ডিজিটাল প্রমাণ নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করে; এদের বিকৃতি করা যায় নাঃ জোহা
জুলাই অভ্যুত্থান সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম রায়ে পলাতক ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও আওমীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের ফাঁসির রায়ে গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে ডিজিটাল প্রমাণ। ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া, সাভার এবং যাত্রাবাড়ীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দণ্ডিতদের সংশ্লিষ্টতা; বিশেষ করে সাভারে যে ছয়টা লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, সেই ভিডিও আলামত আদালতে শাস্তি ঘোষণায় প্রামাণ্য দলিল হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। ভুক্তভোগীরা শেখ হাসিনাকে সরাসরি গুলি করতে না দেখলেও তার নির্দেশনাতেই যে তাদের উপর গুলি করা হয়েছে; সেসব ডিজিটাল নথি আলামত আদালতের সামনে প্রমাণ করেছেন মামলার তদন্ত কর্তৃপক্ষ। শেখ হাসিনার নির্দেশের প্রমাণ হিসাবে সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক মাকসুদ কামালের সঙ্গে কথোপকথনের অডিও রেকর্ড আদালতে আলামত হিসেবে জমা দেয়া হয়। এছাড়াও প্রাণঘাতী অস্ত্র থেকে গুলি করার হিসাব ও এর ফলে হতাহত সম্পর্কে একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে এসএমএস করে জানিয়েছেন। সেই আলামতও আদালতে দেওয়া হয়েছে। আর সেইসব আলামতের মধ্যে ফোনালাপ, ছবি ও ভিডিও ফুটেজের মতো ডিজিটাল ডেটা বা ফুটপ্রিন্ট সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও বিশেষ অনুসন্ধান কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। কিন্তু অপরাধীরা পালানোর আগেই সব আলামত ধ্বংস বা মুছে ফেলেছিলেন। তাহলে কিভাবে সেসব আলামত উদ্ধার করলেন? দোষ প্রামাণে সক্ষম হলেন? এমন নানা প্রশ্নের ডিজিবাংলাটেক ডট নিউজ নির্বাহী সম্পাদকের মুখোমুখি হন তানভীর হাসান জোহা। বিস্তারিত পড়ুন সাক্ষাৎকারে।
প্রশ্নঃ আপনি যেহেতু ব্যস্ত। তাই কোনো ভূমিকা ছাড়াই জানতে চাই- জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের কী কী এবং কী পরিমাণ ডিজিটাল আলামত জব্দ করেছেন?
জোহাঃ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমরা মূলত কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ডিজিটাল আলামত জব্দ করতে পেরেছি, যেমনঃ- মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, হার্ডডিস্ক, পেনড্রাইভ, মেমোরি কার্ড; সিসিটিভি ও ডিভিআর ফুটেজ, আইপি ক্যামেরার রেকর্ড; কল ডাটা রেকর্ড (CDR), এসএমএস/লোকেশন ডাম্প, বিটিএস/টাওয়ার ডাটা; ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, ইমেইল ইত্যাদির চ্যাট ও মিডিয়া কনটেন্ট; নিউজ পোর্টাল, ইউটিউব, লাইভস্ট্রিমের ভিডিও আর্কাইভ এবং জিপিএস লগ, ড্রোন ফুটেজ থাকলে সেগুলো।
পরিমাণের দিক থেকে বললে, সুনির্দিষ্ট সংখ্যা বলা কঠিন, তবে মোট ডেটার ভলিউম একাধিক টেরাবাইট, আর রেকর্ডের সংখ্যা দশ হাজরের বেশি ইন্ডিভিজুয়াল আইটেম (কল, মেসেজ, ছবি, ভিডিও ইত্যাদি)– এমন স্কেলে কাজ করতে হয়েছে। সেফটি ও কোর্টের সীমাবদ্ধতার কারণে এখানে আমি কেবল আনুমানিক স্কেল উল্লেখ করছি, নির্দিষ্ট সংখ্যা না।
প্রশ্নঃ ফরেনসিক কিভাবে ও কোথায় করেছেন?
জোহাঃ ডিজিটাল ফরেনসিক আমরা কয়েকটা স্তরে করেছি। এর মধ্যে রয়েছে- ইমিডিয়েট সিজার ও ইমেজিং, ন্যাশনাল ফরেনসিক ল্যাবে অ্যানালাইসিস এবং OSINT ও ডাটা-কোরিলেশন। ইমিডিয়েট সিজার ও ইমেজিং এর ক্ষেত্রে ডিভাইস জব্দের সময় ফরেনসিক রাইট-ব্লকার ব্যবহার করে বিট-টু-বিট ইমেজ নেওয়া এবং প্রতিটি ডিভাইস ও ডাম্পের জন্য ইউনিক হ্যাশ (MD5/SHA-256) জেনারেট করে রেকর্ড রাখা হয়েছে। ন্যাশনাল ফরেনসিক ল্যাবে অ্যানালাইসিস এর ক্ষেত্রে সরকার অনুমোদিত ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবগুলোতে (CID Bd Police) এবং মোবাইল ফরেনসিক টুল (যেমন UFED টাইপ), ডিস্ক ফরেনসিক টুলস, লগ অ্যানালাইসিস, নেটওয়ার্ক ফরেনসিক ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছ। সর্বোপরি OSINT ও ডাটা-কোরিলেশন করতে ওপেন সোর্স সোশ্যাল মিডিয়া, নিউজ আর্টিকেল, ভিডিও আর্কাইভ সংগ্রহ করে CDR, লোকেশন ও সাক্ষ্যপ্রমাণের সাথে ক্রস-ম্যাচ করা হয়েছে।
প্রশ্নঃ প্রশ্ন উঠতে পারে এসব আলামত পরে তৈরি করা নয় তো?
