খসড়া গাইডলাইনের অংশীজন সভায় 

তোপের মুখে ‘সিএমএসপি’

স্পেশাল করেসপনডেন্ট
৬ নভেম্বর, ২০২৫ ২২:৩৯  
৬ নভেম্বর, ২০২৫ ২২:৪৬  
তোপের মুখে ‘সিএমএসপি’

টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ারর্কিং অ্যান্ড লাইসেন্সিং নীতিমালা ২০২৫ এর আলোকে তৈরি ৪টি খসড়া গাইডলাইন নিয়ে ১১ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার অংশীজনদের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেছে বাংলাদেশে টেলিযোযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বৈঠকে আইএসপি, আইআইজি, আইজিডব্লিউ, এনটিটিএন, সাবমেরিন কোম্পানি, টাওয়ার কোম্পানি ও মোবাইল অপারেটররা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিষ্ঠান পর্যায়ের প্রতিনিধিরা ছাড়াও আইএসপিএবি এবং এমটব প্রধানরাও যোগ দেন এই বৈঠকে। বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মোঃ এমদাদ উল বারীর (অবঃ) সভাপতিত্বে সভায় ভাইস-চেয়ারম্যান মোঃ আবু বকর ছিদ্দিক,স্পেকট্রাম বিভাগের কমিশনার মাহমুদ হোসেন, ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড অপারেশন্স বিভাগের কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইকবাল আহমেদ (অবঃ), লিগ্যাল এন্ড লাইসেন্সিং বিভাগের কমিশনার আবদুর রহমান সরদার ছাড়াও প্রতিটি বিভাগের মহাপারিচালকেরা উপস্থিত ছিলেন। 

বিটিআরসি ভবনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় একমাত্র মোবাইল অপারেটররা ছাড়া সকল পক্ষই খসড়া নীতিমালার ওপর লিখিত সমালোচনা তুলে ধরেন। এদিন সবার তীর ছিলো মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ- সব সুযোগই উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে চার অপারেটরের জন্য। তিন লেয়ারে দেয়া ৪ রকমের গাইডলাইনে একাধিপত্য পেয়েছে বিদেশী মালিকানার সেবাদাতারা। এছাড়াও ব্যবসায়ীদের সমালাচনায় মাত্রাতিরিক্ত লাইসেন্স ফি নির্ধারণের বিষয় উঠে আসে আলোচনা কেন্দ্র বিন্দুতে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট শতাংশে আয়ের ওপর রেভিনিউ শেয়ার ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলে চাঁদা নেয়ার নীতি ইন্টারনেট সেবাকে ঋণাত্মক হুমকিতে ফেলছে বলে অভিমত ব্যবসায়ীদের। সব মিলিয়ে ভ্যাট-ট্যাক্স; রেভিনিউ শেয়ার আর এসওএফ খড়গে আগামীতে ইন্টারনেটের দাম বাড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।  
 
সভায় এমন শঙ্কা প্রকাশের পাশাপাশি নিজেদের দাবিও উপস্থাপন করেছে নতুন লাইসেন্সি তিনটি পক্ষ। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে নতুন লাইসেন্সিং নীতিমালায় পরিবর্তীত ফিক্সড টেলিকম সার্ভিস প্রোভাইডারদের (এফটিএসপি) পক্ষে খসড়া নীতিমালায় নিজেদের দাবি উপস্থাপন করেন আইএসপিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম। অপরদিকে এনটিটিএন ও টাওয়ার কোম্পানি লাইসেন্সধারীদের প্রাপ্য ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড কানেক্টিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডারদের (এনআইসিএসপি) পক্ষে বাহন লিমিটেডের সিওও ফরিদ মোহাম্মাদ রাশেদ আমিন বিদ্যুৎ এবং আইআইজি, আইজিডব্লিউ, আইটিসি ও সাবমেরিন ক্যাবল লাইসেন্সকে একীভূত করে সৃষ্ট ইন্টারন্যাশনাল কানেক্টিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডারদের (আইসিএসপি) পক্ষে নভোটেল পরিচালক ও ইন্টারক্লাউড লিমিটেডের সিইও মোঃ হাসিবুর রশিদ উপস্থাপনা দেন। 

