ভিপিএন কীভাবে কাজ করে, আর কেন বিষয়টি জানা জরুরি?

ভিপিএন কীভাবে কাজ করে, আর কেন বিষয়টি জানা জরুরি?
১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ ২০:৫২  

ডিজিটাল জীবনে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা আজ বড় এক প্রশ্ন। প্রতিদিনই আমরা অনলাইনে ঢুকছি- সংবাদ পড়া, ভিডিও দেখা, ব্যাংকিং, অফিসের কাজ কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটানোর জন্য। এই সব কাজের মাঝখানে এক অদৃশ্য জগৎ কাজ করে, যেখানে আমাদের তথ্য ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন নেটওয়ার্ক আর সার্ভারের ভেতর দিয়ে। এই জগতে নিজেকে কিছুটা আড়ালে রাখতে যে প্রযুক্তি সবচেয়ে বেশি আলোচিত, তার নাম ভিপিএন বা ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক।

অনেকেই জানেন, ভিপিএন ব্যবহার করলে আইপি ঠিকানা লুকানো যায়, অন্য দেশের কনটেন্ট দেখা যায় কিংবা পাবলিক ওয়াই-ফাইয়ে কিছুটা নিরাপদ থাকা যায়। কিন্তু ভিপিএন আসলে কীভাবে কাজ করে—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বিভ্রান্তিকর তথ্যের অভাব নেই। বাস্তবে, বিষয়টি খুব জটিল নয়। একটু মনোযোগ দিলেই বোঝা যায়, পর্দার আড়ালে ঠিক কী ঘটছে।

ভিপিএনের ধারণা প্রথমে এসেছিল অফিস বা প্রতিষ্ঠানের জন্য। দূরে বসে কাজ করা কর্মীরা যেন নিরাপদে অফিসের নেটওয়ার্কে ঢুকতে পারেন, সে জন্যই এই প্রযুক্তি তৈরি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি সাধারণ ব্যবহারকারীদের হাতেও পৌঁছে গেছে। আজ প্রোটন ভিপিএন, এক্সপ্রেসভিপিএনসহ নানা সেবাদাতা ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যবহারকারীদের জন্য ভিপিএন দিচ্ছে।

সহজ করে বললে, একটি ভিপিএনের দুটি মূল অংশ থাকে—একটি সার্ভার ও একটি ক্লায়েন্ট সফটওয়্যার। আপনার কম্পিউটার বা মোবাইলে থাকা অ্যাপটি হলো ক্লায়েন্ট, আর দূরের কোনো দেশে থাকা শক্তিশালী কম্পিউটারটি হলো সার্ভার। এই দুটির মধ্যে একটি নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি হয়।

আপনি যখন ভিপিএন চালু করেন, তখন প্রথমেই আপনার ডিভাইস ভিপিএন সার্ভারের সঙ্গে একটি নিরাপদ সংযোগ স্থাপন করে। এরপর থেকে আপনি ইন্টারনেটে যা কিছুই করেন—ওয়েবসাইট খোলা, ভিডিও দেখা বা কিছু ডাউনলোড—সব অনুরোধ আগে যায় ওই ভিপিএন সার্ভারের কাছে। সেখান থেকে তা পাঠানো হয় গন্তব্যে। ফেরত আসা তথ্যও একই পথে, আবার ভিপিএন হয়ে আপনার কাছে পৌঁছায়।

এই যাতায়াতের পুরো প্রক্রিয়াটিই থাকে এনক্রিপ্ট করা, অর্থাৎ তালাবদ্ধ। মাঝখানে আপনার ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বা অন্য কেউ দেখলেও বুঝতে পারে না, ভেতরে ঠিক কী তথ্য যাচ্ছে। তারা শুধু দেখে, আপনি ভিপিএন সার্ভারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

এই কারণেই ভিপিএনকে অনেক সময় অনলাইনের মুখোশ বলা হয়। বাইরে থেকে মনে হয়, কাজগুলো করছে ভিপিএন সার্ভার, আপনি নন। ফলে আপনার আসল অবস্থান ও আইপি ঠিকানা আড়ালে থেকে যায়।

এখন প্রশ্ন হলো, সাধারণ ইন্টারনেট সংযোগে কী ঘটে? আপনি যখন কোনো ঠিকানা লিখে ওয়েবসাইটে ঢোকেন, তখন আপনার ডিভাইস সরাসরি আপনার ইন্টারনেট সেবাদাতার কাছে অনুরোধ পাঠায়। সেখান থেকে সেই অনুরোধ যায় সংশ্লিষ্ট সার্ভারে। তথ্য ছোট ছোট প্যাকেটে ভাগ হয়ে বিভিন্ন পথে ঘুরে আবার আপনার কাছে ফিরে আসে। এই পুরো ব্যবস্থাটি চলে আইপি ও টিসিপি নামের দুটি মৌলিক প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে।

