অবকাঠামো উন্নয়নের সবুজ প্রযুক্তি : টেকসই আগামীর পথে বাংলাদেশ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে উন্নয়নের ধারণা বদলাচ্ছে। আগের মতো তাই শুধু সড়ক, সেতু, ভবন বানালেই উন্নয়ন সম্পন্ন হয় না। সেই অবকাঠামো কতটা পরিবেশবান্ধব সেটিও এখন সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর এই বিবেচনায় সামনে চলে এসেছে "সবুজ প্রযুক্তি" বা "গ্রিন টেকনোলজি"। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এবং জলবায়ু সংবেদনশীল দেশে অবকাঠামো খাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি। এদিকে যেমন এ প্রযুক্তি পরিবেশের উপর চাপ কমায় তেমনি দীর্ঘমেয়াদে খরচও সাশ্রয় করে।
কি এই সবুজ প্রযুক্তি?
সবুজ প্রযুক্তি এমন এক ধরনের ব্যবস্থা, যেখানে কম শক্তি খরচ হয় কম কার্বন নিঃসরণ হয় এবং যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয় সেগুলো বেশিরভাগই পুনঃ ব্যবহারযোগ্য। এই প্রযুক্তির আওতায় পরে সৌর শক্তির ব্যবহার, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক আলো ও বাতাস চলাচলের মতো ডিজাইন, স্থানীয় ও টেকসই উপকরণের ব্যবহার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
নগরায়নের বিস্তার এবং অবকাঠামোর পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর পরিবেশগত প্রভাবও বাড়ছে। ধুলাবালি শব্দ দূষণ বোর্জ্য এসব শহরের দৈনন্দিন বাস্তবতা। সবুজ প্রযুক্তি এসবের টেকসই সমাধান দিতে পারে বলে মত দিয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে গত ১ দশকে অবকাঠামোর উন্নয়ন এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, এইসব প্রকল্প দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে। তবে পরিবেশের দিকটি কতটা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
সবুজ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছোট্ট দেশ সিঙ্গাপুর বিশ্বে রোল মডেল। ঘনবসতিপূর্ণ শহর হলেও তারা পরিকল্পিত সবুজায়নের মাধ্যমে নগর জীবনকে করেছে বাসযোগ্য ও টেকসই। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সিঙ্গাপুর একটি নিয়ম মেনে চলছে, যার নাম "100% green replacement policy"। এই নীতিতে বলা আছে- কোন নতুন ভবন নির্মাণ করলে, যে পরিমাণ জমির উপর নির্মাণ হচ্ছে, সেই পরিমাণ সবুজায়ন (গাছ, ছাদ বাগান, উন্মুক্ত উদ্যান ইত্যাদি) বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ ছাদে, দেয়ালে, বারান্দায়, যেভাবেই হোক ন্যূনতম শতভাগ সবুজ ফিরিয়ে দিতে হবে।
উদাহরণ হিসেবে পার্ক রয়্যাল হোটেল, ক্যাপিটা স্প্রি ভবনের কথা বলা যায়, যেখানে ভবনের ভেতরে ও বাইরে প্রতিটি স্তরেই গাছপালা জলাধার ও উন্মুক্ত সবুজ জায়গা রাখা হয়েছে। এটি শুধু পরিবেশ বান্ধব নয় বরং নান্দনিকতাও বাড়ায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের যদি এমন বাধ্যতামূলক নীতি মালা গ্রহণ করা হয় এবং শহর পরিকল্পনায় সবুজায়নকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাহলে ঘনবসতিপূর্ণ নগর গুলোতেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব।
ঢাকা-চট্টগ্রাম সহ কয়েকটি শহরে এখন গ্রীন বিল্ডিং এর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। রাজধানীর গুলশান এভিনিউতে সিম্পেল ট্রি আনারকলি, সাইহাম টাওয়ার, সিটিস্কেপ টাওয়ার, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক টাওয়ার সহ কয়েকটি স্থাপনা LEED ( leadership in energy and environment design) সনদ পেয়েছে। তবে এসব উদ্যোগ এখনো খুবই সীমিত।
বাংলাদেশি গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত ৫০টির বেশী ভবন আন্তর্জাতিক মানদন্ডে গ্রীন সার্টিফাইড হয়েছে যার বেশিরভাগই তৈরি পোশাক শিল্পে ।
সবুজ প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় বাঁধা হল প্রাথমিক খরচ। প্রচলিত নির্মাণের তুলনায় সবুজ ভবনের খরচ কিছুটা বেশি হলেও, বীরভূমে যাদের বিদ্যুৎ পানি ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেকটাই কমে আসে। অন্যদিকে, পর্যাপ্ত নীতিমালা নেই, জনবল দক্ষ নয় এবং সচেতনতা এখনো সীমিত। তবে তরুণ স্থপতি ও প্রকৌশলীদের মধ্যে সাস্টিনেবল ডিজাইন নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে। এটাই ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।
এ ব্যাপারে সরকারি পর্যায়ে আলাদা বরাদ্দ রাখা, পরিবেশ বান্ধব উপকরণে কর ছাড়, প্রশিক্ষণ ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা জরুরী। পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে কর্পোরেট প্রণোদনার মাধ্যমে উৎসাহিত করতে হবে।
অবকাঠামো উন্নয়নে সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু পরিবেশ রক্ষা নয়, বরং এটি আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য ও টেকসই সমাজ গঠনের বিনিয়োগ। জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ এখন সেই সিদ্ধান্তের মুখোমুখি। উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাব, নাকি টেকসই উন্নয়নের পথে?
লেখক: স্থপতি