কীভাবে চিনবেন ফেইক না ডিপফেইক
সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন এআই এর ব্যবহার ধুন্ধুমার। কেউ মজা করে, কেউবা বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি করছেন ডিপফেক কন্টেন্ট। এআই-নির্ভর এসব ছবি, অডিও, ভিডিও দিয়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো সয়লাব। আগে ফটোশপ বা ভিডিও এডিট করে এসব অপকর্ম ঘটানো হলেও এখন এআই প্রযুক্তির নানা টুলস ব্যবহার করে যে কোনো মানুষের চেহারা, কণ্ঠস্বর সবকিছুই নকল করা যায় সহজেই। তাই কোনো ভিডিও বা ছবি দেখা মাত্রই বিশ্বাস না করে তা ফেইক না ডিপফেইক তা জেনে নিন নিচের কৌশল ব্যবহার করে।
দৃশ্যমান অসঙ্গতি
এখন তো বিভিন্ন স্মার্টফোনে সরাসরিই এআই এডিটিং ফিচার চলে আসছে, যেমন পিক্সেল ৯-এ গুগলের ‘অ্যাড মি’ ফিচার। এ ফিচারের মাধ্যমে যে ছবি তুলছেন, তাকেই ছবিতে আনা যায় এআই কারিশমা। এই কারশিমাতেও থেকে সাধারণ কিছু দৃশ্যমান অসঙ্গতি থাকে। এই যেমন-
চোখ এবং পলক : একজন স্বাভাবিক মানুষ ঘন ঘন পলক ফেলে, কিন্তু ডিপফেইকের ক্ষেত্রে চোখের নড়াচড়া অস্বাভাবিক হতে পারে বা পলক ফেলার পরিমাণ খুব কম বা বেশি হতে পারে। চোখের মণি বা চারপাশের ছায়াও অস্বাভাবিক দেখাতে পারে।
মুখের অভিব্যক্তি : মুখের ভাব এবং কথা বলার ধরনের মধ্যে অসামঞ্জস্য থাকতে পারে। আবেগের সঙ্গে মুখের অভিব্যক্তি নাও মিলতে পারে।
ত্বকের গঠন : ডিপফেক ভিডিওতে ত্বক অস্বাভাবিকভাবে মসৃণ বা কুঁচকানো দেখাতে পারে। মুখমণ্ডল এবং ঘাড় বা শরীরের অন্যান্য অংশের ত্বকের রঙের পার্থক্য থাকতে পারে।
ঠোঁটের নড়াচড়া : অডিওর সঙ্গে ঠোঁটের নড়াচড়ার মিল নাও থাকতে পারে বা ঠোঁটের প্রান্তগুলো ঝাপসা দেখাবে।
আলো এবং ছায়া : আলো এবং ছায়ার অবস্থান বা দিক স্বাভাবিক নাও হতে পারে, কারণ এআই বাস্তব জগতের আলোর ফিজিক্স সম্পূর্ণরূপে অনুকরণ করতে পারে না।
শারীরিক অসঙ্গতি : হাত, দাঁত বা কানের মতো ছোটখাটো বিবরণগুলোতে প্রায়ই অসঙ্গতি দেখা যায়। চুলের রেখা বা কানের দুলের মতো জিনিসের প্রান্তগুলো ঝাপসা হতে পারে বা মিটমিট করতে পারে ((glitches))।
পটভূমি (Background) : অনেক সময় ডিপফেকের ক্ষেত্রে মূল বিষয়ের চেয়ে পটভূমির স্পষ্টতা কম হতে পারে বা পটভূমিতে হঠাৎ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
কারিগরি কৌশল
ডিপফেইক তৈরি একেবারেই সহজ করে তুলেছে ছবি তৈরির প্ল্যাটফর্ম মিডজার্নি'র মতো অ্যাপ্লিকেশন। এসব অ্যাপ্লিকেশনে তৈরি ফেইকও প্রযুক্তিগতভাবে যাচাইয়ের জন্য রয়েছে কিছু নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি-
উৎস যাচাইকরণ : কন্টেন্টটি কোথা থেকে আসছে তা পরীক্ষা করুন। যদি এটি কোনো পরিচিত বা বিশ্বস্ত উৎস থেকে না আসে, তবে এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করা উচিত।
রিভার্স ইমেজ সার্চ : ছবি বা ভিডিওর থাম্বনেইল ব্যবহার করে গুগল ইমেজ সার্চ বা TinEye-এর মতো টুল দিয়ে রিভার্স সার্চ করুন। এটি আপনাকে মূল কন্টেন্টটি খুঁজে বের করতে এবং কোনো পরিবর্তন করা হয়েছে কিনা তা দেখতে সাহায্য করতে পারে।
মেটাডেটা বিশ্লেষণ : ফাইলটির মেটাডেটা (metadata) পরীক্ষা করুন, যেখানে ফাইল তৈরি ও পরিবর্তন করার তারিখ ও সময় থাকতে পারে। ডিপফেক তৈরির টুলগুলো প্রায়ই এই ডেটা পরিবর্তন বা মুছে ফেলে।
