইন ব্যাটল ট্যাংক, KAAN ফিফথ-জেনারেশন যুদ্ধবিমান, এবং Anadolu L400 লাইট এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার-এর মতো প্রকল্পগুলো দেশটির উচ্চাভিলাষী প্রযুক্তিগত লক্ষ্য প্রদর্শন করে । তুরস্ক ক্রেতাদের অস্ত্র উন্নয়নে অংশীদারিত্বের সুযোগ দেয়, যা অনেক দেশের জন্য আকর্ষণীয় । এই কৌশল তুরস্ককে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় সহায়তা করছে।

৩.৩. ভারত: 'আত্মনির্ভর ভারত' নীতির অধীনে রূপান্তর

ভারত তার "আত্মনির্ভর ভারত" (Atmanirbhar Bharat) নীতির অংশ হিসেবে প্রতিরক্ষা শিল্পে ব্যাপক রূপান্তর ঘটাচ্ছে। এই নীতির লক্ষ্য হলো প্রতিরক্ষা আমদানি কমিয়ে এবং দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়ে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলা।

৩.৩.১. রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়

ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন Hindustan Aeronautics Ltd. - HAL, Bharat Electronics Ltd. - BEL) দীর্ঘদিন ধরে প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়াতে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। Visual Capitalist-এর ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, Hindustan Aeronautics এবং Bharat Electronics বিশ্বের শীর্ষ ২৫ প্রতিরক্ষা কোম্পানির তালিকায় রয়েছে, যাদের বাজার মূলধন যথাক্রমে ৩৭.৯ বিলিয়ন এবং ৩১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ।

৩.৩.২. প্রতিরক্ষা উৎপাদনে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ: পরিসংখ্যান

ভারত সরকার বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রতিরক্ষা উৎপাদনে ৭৪% বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (FDI) অনুমোদন করেছে। এছাড়া, "Make in India" উদ্যোগের অধীনে প্রতিরক্ষা ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্থানীয় উৎস থেকে ক্রয়ের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এই নীতিগুলো বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়াতে সহায়ক হচ্ছে।

৩.৩.৩. প্রযুক্তি হস্তান্তর ও বিদেশি বিনিয়োগ নীতি

ভারত বিদেশি প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগ এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরকে উৎসাহিত করছে। এই কৌশলের মাধ্যমে ভারত উন্নত প্রযুক্তি অর্জন এবং দেশীয় দক্ষতা বিকাশের চেষ্টা করছে। তবে, প্রযুক্তি হস্তান্তরে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকায় এই প্রক্রিয়াটি ধীরগতিতে এগোচ্ছে।

৩.৪. পাকিস্তান: রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান-নিয়ন্ত্রিত মডেল

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা শিল্প মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই মডেলে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বেশি এবং বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ সীমিত।

৩.৪.১. MoDP-এর অধীনে সমন্বিত কাঠামো

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা উৎপাদন মন্ত্রণালয় (Ministry of Defence Production - MoDP) প্রতিরক্ষা শিল্পের সমন্বয় সাধন করে। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কাজ করে, যারা প্রধানত দেশীয় প্রয়োজনে অস্ত্র তৈরি করে।

৩.৪.২. পাকিস্তান অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি (POF) ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা 

পাকিস্তান অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি (POF) হলো দেশটির প্রধান প্রতিরক্ষা উৎপাদনকারী সংস্থা। এছাড়া, Heavy Industries Taxila (HIT) এবং Karachi Shipyard and Engineering Works (KSEW) এর মতো অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত সামরিক বাহিনীর চাহিদা মেটাতে কাজ করে।

৩.৪.৩. বেসরকারি খাতের সীমিত অংশগ্রহণ

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা শিল্পে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ সীমিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বেসরকারি কোম্পানি প্রতিরক্ষা খাতে প্রবেশ করেছে, বিশেষ করে ড্রোন ও ইলেকট্রনিক্সের মতো ক্ষেত্রে।

৩.৫ অন্যান্য মডেল: ফিলিপাইন ও যুক্তরাজ্য

৩.৫.১ ফিলিপাইন: RA 12024-এর মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব 

ফিলিপাইন ২০২৪ সালে  Republic Act No. 12024 পাস করে, যার উদ্দেশ্য হলো দেশের প্রতিরক্ষা শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলা । এই আইনটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বকে উৎসাহিত করে এবং প্রতিরক্ষা উৎপাদনে স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন প্রণোদনা দেয় । এই আইনের মাধ্যমে ফিলিপাইন একটি সুসংগঠিত প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলার পথে এগোচ্ছে।

৩.৫.২. যুক্তরাজ্য: প্রতিরক্ষা শিল্প কৌশল ২০২৫ ও SME-দের অন্তর্ভুক্তিকরণ

যুক্তরাজ্য তার Defence Industrial Strategy 2025-এর মাধ্যমে প্রতিরক্ষা শিল্পকে একটি প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে। এই কৌশলের মূল লক্ষ্য হলো ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ (SME) গুলোকে প্রতিরক্ষা সরবরাহ শৃঙ্খলায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা। এই পদ্ধতি প্রতিরক্ষা শিল্পের টেকসইতা এবং প্রযুক্তিগত উন্নতি নিশ্চিত করে।

৪. নীতি বিকল্প ও বিশ্লেষণ

৪.১. বিকল্প ১: ব্যক্তিখাত-প্ল্যাটফর্ম ও সামরিকবাহিনী-অস্ত্র মডেল (প্রস্তাবিত)

৪.১.১. প্ল্যাটফর্ম উৎপাদনে বেসরকারি খাতের নেতৃত্ব

এই মডেলে, বেসরকারি খাতকে যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ট্যাংক, জাহাজ ও সাবমেরিনের মতো প্রধান প্ল্যাটফর্ম ডিজাইন ও উৎপাদনে নেতৃত্ব দিতে হবে। এই খাতের ব্যবসায়িক দক্ষতা, উদ্ভাবনী শক্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক চেতনা এই জটিল প্রকল্পগুলোর সফল বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সরকারি নীতি এই খাতের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যার মধ্যে রয়েছে সহজ লাইসেন্সিং, কর ছাড়, এবং বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে সুবিধা।

৪.১.২. অস্ত্র উৎপাদনে সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব

এই মডেলে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম ডিজাইন ও উৎপাদনের দায়িত্ব পালন করবে। সামরিক বাহিনীর কৌশলগত জ্ঞান, নিরাপত্তা প্রয়োজন এবং অপারেশনাল অভিজ্ঞতা এই স্পেশালাইজড ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে কাজ করবে।

৪.১.৩. এই মডেলের বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

ব্যক্তিখাত-প্ল্যাটফর্ম ও সামরিকবাহিনী-অস্ত্র মডেলটি একটি আকর্ষণীয় ধারণা হলেও এর বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, আধুনিক প্রতিরক্ষা প্ল্যাটফর্ম (যেমন যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজ) এবং সেগুলোতে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র ও সেন্সর সিস্টেমগুলো একে অপরের সাথে গভীরভাবে Integrated। এই Integration প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং এটি সাধারণত সিস্টেম ইন্টিগ্রেটরের দায়িত্বে থাকে । প্ল্যাটফর্ম ও অস্ত্রশস্ত্রের উৎপাদনে পৃথক দুটি সত্তার দায়িত্ব দিলে, এই Integration সুনিশ্চিত করতে হবে। 

৪.২. বিকল্প ২: সমন্বিত পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেল

৪.২.১. যৌথ উদ্যোগে প্ল্যাটফর্ম ও অস্ত্র উৎপাদন

এই বিকল্প মডেলে, সরকারি ও বেসরকারি খাত যৌথভাবে প্ল্যাটফর্ম ও অস্ত্র উৎপাদনে অংশ নেবে। এই মডেলে, একটি বিশেষায়িত যৌথ উদ্যোগ কোম্পানি গঠন করা হবে, যেখানে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদাররা অংশীদারিত্বে থাকবে। এই কোম্পানি পূর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা সিস্টেম উৎপাদনের দায়িত্ব পালন করবে।

৪.২.২. প্রযুক্তি হস্তান্তর ও সক্ষমতা বৃদ্ধি

PPP মডেলের মূল লক্ষ্য হবে প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে স্থানীয় দক্ষতা বৃদ্ধি করা। বিদেশি অংশীদারদের সাথে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত প্রযুক্তি শিখে নিতে পারবে এবং ধীরে ধীরে নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারবে।

৪.২.৩. ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন কৌশল

এই মডেলটি ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে, কম জটিল সিস্টেমগুলোতে যৌথ উদ্যোগ শুরু করা হবে এবং পরবর্তীতে, অভিজ্ঞতা অর্জনের পর, আরও জটিল প্রকল্পে অগ্রসর হওয়া যাবে। এই পদ্ধতি ঝুঁকি কমিয়ে এবং সফলতার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবে।

