এক বছরে দেড় লাখ ফোনকল রেকর্ড করে এনটিএমসি?

১৫ আগষ্ট, ২০২৫ ১০:৫১  
১৫ আগষ্ট, ২০২৫ ২৩:৫৯  
এক বছরে দেড় লাখ ফোনকল রেকর্ড করে এনটিএমসি?

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য হুমকি এমন ব্যক্তিদের স্পর্শকাতর কল রেকর্ড হর হামেসাই ফাঁস হতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। তবে এগুলো কিভাবে ফাঁস হয়েছে, আজ পর্যন্ত তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশ হয়নি।

তবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে টেলিফোনে আড়িপাতা কিংবা সংরক্ষণের দায়িত্ব পেলেও এসব ফাঁসের সঙ্গে খোদ জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসানে নাম উচ্চারিত হচ্ছে জোরে শোরে। ২০২২ সাল থেকে এনটিএমসি মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। রক্ষক হয়েও এমন ভক্ষক কাণ্ডে তিনি বিচারের মুখোমুখি হয়ে কারা অন্তরীণ আছেন। অতীতের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের ব্যক্তিগত ফোনকল ফাঁস করে তা বিভিন্ন টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার করার অভিযোগ রয়েছে জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনের সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কয়েকজন মন্ত্রীর ফোনালাপ রেকর্ডের সারাংশ গণভবন থেকে উদ্ধার হয়। 

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থান পূর্ববর্তী সময়ে মাত্র এক বছরে দেড় লাখ ফোনকল রেকর্ড করেছে এনটিএমসি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র। সূত্রমতে, বিষয়টি সম্প্রতি অফিসিয়ালি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে অবহিতও করা হয়েছে। এতে তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছে কমিশন। 

তবে এর কতটি ফাঁস হয়েছে কিংবা বেহাত হয়েছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সূত্রমতে, এরইমধ্যে এনটিএমসি’র রেকর্ডকৃত ২০টির মতো কলরেকর্ড যাচাই-বাছাই করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, এনটিএমসি’র কাছে থাকা দেড় লাখে কিছু বেশি কল রেকর্ড করার মতো প্রযুক্তি রয়েছে। অবশ্য কলের সঙ্গে উভয় প্রান্তে থাকা ব্যক্তিদের পক্ষ থেকেও কল রেকর্ড ফাঁসের ‍সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অতীত বলছে, গোয়েন্দা নজরদারিতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনের ৯৭ ধারায় ক্ষমতা বলে তৃতীয় পক্ষের কল রেকর্ড এর ক্ষমতা থাকলেও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি কাউকে এই সুযোগ দেয়নি বলে জানাগেছে।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে প্রকাশ, অতীতে ক্ষমতার চেয়ার সুরক্ষা করতে আইন ও নীতির তোয়াক্কা না করে এনটিএমসি-তে ফোনকল রেকর্ড করা হয়েছে। যারাই আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করেছে বা ভিন্নমত পোষণ করেছে তাদেরই ফোনকল রেকর্ড করা হতো। এ নিয়ে একটি টিম ২৪ ঘণ্টা কাজ করেছে। যদি কোনো জরিপ করা হয় তাহলে দেখা যাবে এটা একটি বিশ্ব রেকর্ড। অন্য কোনো দেশে সরকার বিরোধীদের ফোনকল এভাবে রেকর্ড করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এনটিএমসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলেও তা মূলত পরিচালনা করত একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এখন চেষ্টা চলছে ওই সংস্থার কাছ থেকে এনটিএমসিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে আনার। রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে এনটিএমসিকে যেন কেবলই রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, সে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তারা।

এদিকে ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনের (২০১০ সালে সংশোধিত) ৯৭ ধারায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে কল রেকর্ড সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়। এ ধারায় বলা হয়েছে, 'এই আইন বা অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যে কোন টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর প্রেরিত বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোন কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবে এবং উক্ত কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারিবে এবং পরিচালনাকারী উক্ত নির্দেশ পালন করিতে বাধ্য থাকিবে।'

এ ছাড়া 'সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ (১৮৭২ সনের ১নং আইন) বা অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনের ধারা ৯৭ক-এর অধীন সংগৃহীত কোন তথ্য বিচার কার্যক্রমে সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য হইবে।'

২০০৮ সালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মোবাইল অপারেটরদের অর্থায়নে ডিজিএফআই ভবনে ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার (এনএমসি) গঠিত হয়। এনএমসি নিরলসভাবে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে ল’ফুল ইন্টারসেপশন সহায়তা প্রদান করে। বিশ্বব্যাপী অবাধ তথ্য প্রবাহের কারণে তথ্যপ্রযুক্তিকেন্দ্রিক অপরাধ সংঘটনের মাত্রা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি এনএমসি পরিবর্তিত হয়ে ‘ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। সংস্থাটি ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সাল থেকে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কার্যক্রম শুরু করে।

বলা হচ্ছে, আইনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিগত সরকারের সময় ২০০-৩০০ মিলিয়ন ডলারে এনটিএমসি সারভাইল্যান্সের যন্ত্রপাতি কিনেছে বলে খবরে প্রকাশ। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আইসিটি ও টেলকম বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবকে প্রধান করে নজরদারির যন্ত্রপাতি নিয়ে তদন্ত করতে সম্প্রতি কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিটি এখন খতিয়ে দেখবে যন্ত্রপাতি কীভাবে, কোথা থেকে, কত দাম দিয়ে কেনা হয়েছে এবং কীভাবে এর ব্যবহার করা হয়েছে। 

: