এক সপ্তাহের ফ্যাক্টসফাইল

সংবেদনশীল ক্যাপশনে ৭ ভাইরাল গুজব

১৬ নভেম্বর, ২০২৫ ১৬:০০  
সংবেদনশীল ক্যাপশনে ৭ ভাইরাল গুজব

‘ব্যারিস্টার ফুয়াদের আপত্তিকর ছবি ফাঁস’ শিরোনামের একটি ফটোকার্ড প্রথমে ‘দৈনিক আজকের কণ্ঠ’ পত্রিকার ফেসবুক পেইজে পোস্ট করা হয়। এরপর এটি ‘কাঠেরকেল্লা’ সহ বেশ কিছু পেইজে পুন:পোস্ট করা হয়। এ হাত, সে হাত হয়ে রীতিমত ভাইরাল।  প্রকৃতপক্ষে, এটি ভারতীয় একটি পর্ন ওয়েবসাইট (ভিডিও থেকে)  থেকে নেয়া একজন ভারতীয় ব্যক্তির ছবি। একইভাবে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা-হামলা হয়েছে নাসিরুদ্দিন পাটওয়ারির উপর’; ‘১৩ নভেম্বর আ. লীগের কোনো কার্যক্রম হতে দেয়া হবে না” কিংবা “ভ'য়ংক'র অবস্থা! ১৩ তারিখে ঢাকা লকডাউন করতে ট্রাকবোঝাই দেশীয় অস্ত্র আনছিল আওয়ামী লীগ! সেনাবাহিনীর অভিযানে জব্দ!”- এমন সহিংস শিরোনামে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হলো গুজব। আর মুর্হূতেই সেই গুজব হলো ভাইরাল। শুধু তাই না, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনাতে ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে দাবি করে ছড়িয়ে দেয়া হলো ভিন্ন ঘটনার পুরোনো ভিডিও। এই তিনটি ভাইরাল ঘটনার আসল বিষয়টি দেখা যাক ফ্যাক্ট চেকে।

‘জাতীয় নাগরিক পার্টি- NCP’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা’ এমন দাবিতে একটি পোস্ট  প্রায় সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। পোস্টটি ভাইরাল না হলেও ছড়াচ্ছিল আতঙ্ক। এরপর ফ্যাক্টচেক করে দেখা গেল, জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আগুন দেওয়ার দাবিটি সঠিক নয়। কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই ভুয়া এই দাবিটি প্রচার করা হয়েছে। তাপসি তাবাস্সুম উর্মি নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে এই মিথ্যা পোস্ট করা হয়। এরপর শেযার হতে থাকে। গেল কয়েকমাস ধরেই এই ফেসবুক পেজ থেকে অন্তত ৬০টির মতন অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে। 

এদিকে ‘বিএনপিকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের কারণে এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর উপর যুবদল নেতা নয়নের নেতৃত্বে হামলা হয়েছে’। এমন একটি ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করা হচ্ছে। তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে জানা গেল দাবিটি মিথ্যা। ভিডিওটি ভিন্ন ঘটনার। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ৪৩তম বিসিএস নন-ক্যাডার চাকরিপ্রত্যাশীদের সড়ক অবরোধের ভিডিও এটি। সেটাকেই এই মিথ্যা দাবিতে ছড়ানো হয়েছে। 

ওদিকে, “ড.ইউনুস গৃহবন্দি” এমন শিরোনামে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার ফটোকার্ডের ডিজাইন সংবলিত একটি ফটোকার্ড ফেসবুকে প্রচার হচ্ছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা গেল, দাবিটি মিথ্যা। কালের কণ্ঠ এমন কোনো প্রতিবেদন বা ফটোকার্ড প্রকাশ করেনি। কালের কণ্ঠের ফটোকার্ডের প্রচলিত ডিজাইন নকল করে ভুয়া ফটোকার্ডটি তৈরি করা হয়েছে। 

অপতথ্য আরো আছে। একটি নাশকতার ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করে দাবি করা হলো, “ড.ইউনূসের বাসভবন যমুনায় ককটেল হামলা।” তবে নিখুঁতভাবে ভিডিওটি বিশ্লেষণ করে জানা গেল, এই দাবিটিও সঠিক নয়। ভিডিওটি গত ১১ নভেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডির ১১-এ সড়কে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনার। এটাকেই মিথ্যা দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।  একইভাবে প্রধান উপদেষ্টার অসুস্থতা নিয়ে জনকণ্ঠের নামে ছড়ানো ফটোকার্ডটি ভুয়া বলে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানটি বাংলাফ্যাক্টকে নিশ্চিত করেছে।

