তুলনামূলক পর্যালোচনা
ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেসের তুলনায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সুবিধা
প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে ইন্টারনেট সংযোগের ধরনও হয়েছে বহুমাত্রিক। পারিবারিক ও ব্যবসায়িক ইন্টারনেট সংযোগের জন্য বর্তমানে দুটি সাধারণ বিকল্প হলো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট (সাধারণত ক্যাবল, ফাইবার বা DSL এর মাধ্যমে সরবরাহকৃত) এবং ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস (FWA) ইন্টারনেট। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের রয়েছে নানা সুবিধা যা ব্যবহারকারীদের সংযোগের প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (ISP) ইতিমধ্যে ফাইবার অপটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১০০ এমবিপিএস থেকে ১ গিগাবিট পর্যন্ত উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সেবা সফলভাবে গ্রামীণ এলাকাতেও অত্যন্ত সাশ্রয়ী মূল্যে ছড়িয়ে দিয়েছে।
১. অধিক নির্ভরযোগ্যতা ও স্থিতিশীলতা
ফাইবার অপটিক বা ক্যাবল ভিত্তিক ব্রডব্যান্ড সংযোগ সাধারণত ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেসের তুলনায় অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ও স্থিতিশীল। তারযুক্ত সংযোগ আবহাওয়া, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক প্রতিঘাতের মতো পরিবেশগত প্রভাব থেকে অনেকাংশে মুক্ত থাকে। ফলে সংযোগের গুণগতমান ও ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
২. উচ্চ গতি ও ব্যান্ডউইথ
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সাধারণত ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেসের তুলনায় উচ্চতর গতি ও ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করে। বিশেষ করে ফাইবার-অপটিক ব্রডব্যান্ড গিগাবিট গতির সেবা দিতে পারে, যা উচ্চ-রেজ্যুলেশনের ভিডিও স্ট্রিমিং, অনলাইন গেমিং এবং বড় আকারের ডেটা স্থানান্তরের মতো কাজের জন্য উপযোগী। অপরদিকে, ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস স্পেকট্রামের সীমাবদ্ধতা ও সিগন্যাল শক্তির উপর নির্ভরশীল হওয়ায় এর সর্বোচ্চ গতি তুলনামূলকভাবে কম থাকে।
৩. কম ল্যাটেন্সি
ল্যাটেন্সি অর্থাৎ ডেটা ব্যবহারকারী ও ইন্টারনেটের মধ্যে যাতায়াতের সময় সাধারণত ব্রডব্যান্ড সংযোগে কম হয়। এটি ভিডিও কনফারেন্সিং, অনলাইন গেমিং ও ভয়েস ওভার আইপি (VoIP) কলের মতো রিয়েল-টাইম অ্যাপ্লিকেশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফিক্সড ওয়্যারলেস সংযোগে সিগন্যাল ট্রান্সমিশন ও সম্ভাব্য বাধার কারণে ল্যাটেন্সি বেশি হতে পারে।
৪. পরিবেশগত প্রভাবের কম সংবেদনশীলতা
তারযুক্ত অবকাঠামোর মাধ্যমে সরবরাহকৃত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বৃষ্টি, তুষারপাত, গাছপালা বা ভবনের মতো অবকাঠামো কেন্দ্রিক প্রতিবন্ধকতার প্রভাবে খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। ফলে বছরজুড়ে সংযোগ স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য থাকে।
৫. স্কেলেবল ও হালনাগাদকরণে সুবিধা
বিশেষত ফাইবার নেটওয়ার্কগুলো অত্যন্ত স্কেলেবল এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ভবিষ্যতে সহজে আপগ্রেড করা যায়। চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন প্রযুক্তি সংযোজনও তুলনামূলক সহজ। বিপরীতে, ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস স্পেকট্রাম ও যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতার কারণে আপগ্রেড প্রক্রিয়া কঠিন এবং প্রায়ই নতুন হার্ডওয়্যারে বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়।
৬. উচ্চ ডেটা ক্যাপ বা আনলিমিটেড সুবিধা
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্যাকেজগুলো সাধারণত উচ্চ ডেটা ক্যাপ বা আনলিমিটেড ডেটা সুবিধা প্রদান করে, যা ভারী ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বা একাধিক সংযুক্ত ডিভাইসসহ পরিবারের জন্য উপযোগী। অপরদিকে, ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস প্রদানকারীরা ব্যান্ডউইথ সীমাবদ্ধতার কারণে প্রায়শই কঠোর ডেটা সীমা নির্ধারণ করে। ফিক্সড ওয়্যারলেস ইন্টারনেট গ্রামীণ বা দুর্গম এলাকায় একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে, তবে তারযুক্ত অবকাঠামোভিত্তিক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গতি, নির্ভরযোগ্যতা, ল্যাটেন্সি, প্রসারমাণতা ও সামগ্রিক পারফরম্যান্সের দিক থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে শ্রেষ্ঠ। যেখানে উভয় বিকল্পই বিদ্যমান, সেখানে টেকসই ও ভবিষ্যতমুখী সংযোগের জন্য ব্রডব্যান্ডই পছন্দের শীর্ষে থাকে।
বাংলাদেশে ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস (FWA) অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে, তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নেতৃত্বে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে জনমত গ্রহণ বা সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ ছিল না। ওই সময়ে BASIS, ISPAB, BACCO এবং e-Cab-এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন কোনো পরামর্শ প্রক্রিয়াতেই অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC)-এর নেতৃত্বে একাধিক পরিবর্তন হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েকজন চেয়ারম্যানের কারণে কমিশনের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অনেক স্টেকহোল্ডার মনে করেন, এ সময়ে কমিশন সাধারণ টেলিকম অপারেটরদের স্বার্থ রক্ষায় কম সক্রিয় ছিল। একাধিক ক্ষেত্রে মনোপলি, ডুয়োপলি এমনকি সিন্ডিকেট গঠনের ঘটনা ঘটে, যেখানে কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী রাজনৈতিক সম্পর্ক ব্যবহার করে বাজার দখলের চেষ্টা করেছেন। এতে সাধারণ অপারেটরদের জন্য সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র বিনষ্ট হয়েছে।
আশা করা যায়, নতুন টেলিকম অধ্যাদেশ অনুযায়ী এফটিএসপি (Fixed Telecommunication Service Providers) অপারেটরদের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে। তবে তা তখনই সম্ভব হবে; যদি না এটি যথাযথ ব্যবস্থাপনায় থাকে এবং অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকে। ব্যবহারিক চাহিদা অনুযায়ী, ফিক্সড ওয়্যারলেস ইন্টারনেট সেবা শুধুমাত্র এফটিএসপি অপারেটরদের জন্য সংরক্ষিত থাকা উচিত। একইভাবে মোবাইল ওয়্যারলেস ইন্টারনেট থাকা উচিত সিএমএসপি (Cellular Mobile Service Providers)-এর আওতায়। এই বিভাজনটি শুধু জনস্বার্থের জন্য নয়, বরং দেশের ২,২০০টি স্থানীয় এফটিএসপি অপারেটরের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহকারী প্রায় ১০ লক্ষ পরিবারের টিকে থাকার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক, জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি, আইএসপিএবি







