সিম, এমএফএস ও ইকেওয়াইসি'র মধ্যে সমন্বয়ে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক
অনলাইন বেটিং রোধে ন্যায্যতার ভিত্তিতে নেয়া হচ্ছে কঠীন সিদ্ধান্ত
অনলাইন জুয়ায় ইঁদুর-বিড়াল খেলা বন্ধে ওয়েব ট্রলার ব্যবহারে গুরুত্বারোপ করছেন বিশেষজ্ঞরা। পরামর্শ দিয়েছেন সেইফ ইন্টারনেটের জন্য বিশেষ প্যাকেজ চালু ও সচেতনতা তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জানা গেলো, অনলাইন বেটিংয়ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের অধীনে গত মে মাস থেকে জুয়ায় ৫ হাজার জড়িত এমএফএস হিসাব বন্ধ করা হয়েছে। অ্যাপের মাধ্যমেও জুয়া হচ্ছে। ব্লক করলেই বদলে ফেলা হচ্ছে লিংক। এসব বিষয় সনাক্তে এজন্য একটি কমন ডেটাবেজ তৈরি করবে সরকার। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা, প্লাটফর্ম এবং অপারেটরদের নিয়ে এই কাজ করা হবে। পাশাপাশি যারা বেটিং করে তাদের নম্বরে ডেটার গতি কমিয়ে আনার কথা ভাবা হচ্ছে। একইসঙ্গে অনলাইন জুয়াতে মুঠোফোন কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে সিম ও এমএফএস এর ইকেওয়াইসি'র মধ্যে সমন্বয়ে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হবে। এরপরই জুয়ায় ব্যবহৃত সিম, অনলাইন হিসাব ও জুয়াড়ির এনাইডি কালো তালিকভূক্ত করা ছাড়াও কম্প্লায়েন্স মেনে ন্যয্যতার ভিত্তিতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সরকার।
৪ নভেম্বর, মঙ্গলবার, রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিটিআরসি ভবনে অনুষ্ঠিত বহুপক্ষীয় পরামর্শ সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়। সভায় মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে সার্ভিস, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় অংশগ্রহণকারীরা সবাই অনলাইন জুয়া বন্ধে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেন। একই সঙ্গে এক্ষেত্রে জুয়া পরিচালনাকারীসহ এতে অংশগ্রহণকারীদেরও আইনের অধীনে ডিজিটাল শাস্তি দেয়ার মত দেন আলোচকরা। অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে করণীয় সভায় এজন্য একটি সমন্বিত কমিটি গঠন, ওয়েব রিপোজেটরি তৈরি, জুয়ার ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপ সনাক্ত করার পাশাপাশি জুয়ার সঙ্গে জড়িতদের আইনের অধীনে আনার সিদ্ধান্ত হয়।
প্রধান উপদেষ্টার ডাক টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারি ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের সভাপতিত্বে সভায় এমএফএস প্রতিষ্ঠান উপায় এর হেড অব কর্পোরেট অ্যফেয়ার্স মোহাম্মাদ শামসুজ্জোহা বলেন, এমএফএস মনিটরিংয়ের মাধ্যমে যারা জুয়া খেলে তাদের সনাক্ত করা দরকার। এক্ষেত্রে সিম, জাতীয় পরিচয়পত্র ও এমএফএস অ্যাকাউন্ট সমন্বয় করা জরুরি। এই তিনটির যদি সমন্বয় করা হলে জুয়া সংক্রান্ত অপারধ ৮০ শতাংশ সমাধান করা সম্ভব।
অপরদিকে বিকাশ লিমিটেডের চিফ এক্সটার্নাল এবং কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মেজর জেনারেল শেখ মনিরুল ইসলাম (অব) জানান, জুয়ায় জড়িত থাকায় গত দুই সপ্তাহে ৪০টি নতুন নম্বরসহ ৩৯৭টি নম্বর বন্ধ করা হয়েছে। এখন ক্রলিং ইঞ্জিন নিয়ে কাজ হচ্ছে। ফোন নম্বর ধরে তার এখন এনআইডি ব্লাক লিস্ট করছেন।
কিন্তু এই মুহূর্তে এনআইডি ব্লক করা ঠিক হবে না মন্তব্য করে বিটিআরসি চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী বলেন, ১৬ ডিসেম্বরের পর মোবাইল সিম ১০টিতে নামিয়ে আনলে এক্ষেত্রেও সুবিধা মিলবে। এজন্য আগামীতে সিম কমিয়ে আনা হবে। যারা খেলছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরী। সভায় প্রযুক্তির পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয় বিবেচনায় মাদক অধিদপ্তরের মতো অনলাইন স্ক্যাম রোধে একটি বিশেষ সংস্থা করা এবং ক্রস ডোমেইন অ্যাক্টিভিটির ওপর জোর দেয়া হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে।
তবে এখনই এনআইডি ব্লক না করে টার্গেটেড আইপি ও অ্যাপগুলো ডাউন করতে মোবাইল অপারেটরদের প্রতি আহ্বান জানান বিশেষ সহকারি ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবে।
তিনি বলেন, জুয়া থেকে দেশের অনলাইন-কে মুক্ত করতে জুয়ার চক্রে সুডো সদস্য হওয়া, ট্রাফিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে লিংক স্লো করা এবং যেসব নম্বর থেকে খেলা হয় এবং যে এমএফএস লেনদেন হয় তার তালিকা তৈরি করতে হবে। এরপর নিশ্চিত হয়ে নম্বর ও অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হবে। তবে ব্লকের ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্সের বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে এটা করতে হবে।
বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালসমূহে জুয়া বন্ধে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে ফয়েজ আহমদ আরো তৈয়্যব বলেন, সামাজিক স্থিরতা বজায় রাখা, যুব সমাজের অবক্ষয় রোধ এবং অর্থপাচার বন্ধে একটি কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডাদের নিয়ে সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে। মোবাইল অপারেটরসমূহের বেটিং সাইটগুলোতে কারা ব্রাউজ করে সেগুলো সনাক্ত করবে এবং এমএফএস অপারেটরসমূহ যেসব অ্যাকাউন্টের লেনদেন সন্দেহজনক তা বিশ্লেষণ করে ডাটাবেজ তৈরি করবে। তিনি বলেন, জুয়া থেকে দেশের অনলাইন কে মুক্ত করতে হলে ট্রাফিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে লিংক স্লো করা এবং যেসব নম্বর থেকে লেনদেন হয় তার তালিকা তৈরি করতে হবে। এরপর নিশ্চিত হয়ে নম্বর ও অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হবে।
জুয়া সনাক্তে ক্রলিং ইঞ্জিন তৈরির কাজ চলছে জানিয়ে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস প্রদানকারীরা জানান, জুয়ায় জড়িত থাকায় নতুন নতুন অ্যাকাউন্ট প্রতিনিয়ত বন্ধ করা হচ্ছে এবং ফোন নম্বর ধরে জাতীয় পরিচয়পত্রের কালো তালিকা করা হচ্ছে। শীর্ষ জুয়া সাইটসমূহে এডভান্সড এআই লিংক এর মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে জানিয়ে তারা বলেন, নজরদারি এড়াতে উক্ত সাইটগুলো আইপি ঠিকানা বন্ধ করে, ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কসহ ক্রেডেনসিয়াল বন্ধ করে দেয়। সেন্ট্রাল পোর্টাল চালু করে সিমসহ এনআইডি কালো তালিকাভুক্ত করে সেটা সবখানে ছড়িয়ে দিলে অপারাধী অনেকাংশে কমে আসবে এবং লেনদেন সংখ্যা ও ভলিউম বিশ্লেষণ করে অ্যাকাউন্ট সনাক্ত হচ্ছে বলে জানান তারা । সম্বনিত কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ না করলে জুয়া বন্ধ করা সহজ হবে না জানিয়ে ডিজিএফআই এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিটিআরসিকে ফোকাল পয়েন্ট রেখে একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সভায় দেশীয় চক্রের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে একটি চক্র যুক্ত হয়ে অনলাইনে অপরাধ করে যাচ্ছে বলে অবহিত করেন এনএসআই প্রতিনিধিরা। তারা জানান, একটি চক্র প্রবাসীদের জিম্মি করে বিদেশে বসে কলসেন্টার চালু করে জুয়া ও বেটিং এর প্রচারণা চালায়। মোবাইল ও আইএসপি অপারেটরদের কনটেন্ট সনাক্তের সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন অংশীজনকে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন তারা।
নির্বাচন কমিশন থেকে আগত প্রতিনিধি জানান, নির্বাচন কমিশন ও বিটিআরসি মিলে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির উদ্যোগ গ্রহন করেছে। এছাড়া, ডুপ্লিকেশন এড়াতে স্মার্ট আইডি ও পুরানো আইডি ম্যাপিং নিয়ে কাজ শুরু হচ্ছে বলেও জানান তারা।
মোবাইল অপারেটরদের প্রতিনিধিরা জানান, অপারেটরগুলো তাদের নিজ নিজ কারিগরী সক্ষমতা অনুযায়ী ক্ষতিকর কনটেন্ট বন্ধ করছে এবং জুয়া, পর্নোগ্রাফি বন্ধে কারিগরী ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আরো বাড়ানো হচ্ছে বলেও জানান তারা।
সভাপতির বক্তব্যে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, মিডিয়া হাউজগুলো কীভাবে তাদের ওয়েব ব্রাউজার ও এডসেন্স সেটআপ করবে সে বিষয়ে একটি নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে, যা বর্তমানে তথ্য মন্ত্রণালয়ে ভেটিং প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ভেটিং শেষে তা সংশ্লিষ্ট সকল মিডিয়াকে সরবরাহ করা হবে। পাশাপাশি ডিজিটাল বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত গাইডলাইনও তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে, যা অনুমোদনের পর সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হবে। একই সঙ্গে অবিলম্বের গুলশান-১ নম্বরের বিলবোর্ডে ১ এক্স বেটা বিজ্ঞাপনদাতাদের সনাক্তের নির্দেশ দেন তিনি। এছাড়াও মোবাইলে পর্ণ সনাক্তের মতো জুয়ার লিংক সনাক্তে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটবের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে ডাটা সংগ্রহ করে তা বাংলাদেশে ব্লক করার অনুরোধও করেছেন বিশেষ সহকারী। ম্যানুয়ালি হলেও আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানকে গেটওয়েতে কড়া পহাড়া বসানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।