এছাড়াও ‘১৩ নভেম্বর আ. লীগের কোনো কার্যক্রম হতে দেয়া হবে না’ শিরোনামে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এইচ এম শাহাদাত হোসাইনের বক্তব্যের ভিডিওটিগুলো অনলাইনে বেশ ছড়িয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই- এর সাহায্যে বিকৃত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) বাংলাফ্যাক্ট টিম। তিনটি ডিপফেইক ভিডিও সনাক্ত করে বাংলাফ্যাক্ট জানিয়েছে, সহিংস কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি, আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা পেজগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথিত ‘লকডাউন’ কর্মসূচির সাফল্য ও জনসম্পৃক্ততা প্রমাণে সক্রিয়। তারা উসকানি দেওয়ার পাশাপাশি পুরোনো ভিডিও এবং এআই প্রযুক্তির সাহায্যে বিকৃত করে তৈরি করা ভুয়া কনটেন্ট ব্যাপকভাবে প্রচার করছে। এসব প্রোপাগান্ডায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ডিপফেইক ভিডিও তৈরি করেও প্রচার করা হয়েছে। 

একই দিনকে কেন্দ্র করে নেটদুনিয়ায় ছড়ায়- “ভ'য়ংক'র অবস্থা! ১৩ তারিখে ঢাকা লকডাউন করতে ট্রাকবোঝাই দেশীয় অস্ত্র আনছিল আওয়ামী লীগ! সেনাবাহিনীর অভিযানে জব্দ!” -লেখা একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ডিসমিসল্যাবের ফ্যাক্টচেকে দেখা গেছে, মূল ঘটনা বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে অসন্তোষ কেন্দ্র করে নাশকতার আশঙ্কায় সেনাবাহিনীর অভিযানের। গত ৬ নভেম্বর সাতক্ষীরা-৩ (কালীগঞ্জ-আশাশুনি) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী কাজী আলাউদ্দীন ও মনোনয়নবঞ্চিত প্রার্থী শহিদুল আলমের সমর্থকদের মধ্যে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।  গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেদিন বিকালে কালিগঞ্জ উপজেলার ফুলতলা এলাকায় অভিযান চালায় কালিগঞ্জ সেনা ক্যাম্পের বিশেষ টহল দল। অভিযানে সেনাসদস্যরা চারজনকে আটক করে ঘটনাস্থল থেকে লাঠি, ইট, পাটকেল, গুলতি, লোহার পাইপ ও ধারালো লোহার টুকরা উদ্ধার করেন। 

আওয়ামীলীগের ডাকা ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচির প্রস্তুতি দাবিতে উক্ত পোস্টগুলোতে মোট পাঁচটি ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওগুলো সম্পর্কে জানার জন্য এগুলো নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ এবং কি-ওয়ার্ড সার্চ করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশের মূলধারার কিছু সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী ভিডিওগুলো সাম্প্রতিক সময়ের নয়।  গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের তারিখ আগামী ১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে ঘোষণা করা হবে। এই দিন ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। সজীব ওয়াজেদ জয়ের ফেসবুক পেজ থেকেও ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলো এই ঘটনার অনেক আগের। 

তাই সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলোর উপর ভিত্তি করে করা দাবিগুলোকে মিথ্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এদিকে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে ব্যারিস্টার ফুয়াদের দাবিতে প্রচারিত আপত্তিকর ছবিটি নিয়ে প্রতিবেদন আকারে একটি পোস্ট পাওয়া যায় আজকের কণ্ঠ নামের একটি ফেসবুক পেজে। গত ১৪ নভেম্বর দিবাগত রাত পৌনে একটার দিকে পোস্টটি করা হয়। এতে দাবি করা হয়, ‘গত সপ্তাহে ব্যারিস্টার ফুয়াদ ব্যক্তিগত কাজে কক্সবাজার এসে শহরের কলাতলী এলাকার একটি স্বনামধন্য হোটেলে ওঠেন। অভিযোগ উঠেছে, হোটেলের রুম সার্ভিস বয় হিসেবে কর্মরত হামজা বাথরুমের ভেন্টিলেটরে পাশে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখে ব্যারিস্টার ফুয়াদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করে।’