বিশেষায়িত টুলস : মাইক্রোসফটের তৈরি ‘Video Authenticator’ বা ইন্টেলের ‘FakeCatcher’-এর মতো কিছু স্বয়ংক্রিয় টুল রয়েছে, যা ডিপফেক শনাক্ত করতে পারে। যদিও এই টুলগুলো সব সময় সাধারণ মানুষের জন্য সহজে উপলব্ধ নাও থাকতে পারে।
ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট : যদি কন্টেন্টটি ভাইরাল হয়, তাহলে Google Fact Check Explorer বা অন্যান্য নির্ভরযোগ্য ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থাগুলোর ওয়েবসাইটে দেখুন সেটি সম্পর্কে কোনো তথ্য আছে কিনা।
সাধারণ ব্যবহারকারী হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সন্দেহপ্রবণ হওয়া এবং কোনো কন্টেন্ট শেয়ার করার আগে ওপরে আলোচিত অসঙ্গতিগুলো ভালোভাবে খতিয়ে দেখা। এটা করা যায় মেটাডাটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে। এসময় নিম্নক্ত তথ্য খুঁজে মিলিয়ে নিতে হবে
ক্যামেরা বা ডিভাইস মডেল : কোন মডেলের ক্যামেরা বা ফোন দিয়ে ছবিটি তোলা বা ভিডিওটি রেকর্ড করা হয়েছে, তা এখানে উল্লেখ থাকে। একটি আসল ফাইলে সাধারণত ডিভাইসের সঠিক নাম (যেমন : Canon EOS 5D Mark IV ev iPhone 14 Pro) থাকে। ডিপফেক বা এডিট করা ফাইলে এই তথ্য অনুপস্থিত থাকতে পারে বা জেনেরিক নাম (যেমন : ‘Digital Camera’) থাকতে পারে।
সময় এবং তারিখ : ফাইলটি কখন তৈরি বা শেষবার পরিবর্তন করা হয়েছে, তার সঠিক তারিখ ও সময় এখানে থাকে। যদি দাবি করা ঘটনার সময়ের সঙ্গে মেটাডেটার সময়ের মিল না থাকে, তাহলে ফাইলটি জাল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সফ্টওয়্যার বা প্রোগ্রাম : ছবিটি বা ভিডিওটি কোনো এডিটিং সফটওয়্যার (যেমন : Adobe Photoshop, Premiere Pro) দিয়ে এডিট করা হলে, সেই সফটওয়্যারের নাম এবং সংস্করণ (version) মেটাডেটাতে লেখা থাকতে পারে। ডিপফেইক তৈরির কাজে ব্যবহৃত এআই টুলগুলোর নামও কখনও কখনও এখানে দেখা যায়।
অবস্থান (GPS Location) : কিছু ফাইল, বিশেষ করে স্মার্টফোন দিয়ে তোলা ছবিতে, GPS কো-অর্ডিনেট বা ভৌগোলিক অবস্থান ডেটা থাকে। এই ডেটা যাচাই করে দেখা যায় যে, ছবিটি সত্যিই সেই নির্দিষ্ট জায়গায় তোলা হয়েছিল কিনা।
অন্যান্য প্যারামিটার : ছবির রেজল্যুশন, ফাইলের আকার, এক্সপোজার সেটিংস ইত্যাদি তথ্যও বিশ্লেষণ করা হয়।
মেটাডেটা বিশ্লেষণ : ফেইক/ডিপফেইক বা জাল ফাইল শনাক্ত করার ক্ষেত্রে মেটাডেটা বিশ্লেষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ :
তথ্য মুছে ফেলা : জালকারীরা প্রায়ই আসল ফাইল থেকে মেটাডেটা মুছে ফেলে যাতে সেটিকে ট্র্যাক করা না যায়। মেটাডেটা সম্পূর্ণ খালি থাকা একটি সন্দেহজনক লক্ষণ।
অসামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য : যদি মেটাডেটাতে একটি আইফোন মডেলের নাম থাকে, কিন্তু ছবিতে একটি পেশাদার ক্যামেরার লেন্সের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, তবে সেটি অসঙ্গতিপূর্ণ।
এডিটিং সফ্টওয়্যারের ছাপ : মেটাডেটাতে যদি স্পষ্ট উল্লেখ থাকে যে, ফাইলটি কোনো এআই ইমেজ জেনারেটর সফটওয়্যার দিয়ে তৈরি, তবে সেটির সত্যতা সহজেই প্রমাণিত হয়।
ডিবিটেক/মুইম







