একদিনে বেকার হবে লাখ লাখ দক্ষ জনবল?
টিকিট ব্লকিং, কৃত্রিম সংকট এবং মূল্য কারসাজি প্রতিরোধ করে বিমানের টিকিট বিতরণে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (জিডিএস), নিউ ডিস্ট্রিবিউশন ক্যাপাবিলিটি (এনডিসি) এবং এপিআই-ভিত্তিক ডিজিটাল চ্যানেলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে ১৩ নভেম্বর ‘বেসামরিক বিমান চলাচল (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫’ এবং ‘বাংলাদেশ ট্রাভেল এজেন্সি (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) সংশোধন অধ্যাদেশ-২০২৫’-এর খসড়া অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। তবে অধ্যাদেশের কতিপয় ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে ১৫ নভেম্বর, শনিবার রাজধানীর হোটেল ভিক্টরির সামনে আটাবের সাধারণ সদস্যবৃন্দ ব্যানারে মানববন্ধন করছে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সদস্যরা। মানবন্ধন থেকে তারা হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, এই আইন বাস্তবায়নের দিনই ট্রাভেল এজেন্সি, হজ এজেন্সি এবং রিক্রুটিং এজেন্সির প্রায় লাখ লাখ দক্ষ জনবল একদিনে বেকার হয়ে যাবে।
মানব বন্ধনের পর ট্রাভেল এজেন্সি, হজ এজেন্সি ও রিক্রুটিং এজেন্সির পক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে আটাবের সাবেক সভাপতি এস. এন. মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব বলেছেন. অধ্যাদেশটি কার্যকর হলে দেশের প্রায় ৬ হাজার ট্রাভেল এজেন্সি, ১৪০০ হজ এজেন্সি এবং ২৭০০ রিক্রুটিং এজেন্সি সরাসরি ঝুঁকিতে পড়বে। কারন নতুন অধ্যাদেশে ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসা পরিচালনার এজেন্সিকে আয়াটার টিকেট সেলিং প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে হবে। অথচ দেশে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার লাইসেন্সধারী ট্রাভেল এজেন্সি থাকলেও এর মধ্যে মাত্র ১ হাজারের মতো এজেন্সির আয়াটায় যুক্ত। ফলে নতুন অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন হওয়ার দিনই বাকী ট্রাভেল এজেন্সিগুলো কার্যত ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হবে। তাদের উপর নির্ভরশীল এজেন্সিগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। এতে ট্রাভেল এজেন্সি, হজ এজেন্সি ও রিক্রুটিং এজেন্সির লাখ লাখ দক্ষ জনবল বেকার হবে। নতুন অধ্যাদেশে এমন সব ধারা সংযোজন করা হয়েছে যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি করবে। এর মধ্যে রয়েছে পরিবারের সদস্যদের তথ্যাদি দাখিল বাধ্যতামূলক করা, ঋণসংক্রান্ত সিআইবি অনুমোদন, অফলাইনে ১০ লাখ এবং অনলাইনে ১ কোটি টাকা ব্যাংক জামানত রাখা, বার্ষিক আর্থিক বিবরণী প্রদানের শর্তে লাইসেন্স নবায়ন এবং বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনার ওপর কঠোর শর্ত আরোপ।
এসব বিধান বাস্তবায়িত হলে দেশের পর্যটন শিল্পে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হবে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন সেগুলো প্রত্যাহার করার দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
সংবাদ সম্মেলনে এস. এন. মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব জানান, বিশ্বের সব দেশে ট্রাভেল এজেন্সির এজেন্ট টু এজেন্ট (বি টু বি) ব্যবসার প্রচলন রয়েছে। তবে এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে বি টু বি ব্যবসা বাংলাদেশে বন্ধ করা হচ্ছে। অর্থাৎ এক ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে অন্য ট্রাভেল এজেন্সির টিকিট ক্রয়-বিক্রি করতে পারবে না। বি টু বি বন্ধের ফলে সব ট্রাভেল এজেন্সিকে আয়াটা নিয়ে হবে যার খরচ প্রায় ৩০ লাখ টাকা। এর সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর টিকেটের জন্য আরও অতিরিক্ত ২২ লাখ টাকা জমা দিতে হবে। ৯০ শতাংশ ট্রাভেল এজেন্সির এতো টাকা নাই। এর ফলে সব এজেন্সিগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি (ওটিএ) শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে মালিকরা বিদেশে পাড়ি জমালেও মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা পূর্বেই অনুরোধ করেছিলাম নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত ওটিএ ব্যবসা স্থগিত রাখতে। কিন্তু তা না করায় প্রতারকরা নির্বিঘ্নে দেশ ছাড়তে পেরেছে, এবং এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”