৫. প্রতিরক্ষা শিল্প নীতির জন্য একটি ব্যাপক কাঠামো

৫.১. সংগঠনগত কাঠামো ও শাসন

৫.১.১. একটি জাতীয় প্রতিরক্ষা শিল্প কর্তৃপক্ষ (NDIA) প্রতিষ্ঠা 

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের সুসংগঠিত বিকাশের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা শিল্প কর্তৃপক্ষ (National Defence Industry Authority - NDIA) প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। এই কর্তৃপক্ষটি প্রতিরক্ষা শিল্পের সামগ্রিক নীতি প্রণয়ন, সমন্বয়, তদারকি এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করবে। এটি একটি বেসামরিক সংস্থা হবে, যা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে কাজ করবে, যাতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সরাসরি নির্দেশনা ও সমর্থন নিশ্চিত করা যায়।

৫.১.২. সামরিক বাহিনী, বেসরকারি খাত ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়

NDIA-র অধীনে একটি জাতীয় প্রতিরক্ষা শিল্প সমন্বয় কমিটি গঠন করা প্রয়োজন, যার সদস্য হবেন সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি, বেসরকারি খাতের নেতৃবৃন্দ, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ এবং সরকারি কর্মকর্তারা। এই কমিটি নিয়মিত বৈঠক করে প্রতিরক্ষা শিল্পের চাহিদা, সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করবে এবং NDIA-কে পরামর্শ প্রদান করবে।

৫.১.৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ

প্রতিরক্ষা শিল্পের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য একটি অনলাইন পোর্টাল চালু করা প্রয়োজন, যেখানে নীতিমালা, লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া, টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি এবং প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করা হবে। এছাড়া, একটি স্বতন্ত্র অডিট ও ওভারসাইট কমিটি গঠন করা হবে, যা প্রতিরক্ষা শিল্পের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর নজর রাখবে। 

৫.২. অর্থায়ন ও বিনিয়োগ কৌশল

৫.২.১. প্রতিরক্ষা বাজেটে গবেষণা-উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ

প্রতিরক্ষা শিল্পের টেকসই বিকাশের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) পর্যাপ্ত বিনিয়োগ অপরিহার্য। সরকার প্রতি বছর প্রতিরক্ষা বাজেটের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ (যেমন ৫%) R&D-এর জন্য বরাদ্দ রাখবে। এই অর্থ NDIA-র মাধ্যমে বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে বিতরণ করা হবে।

৫.২.২. বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (FDI) আকর্ষণের নীতি

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের দ্রুত বিকাশের জন্য বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (FDI) একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে। FDI শুধুমাত্র মূলধনের প্রবাহই নয়, বরং এর সাথে আধুনিক প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশাধিকারও আসে। ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, বাংলাদেশের FDI নীতি সুস্পষ্ট, স্থিতিশীল এবং বিনিয়োগকারী-বান্ধব হওয়া উচিত। ভারত ২০২০ সালে তাদের প্রতিরক্ষা খাতে FDI সীমা স্বয়ংক্রিয় পথে ৪৯% থেকে বাড়িয়ে ৭৪% এবং সরকারি পথে ১০০% পর্যন্ত বাড়িয়েছে । তবে, এই উদারীকরণ সত্ত্বেও ভারতে প্রত্যাশিত মাত্রায় FDI আসেনি, কারণ নীতিগত দ্বিধা, জটিল নিরাপত্তা ছাড়পত্র প্রক্রিয়া এবং IPR সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে । বাংলাদেশের উচিত এই সমস্যাগুলো এড়িয়ে চলা। একটি সুপারিশ হতে পারে, পণ্যের সংবেদনশীলতার ভিত্তিতে বিভিন্ন স্তরের FDI সীমা নির্ধারণ করা। উদাহরণস্বরূপ, কম প্রযুক্তিগত উপাদান এর জন্য ১০০% FDI অনুমোদন করা যেতে পারে, যেখানে উচ্চ-প্রযুক্তিগত কৌশলগত সিস্টেম (Missiles, Electronic Warfare Systems) এর জন্য কম সীমা রাখা যেতে পারে । এছাড়াও, একটি  Single-Window ছাড়পত্র ব্যবস্থা চালু করা এবং IPR আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

৫.২.৩. বেসরকারি খাতের জন্য আর্থিক প্রণোদনা ও ঋণ সুবিধা

বেসরকারি খাতকে প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে কর ছাড়, শুল্ক ছাড়, এবং সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে একটি বিশেষ প্রতিরক্ষা শিল্প উন্নয়ন তহবিল গঠন করা সম্ভব, যা বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে R&D এবং উৎপাদন সুবিধা স্থাপনে সহায়তা করবে।

৫.৩. গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D)

৫.৩.১. একটি জাতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা (NDRO) গঠন

উন্নত প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য একটি জাতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা (National Defence Research Organisation - NDRO) গঠন করা প্রয়োজন। এই সংস্থাটি মূলত গবেষণা ও উন্নয়নে নেতৃত্ব দেবে এবং বেসরকারি খাতের জন্য একটি প্রযুক্তি সহায়তা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে।

৫.৩.২. বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারিত্ব

NDRO বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলবে। এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে, একাডেমিক গবেষণা ও প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রয়োজনের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি হবে। গবেষণা প্রকল্পের জন্য যৌথ অর্থায়ন এবং ছাত্রদের জন্য ইন্টার্নশিপের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।

৫.৩.৩. ইনোভেশন ও স্টার্ট-আপ ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা

উদ্ভাবনী শক্তিকে উৎসাহিত করার জন্য একটি প্রতিরক্ষা ইনোভেশন ফান্ড গঠন করা হবে। এই ফান্ড স্টার্ট-আপ, MSME এবং একক উদ্ভাবকদের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উন্নয়নে অর্থায়ন করবে। এছাড়া, নিয়মিত প্রতিরক্ষা হ্যাকাথন ও চ্যালেঞ্জ আয়োজন করা হবে, যাতে নতুন ধারণা ও সমাধান বেরিয়ে আসে।

৫.৪. রপ্তানি কৌশল

৫.৪.১. লক্ষ্যযুক্ত বাজার চিহ্নিতকরণ ও বিপণন

রপ্তানির জন্য প্রথমে এশিয়া ও আফ্রিকার সুনির্দিষ্ট কয়েকটি দেশকে লক্ষ্যযুক্ত বাজার হিসেবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। একটি কার্যকর বিপণন কৌশল গ্রহণ করা সম্ভব, যার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ, কূটনৈতিক সহযোগিতা এবং অনলাইন বিপণন।

৫.৪.২. প্রযুক্তি হস্তান্তর ও যৌথ উৎপাদন চুক্তি

রপ্তানি চুক্তির অংশ হিসেবে প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং ক্রেতা দেশে যৌথ উৎপাদনের প্রস্তাব দেয়া প্রয়োজন। এই কৌশলটি দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্যের মূল কারণ, যা ক্রেতা দেশগুলোর নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলার আগ্রহকে পূরণ করে ।

৫.৪.৩. একটি প্রতিরক্ষা রপ্তানি প্রচার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা

রপ্তানি বাড়াতে একটি প্রতিরক্ষা রপ্তানি প্রচার কেন্দ্র (Defence Export Promotion Centre) প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এই কেন্দ্রটি বিদেশি ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন, চুক্তি চূড়ান্তকরণ এবং রপ্তানি-পরবর্তী সেবা প্রদানে সহায়তা করবে।

৫.৫. নিয়ন্ত্রক কাঠামো

৫.৫.১. প্রতিরক্ষা শিল্প আইন প্রণয়ন

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের সুশৃঙ্খল বিকাশের জন্য একটি সুস্পষ্ট ও সর্বাঙ্গীন প্রতিরক্ষা শিল্প আইন প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি। এই আইনটি শিল্পের বিভিন্ন দিক, যেমন লাইসেন্সিং, মান নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, এবং IPR সুরক্ষার বিধান নির্ধারণ করবে।

৫.৫.২. লাইসেন্সিং, মান নিয়ন্ত্রণ ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ

NDIA-র অধীনে একটি লাইসেন্সিং ও মান নিয়ন্ত্রণ বোর্ড গঠন করা প্রয়োজন। এই বোর্ড প্রতিরক্ষা উৎপাদনের জন্য লাইসেন্স ইস্যু করবে এবং পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করবে। রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি স্বতন্ত্র সেল থাকবে, যা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও নীতিমালা মেনে চলবে।

৫.৫.৩. IPR সুরক্ষা

বেসরকারি খাত ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করার জন্য IPR সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিরক্ষা শিল্প আইনে IPR সুরক্ষার বিধান স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে এবং এর কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে। এটি উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের আস্থা বাড়াবে।

৬. সুপারিশ ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা

৬.১. আইনি ও নিয়ন্ত্রক পরিবর্তন

৬.১.১. প্রতিরক্ষা শিল্প উন্নয়ন ও সমর্থন আইন (DIDSA) প্রণয়ন

প্রস্তাবিত নীতি বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হবে একটি সর্বাঙ্গীন প্রতিরক্ষা শিল্প উন্নয়ন ও সমর্থন আইন (Defence Industry Development and Support Act - DIDSA) প্রণয়ন করা। এই আইনে প্রতিরক্ষা শিল্পের সংগঠনগত কাঠামো, অর্থায়ন কৌশল, R&D, রপ্তানি এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোর বিস্তারিত বিধান থাকবে। 

