অপেক্ষা করছি, একটি মেশিনের সঙ্গে প্রেম করব বলে!
জাকারিয়া স্বপন

জাকারিয়া স্বপন
এই জীবনে একজন অতিব সুন্দরী স্মার্ট মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার শখ ছিল। ব্যাপারটা কখনো হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন একটা সম্ভাবনার আলো দেখতে পাচ্ছি।
সুন্দরী নারীর সংজ্ঞা মোটামুটি সবাই জানেন। ঝামেলা হলো স্মার্ট মানুষ নিয়ে। স্মার্টের সংজ্ঞা একেক জনের কাছে, একেক রকমের। ফ্যাশনেবল কাপড়-চোপড় কিংবা সাজগোজকে অনেকেই স্মার্ট মনে করেন। নিজেকে সপ্রতিভভাবে প্রকাশ করাকে অনেকে স্মার্ট মনে করেন। গুছিয়ে যুক্তি দিয়ে কথা বলাকে কেউ কেউ স্মার্ট মনে করতে পারেন। এমনকি চমৎকারভাবে হাঁটতে পারেন, তাকেও কেউ কেউ স্মার্ট মনে করতে পারেন।
কিন্তু আমার কাছে স্মার্টের সংজ্ঞা একটু ভিন্ন। আমি যখন কোনো একটা টপিক নিয়ে কারও সঙ্গে আলাপ করছি, তাকে বিষয়টি বলছি, তখন তিনি যদি চট করে সেটা ধরতে পেরে তার নিজস্ব ডোমেইনের আলোকে সেটা ব্যাখ্যা করতে পারেন, তাহলেই তিনি একজন স্মার্ট মানুষ!
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি কিছুটা পরিষ্কার হতে পারে। ধরুন, আমি আপনাকে বললাম আমার দীর্ঘদিনের একটি ইচ্ছা হলো ‘সাফল ডান্স’ শেখা। কিন্তু কোথাও ভালো ট্রেইনার পাচ্ছিলাম না। তাই শেষমেশ একটি রোবটের কাছ থেকে ডান্স শিখতে শুরু করলাম।
আপনি হয়তো একজন ভালো নার্স। আমার এই কথা শুনে আপনার চোখ ঝলঝল করে উঠল। আপনি আমার কাঁধে ছোট একটা ধাক্কা দিয়ে বললেন যা, সত্যি? তোমার ওই রোবটটা দিয়ে কি আমরা রোগীদের সেবা দিতে পারব? ওই যে রোগীরা মন খারাপ করে থাকে, তাদের নাচ দেখাতে পারবে? তাদের হাসাতে পারবে? তাদের মন ভালো করে দিতে পারবে?
আপনি একজন স্মার্ট নার্স। আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম এতদিন!
একইভাবে একজন স্মার্ট নারীরও ইচ্ছা থাকতে পারে, একজন সুদর্শন এবং স্মার্ট পুরুষের সঙ্গে প্রেম করার এবং তিনি তার মতো স্মার্টের সংজ্ঞা তৈরি করে নিতে পারেন।
মানুষ মাত্রই স্বার্থপর। এই পৃথিবীর কতিপয় মানুষ ছাড়া সবাই স্বার্থপর। সবাই তার মতো করেই চিন্তা করে, তার মতো করেই প্রত্যাশা করে। ওই প্রত্যাশাটুকুই স্বার্থপরতা। যার কোনো প্রত্যাশা নেই, তিনি স্বার্থপর নন। প্রত্যাশাহীন মানুষ পাওয়া খুব দুষ্কর।