এসময় মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটব মহাসচিব মোহাম্মাদ জুলফিকার উপস্থিত থাকলেও কোন প্রেজেন্টেশন না দেয়ার বিষয়টি বিটিআরসি চেয়ারম্যানের নজরে আনেন আইএসপিএবি চট্রগ্রাম বিভাগের আহ্বায়ক রাজিব শাহরিয়ার রোমেন্স । কৌতুক করে তিনি বলেন, নতুন যে টেলিকম পলিসি ও গাইড লাইন হয়েছে, মোবাইল অপারেটররা যদি এর উপর প্রেজেন্টেশন দিতো, তাহলে একটাই স্লাইড থাকতো " Thank You Very Much"

বৈঠকে অন্যান্যদের মধ্যে রবি আজিয়েটা থেকে কোম্পানি সেক্রেটারি শাহেদ আলম; বাংলালিংকের ডেপুটি সিইও জাহরাত আদিব চৌধুরী এবং গ্রামীণফোনের হেড অব টেকনোলজি রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার ইশতিয়াক আহমাদ খান, ইডট কো সিইও  আদলান তাজুদিন, আমেরিকান টাওয়ার কর্পোরেশন সিইও স্টিভেন ভন্ড্রান, ফ্রন্টিয়ার টাওয়ার সার্ভিস ইনকর্পোরেটেড প্রধান জাইমি টিমিয়ান, সামিট কমিউনিকেশন এর পক্ষে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তামজিদ-উল হক চৌধুরী (অব); ফাইবার অ্যাট হোম-এর চিফ অপারেটিং অফিসার হলেন মশিউর রহমান ও  চিফ স্ট্র্যাটেজি অফিসার সুমন আহমেদ সাবির, সাবমেরিন ক্যাবল লিমিটেডের পরিচালক আরিফুল হক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।   

সভায় সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন আইএসপিএবি নেতারা। তারা মোবাইল অপারেটরদের নিজেরাই ফাইবার টেনে ওয়াইফাই সংযোগ দেয়া তথা এফডব্লিএ হিসেবে মোবাইল হটস্পট চালু এবং ফ্রি তরঙ্গ আইএসএম ২.৪; ৫ এবং লোয়ার ৬ এফআইএসপি’র বাইরে কাউকে না দেয়ার প্রস্তাব রাখেন। প্রস্তাবনায় প্রোপাইটার থেকে লিমিটেড ও পাবলিক লিমিটেড হতে ফিস কমানো ও নিয়ম সহজীকরণের বিষয়েও বিটিআরসি’র দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এসময় আইএসপিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম এসময় বলেন, মোবাইল অপারেটরদের এফডব্লিউ দেয়া হলে গাইডলাইনেরই কোনো দরকার নেই। 

আলোচনায় অংশ নিয়ে আইএসপিএবি মহাসচিব নাজমুল করিম ভূঁইয়া বলেছেন, রেভিনিউ ও এসওএফ দিতে গেলে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম বাড়বে। তাই আমরা লাইন্সে থেকে এই শর্ত উঠিয়ে নেয়ার দাবি করেছি। এছাড়াও একটি ওয়ার্ডে ৩টি ইউনিয়নে ৫টি এনটিটিএন যেন পপ স্থাপন করে এবং এই ভৌগলিক সীমাটি ২০ বছরের জন্য লক রাখা হয়।