ভিপিএন এই প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে ঠিক শুরু ও শেষে। আপনার ডিভাইস থেকে বেরোনোর আগেই তথ্য এনক্রিপ্ট হয়ে যায় এবং ভিপিএন সার্ভারের ঠিকানা যুক্ত হয়। মাঝপথে কেউ দেখলেও শুধু এনক্রিপ্ট করা ডেটাই দেখতে পায়। গন্তব্য সার্ভার পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে ভিপিএন সার্ভার সেই তথ্য খুলে নেয় এবং নিজের পরিচয়ে পাঠায়।

এই ব্যবস্থাকে অনেক সময় “টানেল” বলা হয়। যেন আপনার ডিভাইস আর ভিপিএন সার্ভারের মধ্যে একটি অদৃশ্য সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছে, যার ভেতর দিয়ে তথ্য নিরাপদে চলাচল করছে। বাস্তবে এটি আরও একটু প্রযুক্তিগত—প্রতিটি ডেটা প্যাকেটের ওপর আরেকটি প্যাকেটের আবরণ দেওয়া হয়, যাতে গন্তব্য জানা থাকলেও উৎস অজানা থাকে।

এনক্রিপশন এখানেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অধিকাংশ ভিপিএন শক্তিশালী এনক্রিপশন পদ্ধতি ব্যবহার করে, যেমন এএইএস-২৫৬। এটি একই ধরনের প্রযুক্তি, যা ব্যাংক বা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হয়। তবে শুধু একটি এনক্রিপশনই যথেষ্ট নয়। তাই ভিপিএনগুলো সাধারণত দুই ধাপে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে—প্রথমে জটিল যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্লায়েন্ট ও সার্ভার একে অপরকে চেনে, তারপর দ্রুতগতির এনক্রিপশন দিয়ে ডেটা আদান-প্রদান করে।

এই পুরো ব্যবস্থার জন্য আলাদা আলাদা ভিপিএন প্রোটোকল রয়েছে। ওপেনভিপিএন, ওয়্যারগার্ড বা আইকেইভি২—এগুলো মূলত নিয়মকানুনের সেট, যা ঠিক করে দেয় কীভাবে তথ্য লক হবে, কোন পথে যাবে এবং কীভাবে খোলা হবে। পুরোনো কিছু পদ্ধতি এখন আর নিরাপদ নয়, তাই আধুনিক ভিপিএনগুলো সেগুলো ব্যবহার করে না।

তাহলে ভিপিএন ব্যবহার করার আসল কারণ কী? প্রধান দুটি কারণ হলো গোপনীয়তা ও অবস্থান পরিবর্তনের সুবিধা। ভিপিএন আপনার ব্রাউজিংয়ের সঙ্গে সরাসরি আপনার পরিচয় জুড়ে দেওয়া কঠিন করে তোলে। এতে বিজ্ঞাপনদাতা বা নজরদারি থেকে কিছুটা সুরক্ষা মেলে। একই সঙ্গে আপনি চাইলে অন্য দেশের সার্ভার ব্যবহার করে সেখানকার অনলাইন কনটেন্ট দেখতে পারেন।

তবে ভিপিএন কোনো জাদুর কাঠি নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের নাম-ছবি দিয়ে কিছু পোস্ট করলে তা ভিপিএন লুকিয়ে রাখতে পারে না। আবার সব ধরনের ইন্টারনেট গতি কমে যাওয়ার সমস্যাও ভিপিএন সমাধান করে না। তাই ভিপিএনকে একমাত্র নিরাপত্তা সমাধান না ভেবে, ডিজিটাল নিরাপত্তার একটি অংশ হিসেবে দেখা জরুরি।

সব মিলিয়ে বলা যায়, ভিপিএন মূলত আপনাকে অনলাইনে একটি ভিন্ন পরিচয় দেয়, যেন আপনি নিজের আসল ঠিকানা না দেখিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন। এই প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে তা জানলে বিজ্ঞাপনের বড় বড় দাবিতে বিভ্রান্ত না হয়ে, নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। ডিজিটাল দুনিয়ায় সচেতন থাকার পথে এই বোঝাপড়াই হতে পারে প্রথম ধাপ।

ডিবিটেক/বিএমটি