উপদেষ্টা পরিষদে নতুন টেলিকম নীতিমালা অনুমোদন

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ‘টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং নীতিমালা, ২০২৫ সহ তিনটি নীতিমালার খসড়া অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
৪ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদ বিভাগের ৪১তম সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অন্যান্যদের মধ্যে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়ব উপস্থিত ছিলেন।
নতুন নীতিমালার আইনি কঠামো প্রতিষ্ঠিত হবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১ এর ওপর। এর মাধ্যমে টেলিকম খাতকে একটি প্রযুক্তি-নিরপেক্ষ, সরল ও প্রতিযোগিতামূলক কাঠামোয় রূপান্তর করা। এতে করে সেবা প্রদানকারীরা আরও সাবলীলভাবে সেবা প্রদান করতে পারবে, নতুন প্রযুক্তি সহজে গ্রহণ করতে পারবে এবং খাতজুড়ে দক্ষতা ও মান বাড়বে বলে মন্তব্য করছেন ফয়েজ আহমদ তৈয়ব।
তিনি মনে করেন, ফাইবার, ওয়্যারলেস, স্যাটেলাইট বা ক্লাউড/এজ কম্পিউটিং ইত্যাদি যে কোনো উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে উদ্ভাবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে নীতিমালাটি ব্যবসায় বান্ধব হবে।
নীতিমালার সারণী অনুযায়ী, নতুন নীতিমালায় ইন্টারকানেকশন ও পিয়ারিং-এর ক্ষেত্রে IP-ভিত্তিক ট্রাফিক কাঠামো বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার আসা করছে, এর মাধ্যমে পরিচালন ব্যয় হ্রাস করবে এবং সেবার গুণগত মান উন্নত করবে।
বলা হচ্ছে, একীভূত ও প্রযুক্তি-নিরপেক্ষ কাঠামো দাঁড় করাতে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং নীতি ২০২৫’ প্রকাশ করেছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এর মাধ্যমে ২০১০ সালের আন্তর্জাতিক দীর্ঘ দূরত্ব টেলিযোগাযোগ সেবা (আইএলডিটিএস) নীতিমালার বিদায় ঘটছে।
নীতির খসড়ায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সংযোগের দায়িত্ব নেবে ইন্টারন্যাশনাল কানেকটিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডারস। তারা ভয়েস, ডেটা, ইন্টারনেট, আইপি ট্রানজিট থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পিয়ারিং সেবার মতো সবকিছু পরিচালনা করবে। তবে সব ধরনের আন্তর্জাতিক সংযোগ দেশের ভেতর দিয়ে পরিচালনার বাধ্যবাধকতা থাকবে, যাতে অবৈধ রুট ও রাজস্ব ফাঁকি রোধ করা যায়।
অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ সংযোগ ও পিয়ারিংয়ে নতুন করে বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাপনা আসছে। অ্যাকসেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডারস (এএনএসপি)–দের স্থানীয়ভাবে ভয়েস ও ডেটার আন্তঃসংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য কনসোর্টিয়াম গঠন বা যোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেওয়ার সুযোগ থাকবে। এ ছাড়া বর্তমানে বিদ্যমান ন্যাশনাল ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ (এনআইএক্স) লাইসেন্স ভবিষ্যতে বাতিল করা হবে, তবে কার্যত একই ধরনের পিয়ারিং ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে।
নীতির মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব সুরক্ষা, কর-জিডিপি অনুপাত ধরে রাখা, দেশীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং সর্বোপরি তরুণ ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য সাশ্রয়ী ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব আব্দুন নাসের খান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফায়েজ আহমাদ তাইয়্যেব নতুন এই নীতিমালায় সই করেছেন।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এর মাধ্যমে দেশের খাতকে নেটওয়ার্ককে সরল, দক্ষ ও অভিযোজনশীল এবং লাইসেন্সিং রেজিমকে যৌক্তিক, সুস্থ প্রতিযোগিতা-বান্ধব ও টেকসই করে পূনর্বিন্যাস করার দাবি করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত নীতির প্রাথমিক আলোচনায় বলা হয়েছে, টেলিযোগাযোগ খাত বাংলাদেশের ডিজিটাল অগ্রযাত্রার অন্যতম ভিত্তি হলেও এখনো রয়েছে নানা জটিলতা, সেশনজট ও নেটওয়ার্ক দুর্বলতা। বিশেষ করে ফাইবার নেটওয়ার্ক ও সাবমেরিন কেবলের সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার না হওয়া, ডেটা সেন্টার অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা এবং মানসম্মত সেবার অভাব খাতটির সম্ভাবনা ব্যাহত করছে। ফলে দেশীয় ট্রাফিক বিদেশি রুটে চলে যাচ্ছে, দুর্বল হচ্ছে জাতীয় ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব।
নীতির প্রাককথনে আরও বলা হয়েছে, বৈশ্বিক প্রযুক্তি যখন ভয়েস ও ডেটা সেবার সীমারেখা মুছে ফেলছে, তখন বাংলাদেশের খণ্ডিত ও স্তরভিত্তিক লাইসেন্স কাঠামো কার্যত বাজারের স্বাভাবিক গতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। নানা ধরনের লাইসেন্স থাকার কারণে বিনিয়োগ ও উদ্ভাবন নিরুৎসাহিত হচ্ছে, বাড়ছে পরিচালন খরচ ও জটিলতা। এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতেই নতুন নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ও তথ্য বিবরণী থেকে জানা গেছে, সভায় বিদ্যুৎ বিভাগের ‘বেসরকারি অংশগ্রহণে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদন/বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা, ২০২৫’, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ‘টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং নীতিমালা, ২০২৫’ এবং আইন ও বিচার বিভাগের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (তৃতীয় সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়।
এসব খসড়া লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।