তিনি অভিযোগ করেন, ওটিএ জালিয়াতির ঘটনায় সাধারণ মানুষ ও ক্ষুদ্র ট্রাভেল এজেন্সিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মন্ত্রণালয় ব্যর্থতা আড়াল করতে এখন সাধারণ ট্রাভেল এজেন্সির ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, “সংসদে পাশ করা আইন পরিবর্তন করে নতুন অধ্যাদেশের মাধ্যমে কিছু বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এই অধ্যাদেশ জারি হলে দেশের বেশিরভাগ ট্রাভেল এজেন্ট ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা চাই আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে সকলের স্বার্থ রক্ষায় সমাধান বের হোক। সরকার যেন হাজারো ট্রাভেল উদ্যোক্তা ও কর্মীর ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে না ঠেলে দেয়।”
সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “নতুন আইন যেন আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার হাতিয়ার না হয়ে যায়; বরং একটি সুষ্ঠু, টেকসই ও ন্যায্য ট্রাভেল শিল্প গড়ে তুলতে সহায়ক হয়।”
মানববন্ধনে আটাবের সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ মহলের দৃষ্টি আর্কষনপূর্বক ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসার স্বার্থবিরোধী আইনের ধারা সংশোধন করতে হবে এবং ট্রাভেল এজেন্সি মালিকদের ব্যবসা করার বাধাসমূহ ত্বরান্বিত করতে হবে। একইসঙ্গে অধ্যাদেশ-২৫ এর কয়েকটি ধারা বাতিলের দাবি জানান তিনি।
এ সময় সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে সাধারন সদস্যরা বলেন, দেশের ভ্রমণ ও পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে ব্যবসাবান্ধব ও ন্যায্য আইন প্রণয়ন করা হোক। খসড়া আইনের বিতর্কিত ধারা সংশোধন করে একটি বাস্তবসম্মত, অংশগ্রহণমূলক আইন প্রণয়নই এখন সময়ের দাবি বলে জানান তারা।
প্রসঙ্গত অধ্যাদেশের খসড়ায় প্রথমবারের মতো ‘যাত্রীসেবা নিশ্চিতকরণ’ শব্দগুচ্ছ আইনের শিরোনাম ও প্রস্তাবনায় যুক্ত করা হয়েছে। যা যাত্রীদের নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য ও অধিকার রক্ষাকে সুশাসনের অংশ হিসেবে আইনি বাধ্যবাধকতায় পরিণত করেছে। এছাড়া বিদেশি বিমান সংস্থার জন্য জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) নিয়োগ ঐচ্ছিক করা হয়েছে। যা আন্তর্জাতিকভাবে সেরা চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দেশিয় বিমান সংস্থাগুলোকেও জিএসএ নিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়েছে। টিকিট বিক্রিতে যেকোনো প্রকার দুর্বৃত্তায়ন, প্রতারণা বা যাত্রী হয়রানির ক্ষেত্রে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড ও এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা দূর করে নতুন অধ্যাদেশে নিবন্ধন সনদ বাতিল বা স্থগিতের ১১টি নতুন কারণ যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অবৈধ টিকিট বিক্রয়, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, তৃতীয় দেশের টিকিট বেচাকেনা এবং গ্রুপ বুকিংয়ের ক্ষেত্রে টিকিট কনফার্মের পর যাত্রীর তথ্য পরিবর্তনকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এছাড়া প্রথমবারের মতো এয়ার অপারেটরদের ট্যারিফ দাখিল ও তদারকির বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বৈশ্বিক পরিবেশ ও টেকসই নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ অধ্যাদেশ কর্তৃপক্ষকে বিমান চলাচলের কার্বন নিঃসরণ কমাতে টেকসই বিমান জ্বালানির ব্যবহার ও পরিবেশবান্ধব পরিচালন নীতি গ্রহণের ক্ষমতা দিয়েছে। একইসঙ্গে সরকারকে ‘সিভিল অ্যাভিয়েশন ইকোনমিক কমিশন’ গঠনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এ কমিশন আর্থিক স্বচ্ছতা ও ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে বিমানবন্দরের ফি, চার্জ ও ভাড়া নির্ধারণ করবে।
অধ্যাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ব্লকচেইন এবং ডিজিটাল সিস্টেমকে সাইবার নিরাপত্তা ও ফ্রন্টিয়ার প্রযুক্তিতে ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে বেসামরিক বিমান চলাচল খাত আরও স্মার্ট ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠবে।
এ অধ্যাদেশ শিকাগো কনভেনশন, আইসিএও সংযোজনী এবং বৈশ্বিক সুশাসনের নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়াবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
ডিবিটেক/এসএস/ইক