৬.১.২. বিদেশি বিনিয়োগ নীতিতে সংশোধন

বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বিদ্যমান বিদেশি বিনিয়োগ নীতিতে সংশোধন প্রয়োজন। প্রতিরক্ষা খাতে FDI-র সীমা শিথিল করতে হবে এবং একটি সুস্পষ্ট ও বিনিয়োগকারী-বান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। "এক জানালা" ছাড়পত্র ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

৬.১.৩. রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইন (ECA) প্রণয়ন

প্রতিরক্ষা সামগ্রী রপ্তানির জন্য একটি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইন (Export Control Act - ECA) প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এই আইনটি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, দ্বৈত ব্যবহার প্রযুক্তি এবং জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করবে।

৬.২. স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা

৬.২.১. স্বল্পমেয়াদি (১-৩ বছর): নীতি কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি

প্রথম বছর: DIDSA, ECA এবং FDI নীতির খসড়া তৈরি ও পার্লামেন্টে পাস করানো। NDIA ও NDRO-র আইনগত কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা।

দ্বিতীয় বছর: NDIA ও NDRO-র কার্যক্রম শুরু করা। প্রতিরক্ষা অর্থনৈতিক অঞ্চল (DEZ)-এর অবকাঠামো উন্নয়ন শুরু করা।

তৃতীয় বছর: DEZ-এর প্রথম পর্যায়ের উদ্বোধন। বেসরকারি খাতের জন্য লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজ করা এবং প্রথম যৌথ উদ্যোগ চুক্তি স্বাক্ষর।

৬.২.২. মধ্যমেয়াদি (৩-৭ বছর): সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন 

চতুর্থ থেকে  পঞ্চম বছর: BOF, BMTF এবং অন্যান্য সামরিক প্রতিষ্ঠানের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ। বেসরকারি খাতের সাথে প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তি বাস্তবায়ন।

ষষ্ঠ থেকে সপ্তম বছর: হালকা অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং সহায়ক সরঞ্জামে পূর্ণ দেশীয় উৎপাদন শুরু। যুদ্ধজাহাজ উৎপাদন শুরু।

৬.২.৩. দীর্ঘমেয়াদি (৭-১০ বছর): রপ্তানি বাজারে প্রবেশ ও আত্মনির্ভরশীলতা

অষ্টম থেকে নবম বছর: যুদ্ধবিমান, ট্যাংক মতো প্রধান প্ল্যাটফর্মের দেশীয় উৎপাদন শুরু। যুদ্ধজাহাজ রপ্তানি চুক্তি স্বাক্ষর।

দশম বছর: প্রতিরক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন এবং রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা।

৭. উপসংহার

৭.১ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের সম্ভাবনা

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের সম্ভাবনা অপার। দেশের অভিযোজিত জনশক্তি, কৌশলগত অবস্থান এবং বিদ্যমান অবকাঠামো একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলার ভিত্তি গড়ে তুলেছে। তুরস্ক ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর অভিজ্ঞতা দেখায় যে, সঠিক নীতি ও সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি আত্মনির্ভরশীল ও রপ্তানিমুখী প্রতিরক্ষা খাত গড়ে তোলা সম্ভব।

৭.২. একটি সুসংহত ও কার্যকর নীতির গুরুত্ব

তবে, এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে একটি সুসংহত, দীর্ঘমেয়াদি এবং কার্যকর নীতি কাঠামো অপরিহার্য। এই নীতি কেবল সামরিক বাহিনীর চাহিদা পূরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং জাতীয় অর্থনীতি ও নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কাজ করবে।

৭.৩. জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলা

প্রস্তাবিত নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধুমাত্র একটি আত্মনির্ভরশীল প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলবে না, বরং একটি নতুন অর্থনৈতিক খাত সৃষ্টি করবে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার, সামরিক বাহিনী, বেসরকারি খাত এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।

 


লেখক: চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার, সীবিচ৭৭ লিমিটেড


দ্রষ্টব্য: অভিমত-এ প্রকাশিত পুরো মতামত লেখকের নিজের। এর সঙ্গে ডিজিটাল বাংলা মিডিয়া কর্তৃপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বহুমতের প্রতিফলন গণমাধ্যমের অন্যতম সূচক হিসেবে নীতিগত কোনো সম্পাদনা ছাড়াই এই লেখা প্রকাশ করা হয়। এতে কেউ সংক্ষুব্ধ বা উত্তেজিত হলে তা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।