গাইড লাইনে ৬৫ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগ আনতে পারার শর্তে এনআইসিএসপি লাইসেন্সের সুবিধা পাওয়া এবং মোবাইল অপারেটর হয়েও লাস্টমাইল হিসেবে টাওয়ার, আইবিএস, ড্যাস ও পপে ফাইবার টেনে স্বাধীন ভাবে সংযুক্ত হতে পারার বিষয়টি বৈষম্যমূলক হিসেবে আপত্তি তোলা হয়। উপস্থাপনায় নতুন গাইড লাইনে বর্ণিত সুবিধা অনুযায়ী, মোবাইল অপারেটররা যদি নিজেরাই লাস্টমাইল হিসেবে টাওয়ারগুলোকে ফাইবার দিয়ে সংযুক্ত করে তাহলে ক্রস ওনার হিসেব পরক্ষভাবে এনআইসিএসপি সুবিধা ভোগ করবে। এতে একটি এনটিটি’র একাধিক লাইসেন্স সুবিধা না পাওয়ার শর্তও লঙ্ঘিত হবে। এ নিয়ে রাশেদ আমিন বিদ্যুৎ বলেন, মোবাইল অপারেটরদের জন্য এফডিআই হিসেবে ৬৫ শতাংশ বিনিয়োগ আনাটা কঠিন নয়। আর ক্রস ওনার হওয়ার এই সুযোগটা শুধু সিএমএসপি গাইড লাইনেই রয়েছে। বাড়তি এই সুযোগ পেলে সেলুলার মোবাইল সার্ভিস অপারেটররাই (সিএমএসপি) বাজার দখলে নেবে। এখানে আর কারো লাইসেন্সেরই ভ্যালু থাকবে না। প্রতিযোগিতা থাকবে না। 

অপরদিকে আইসিএসপি নির্দেশিকায় এই লাইসেন্সটি দুইটি ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সাবমেরিনকে একটা ক্যাটাগরিতে রেখে অপর লাইসেন্সিদের ফ্যসিলিটি বেজড এবং ফ্যাসিলিটি লেসড হিসেবে লাইসেন্সিং কাঠামো পূণর্বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। 

সভায় এনটিটিএনদের পক্ষে ‘ইন্টারনেট যেহেতু একটা সেবাপণ্য, সেহেতু একটি স্তর থেকেই ভ্যাট-ট্যাক্স নেয়া হোক’ বলে দাবি করেন  মশিউর রহমান। তার সঙ্গে সুর মিলিয়েসুমন আহমেদ সাবির বলেন, বিটিআরসি-কে যদি এতো লাইসেন্স ফি ও ভ্যাট ট্যাক্স দিতে হয় তাহলে বিটিআরসি-কে রেভিনিউ কালেক্টর হওয়া উচিত।

তবে এই পরামর্শ নাকচ করে দিয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী সাফ জানিয়ে দেন ‘বিটিআরসি রেভিনিউ কালেক্টর হতে পারে না।’। বৈঠক সূত্রে প্রকাশ, ক্ষুদ্র দেশীয় উদ্যোক্তারা পথে বসে এমন কোনো বিষয় গাইডলাইনে রাখবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান। মোবাইল অপারেটরদের এফডাব্লিউ সুবিধার বিষয়টি পূণর্বিবেচনা করে মোবাইলের সঙ্গে ফিক্সড অপারেটরদের এর আলাদা রেড মার্ক করে দেবেন বলে জানিয়েছেন। এনটিটিএন এর পপ থেকে লাস্ট মাইলে ফাইবার টানার সুবিধা পেতে যাচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের ইন্টারনেট সেবাদাতারা। একইসঙ্গে ডিস্ট্রিক এফটিএসপিরা এফটিএসপি’র মাধ্যমে ইন্টারনেট নির্ভর সব সেবা দিতে পারবে এবং একবছর পর যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে এফটিএসপি হতে পারবে এমন সিদ্ধান্তও আসতে যাচ্ছে। 

সভায় তিন পক্ষ থেকে আসা তীর্যক কোনো মন্তব্য নিয়ে কথা বলেনি মোবাইল অপারেটরদের প্রতিনিধিরা। তারা সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে আন্তার্জাতিক প্রাক্টিস ও স্বাধীনতা প্রত্যাশা করেছে বিটিআরসি’র কাছে। সকাল ১১টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় অংশীজন সভাটি। এরপর লাইসেন্স গাইডলাইন নিয়ে বহুপক্ষীয় সভা করবে বিটিআরসি। 

এদিকে খসড়া গাইডলাইনের বিষয়ে মতামত, সময়সীমা ও সুপারিশ আগামী ৯ নভেম্বর বেলা ১২টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। নির্দিষ্ট ছকে [email protected], [email protected], [email protected] & [email protected] ঠিকানায় যে কেউ মতামত পাঠাতে পাড়বেন। 

ডিবিটেক/আইএইচ/ইক