মা-বাবা যদি সন্তানদের কাছে কিছু প্রত্যাশা করে, সেটা তাদের স্বার্থপরতা। প্রেমিক যখন প্রেমিকাকে তার মতো করে পেতে চায়, সেটা তার স্বার্থপরতা। একজন ব্যবসায়ী যখন গ্রাহকের কাছে কিছু প্রত্যাশা করে, সেটা তার স্বার্থপরতা। প্রত্যাশার পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে স্বার্থপরতা।
আপনি কারও জন্য কিছু করলেন, আর তার বিনিময়ে কিছুই প্রত্যাশা করলেন না সেটা হলো নিঃস্বার্থ! এই গ্রহে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
এখন পর্যন্ত এই গ্রহে আমি একটি প্রজাতির মানুষ পেয়েছি, যারা নিঃস্বার্থ তারা হলেন সেনাবাহিনী। এটা বাংলাদেশ বলে নয়, পৃথিবীর সব দেশের সেনাবাহিনী। তারা নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্য, দেশের জন্য। আর কোনো প্রফেশনে এই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় না। তাই তাদের প্রতি আমার এক ধরনের বিশেষ শ্রদ্ধা রয়েছে, মমতা রয়েছে। এই গ্রহের প্রতিটি দেশের প্রতিটি সেনাবাহিনীর সদস্যকে আমি সম্মান করি। তারা স্বার্থপর নন। বিদেশের মাটিতেও যখন দেখি, তারা দল বেঁধে কোথাও যাচ্ছেন, আমি তাদের স্যালুট দেই। মনে মনে বলি হে বীর, তোমরা কখনো স্বার্থপর হইও না!
এই গ্রহের মানুষ যেমন স্বার্থপর, বাংলাদেশে হয়তো তার পরিমাণ আরও বেশি। এর মূল কারণ হয়তো আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা। আমাদের সম্পদ কম। তাই একটুখানি সম্পদ আহরণের জন্য, আমরা যতটা নিচে নামার, নেমে যেতে পারি। আমরা আরেকটি মানুষের সম্পদ জোর করে কেড়ে নিয়ে অন্যের কাছে বেশি দামে গর্বের সঙ্গে বিক্রি করে দিতে পারি, প্রয়োজন হলে তাকে মেরেও ফেলতে পারি। এই যে, আমরা প্রতিনিয়ত নানান ধরনের কলহের ভেতর জড়িয়ে যাচ্ছি, তার মূল কারণ হলো স্বার্থপরতা! আমরা কেউ এক ইঞ্চি তো ছাড়বই না, বরং অন্যের পুরোটা কীভাবে নেওয়া যায়, তার জন্য পরিশ্রমের শেষ নেই।
আমরা প্রতিনিয়ত অন্যের পেছনে লেগে আছি। কীভাবে অন্য আরেকজনকে টেনে নিচে নামানো যায়, সেই চিন্তায় দিন পার করি। আমি নিজে চেষ্টা করে ওপরে উঠব না, যে উঠেছে তাকে টেনে নিচে নামাব, যেন সে আমার সমানে আসে!
এর একটি বড় কারণ হলো, আমরা শিখতে পারিনি, কীভাবে একসঙ্গে অপরকে বিশ্বাস করে সবাই মিলে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। আমরা শিখেছি, কীভাবে অন্যকে ঠকিয়ে একা সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় এবং সেটা করার জন্য মিথ্যা বলা, চুরি করা, অন্যকে ঠকানো যত রকমের নিম্নশ্রেণির কাজ আছে, সেগুলোই করতে থাকব।
এটাই আমার দেখা বাংলাদেশ!