কিন্তু ফ্যাক্টওয়াচের পাওয়া ভিডিওগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভিডিওটিতে একটি তারিখ উল্লেখ রয়েছে। এই তারিখ অনুযায়ী, ভিডিওটি ধারণের সময় ১৩ আগস্ট ২০২৫। অর্থাৎ ফেসবুক পোস্টগুলোতে ব্যারিস্টার ফুয়াদের কথিত ছবিটি গত সপ্তাহের অর্থাৎ চলতি নভেম্বরের মাসের দাবি করা হলেও ভিডিওটিতে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এটি আগস্ট মাসে ধারণ করা।

এই পর্যায়ে ভিডিওগুলো থেকে ব্যারিস্টার ফুয়াদ দাবিতে প্রচারিত ব্যক্তিটির মুখাবয়বের একাধিক স্ক্রিনশট নেওয়া হয়। পরে বিশ্লেষণের জন্য এসব স্ক্রিনশটের সঙ্গে ব্যারিস্টার ফুয়াদের মুখাবয়ব মিলিয়ে দেখা হয়। এতে দেখা যায়, ব্যারিস্টার ফুয়াদের কপালে একটি কালো দাগ রয়েছে। যেটি  ব্যারিস্টার ফুয়াদ দাবিতে প্রচারিত ব্যক্তিটির কপালে দেখা যায়নি। বিশ্লেষণে তাদের চেহারাতেও অমিল দেখা যায়। বিশেষ করে দুজনের নাকের গঠনে ভিন্নতা রয়েছে। ভিডিওটিতে থাকা ব্যক্তিটির নাক ব্যারিস্টার ফুয়াদের তুলনায় কিছুটা চ্যাপ্টা। এসব অসঙ্গতির কারণে ফেস কম্পারিজন ডট টুল পাই নামের একটি টুলের সাহায্যে ব্যারিস্টার ফুয়াদ দাবিতে প্রচারিত ব্যক্তির ছবিটি ও ব্যারিস্টার ফুয়াদের প্রকৃত ছবি বিশ্লেষণ করা হয়। ফেস কম্পারিজন ডট টুল পাই নামের টুলটি বেলিংক্যাট দ্বারা স্বীকৃত। এটি গবেষক, অনুসন্ধানী ও নাগরিক সাংবাদিকদের নিয়ে গঠিত একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, যারা প্রায় এক যুগ ধরে বিভিন্ন ওপেন সোর্স টুল ও এই সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে কাজ করে থাকেন। এই টুলে ব্যারিস্টার ফুয়াদ দাবিতে প্রচারিত ব্যক্তির ছবিটি (ভিডিও থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট) ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে ব্যারিস্টার ফুয়াদের অন্তত তিনটি ছবি সংগ্রহের পর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ছবিগুলোর মুখাবয়বের মিল রয়েছে ৪০ শতাংশের কম এবং তারা ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি। ফেস কম্পারিজন ডট টুল পাই নামের টুলটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ছবির তুলনামূলক বিশ্লেষণ শেষে ফলাফল জানায় যে, দুই ছবির ব্যক্তি একই কিনা। যদি দুটি ছবির বিশ্লেষণে ৮০ শতাংশের ওপরে মিল পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ছবি দুটি একই ব্যক্তির হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ৮০ শতাংশের কম হলে ছবি দুটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির হবে।  এসব বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এটি নিশ্চিত হওয়া যায়, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদের আপত্তিকর ছবি দাবিতে প্রচারিত ছবিটি ভিন্ন ব্যক্তির। তাই ফ্যাক্টওয়াচ  ব্যারিস্টার ফুয়াদ দাবিতে প্রচারিত এই ছবিযুক্ত পোস্টগুলোকে মিথ্যা হিসেবে চিহ্নিত করছে। 

অপতথ্যগুলোর ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সংবেদনশীল ক্যাপশনের উপর ভর করেই গুজবগুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে ফেসবুক ফিডে। মিথ্যা তথ্যগুলো বিশ্বাসযোগ্য করতে নকল করা হচ্ছে জনপ্রিয়  গণমাধ্যমগুলোর ফটোকার্ড।সংঘবদ্ধভাবে ছড়ানোর ফলে, ভাইরাল হচ্ছে। এই বাস্তবতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয় বরং গণমাধ্যমের খবরগুলোতেই আস্থা রাখার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। 

ডিবিটেক/এফএফ/আইএইচ