আপনারা ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন, এই পৃথিবী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে প্রবেশ করে গেছে। বিগত দুই যুগের বেশি সময় ধরে এটা নিয়ে ছোট ছোট কাজ হচ্ছিল। কিন্তু এখন মেশিনের ক্ষমতা এমন জায়গায় চলে এসেছে যে, মেশিন মানুষের চেয়ে বেশি জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে গেছে। এই গ্রহের মোট ‘কম্বাইন্ড নলেজ’ এখন মেশিনের কাছে আছে।
কয়েকটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। ধরুন ডাক্তারি বিদ্যা। এই গ্রহের সব ডাক্তারকে একত্র করলে যে পরিমাণ জ্ঞান হবে, তার পুরোটাই এখন মেশিনের কাছে চলে এসেছে। এই গ্রহের যত পণ্ডিত ব্যক্তি আছেন, তাদের সবাই মিলে যে জ্ঞানের ভান্ডার হবে, তার পুরোটাই এখন মেশিনের কাছে আছে। এমন অসাধারণ সময় এই গ্রহ আগে কখনই দেখেনি।
আপনি আগে কোনো সমস্যায় পড়লে, এমন একজন মানুষকে খুঁজতেন, যিনি আপনাকে একটি সৎ সমাধান বাতলে দিতে পারে। কিংবা কঠিন কোনো রোগে পড়লে, ভালো একজন ডাক্তারের খোঁজে যেতেন। কিংবা আইনি জটিলতায় পড়লে, একজন বিজ্ঞ আইনজীবী খুঁজে বের করতেন। কখনো পেতেন, কখনো পেতেন না।
এখন আপনি বিশ্বের সবচেয়ে ভালো আইনজীবীকে এক মুহূর্তেই পেয়ে যেতে পারেন। যারা চ্যাটজিপিটি কিংবা এ ধরনের সেবা ব্যবহার করতে শুরু করেছেন, তারা জানেন কী অস্বাভাবিক ক্ষমতাধর এই মেশিন। এই গ্রহের এমন কোনো বিষয় নেই, যা সেই মেশিন জানে না।
আর এটাই হলো বাংলাদেশের জন্য বিশাল সুযোগ। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, তাদের জনগণ স্মার্ট নয় (আমার ওপরে দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী)। তাদের জ্ঞানও সীমিত। একটি কক্ষে যদি ১০০ জন মানুষ নিয়ে কোনো মিটিং করেন, দেখবেন সেখানে ৯৮ জন মানুষই প্রায় মূর্খ। তাদের নিয়ে আপনি কী পরিকল্পনা করবেন, কী সমস্যার সমাধান করবেন? আপনি যা বলবেন, সেটা বোঝার এবং বুঝে আবার নিজের জায়গায় ব্যবহার করার মতো জ্ঞান তাদের তৈরি হয়নি। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আমাদের তরুণ প্রজন্মের অবস্থাও ভালো নয়!
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের এই ক্রাইসিস থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে। এ দেশ যদি ১ কোটি মানুষের মাঝে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতাটুকু বুঝিয়ে দিতে পারে, তাহলে তারা নিজেরাই মেশিনের সাহায্য নিয়ে নিজেদের অনেক সমস্যার সমাধান বের করে ফেলতে পারবে। তাদের ভেতর থেকে কয়েক হাজার স্মার্ট মানুষ বের হয়ে আসবে, যারা এমন সব জিনিস তৈরি করে ফেলবে, যা আমরা আগে চিন্তাই করিনি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টা কতিপয় উঁচুস্তরের মানুষ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আটকে না রেখে, সাধারণ মানুষকে এই বিষয়ে শিক্ষিত করতে হবে। তরুণ থেকে শুরু করে একজন বৃদ্ধ কৃষক পর্যন্ত। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। শুধু তাদের এই বিষয়ে জ্ঞানটুকু পৌঁছে দিলেই হবে। বাকিটা করে নেবে ওই মানুষ আর মেশিন! এই মেশিন স্বার্থপর নয়। আপনার কাছে তার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। স্মার্ট এবং নিঃস্বার্থ। যেমনটা আমি অপেক্ষা করছি, একটি মেশিনের সঙ্গে প্রেম করব বলে!
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ
এ. এইচ. এম. বজলুর রহমান ৩০ আগষ্ট, ২০২৫
শেখ শাহরুখ ফারহান ২৩ আগষ্ট, ২০২৫
আরিফ মঈনুদ্দীন ১৮ আগষ্ট, ২০২৫
আন্তর্জাতিক ডেস্ক ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
আন্তর্জাতিক ডেস্ক ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
আন্তর্জাতিক ডেস্ক ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
আন্তর্জাতিক ডেস্ক ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
আন্তর্জাতিক ডেস্ক ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
Total Vote: 46
যৌক্তিক
Total Vote: 52
একমত