জোহাঃ ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত যেকোনো দেশে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার হয়। এই মামলায় যেসব আলামত জমা দেওয়া হয়েছে, সেসব সাক্ষীদের মাধ্যমে অকাট্য হিসাবে প্রমাণ করা যায়। হ্যা, ঠিকই বলেছেন- প্রশ্ন উঠতে পারে এসব আলামত পরে তৈরি করা নয় তো? তবে তদন্ত কর্তৃপক্ষ সেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ রাখেনি। সকল তথ্যউপাত্ত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে উন্নত মানের সফটওয়্যার দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা সেটা বিশ্লেষণ করে মতামত দিয়েছেন। এছাড়া রাজসাক্ষীও বেশিরভাগ তথ্যউপাত্তকে সঠিক বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাই তদন্ত কর্মকর্তা হিসাবে এসব আলামত অপরাধ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট ছিলো।
প্রশ্নঃ এই কাজে কতজন মিলে করেছেন?
জোহাঃ জনবল এর প্রকৃত সংখ্যা না বলে গঠনটা বলছি। এই কাজে ডিজিটাল ফরেনসিক এক্সপার্ট, সাইবার তদন্তকারী (ইনভেস্টিগেশন অফিসার), ডাটা অ্যানালিস্ট / টাইমলাইন অ্যানালিস্ট, OSINT রিসার্চার এবং লিগ্যাল টিম (প্রসিকিউটর ও রিসার্চার)। এই টিম মিলেই কাজ করেছে। বড় মামলায় টিম সাইজ সাধারণত ডজনের কোটায় চলে যায়, সরাসরি ও ইনডাইরেক্ট সাপোর্ট মিলিয়ে।
প্রশ্নঃ ফরেনসিক কি এখনও চলমান?
জোহাঃ হ্যাঁ, এ ধরনের মামলায় চার্জ সাবমিট করার পরও নতুন তথ্য, ডিভাইস বা ক্লাউড ডাটা পাওয়া গেলে ফরেনসিক এনালাইসিস চলমান থাকে। কোর্টের অনুমতি ও আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকেই পরবর্তী ধাপে সাপ্লিমেন্টারি রিপোর্ট দেওয়া হয়।
প্রশ্নঃ আগে থেকে ধ্বংস/পুড়িয়ে ফেলা বস্তু থেকে আলামত সংগ্রহে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ এসেছে?
জোহাঃ এখানেই সবচেয়ে বড় বাস্তব চ্যালেঞ্জগুলো আসে। অনেক ডকুমেন্ট, ডিভাইস, সিসিটিভি/ডিভিআর ইচ্ছাকৃতভাবে পুড়িয়ে বা ভেঙে ফেলা হয়েছে। স্টোরেজ মিডিয়ার চিপ গলে গেছে, কনেক্টর নষ্ট, বোর্ড পুড়ে গেছে – সরাসরি রিড করা যায় না। সিসিটিভি ও নেটওয়ার্ক ডিভাইসে ওভাররাইট হয়ে গেছে পুরনো ফুটেজ।
এই অবস্থায় আমরা চিপ-অফ / JTAG / অ্যাডভান্সড রিকভারি টেকনিক ব্যবহার করে আংশিক ডাটা রিকভারি চেষ্টা করি। লোকেশনভিত্তিক টাওয়ার ডাম্প ও CDR থেকে ইভেন্ট টাইমলাইন রিকনস্ট্রাক্ট করি। এছাড়াওধ্বংস হওয়া ডকুমেন্টের ক্ষেত্রে ছাই, আংশিক কাগজ, ছবি বা ভিডিও থেকে ইন্ডিকেশন নিয়ে রিকনস্ট্রাকশন করেছি। পাশাপাশি মানুষের সাক্ষ্য, ভিডিও, অডিও, ছবি আর CDR– সব একসাথে মিলিয়ে কনসিসটেন্ট ন্যারেটিভ তৈরি করেছি।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো- প্রমাণ আংশিক বা ভাঙা অবস্থায় থেকেও কোর্টে গ্রহণযোগ্য স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখা। অনেক সময় আমাদের স্পষ্টভাবে বলতে হয়েছে: “এই অংশটা হারিয়ে গেছে, কিন্তু বাকিদের কনসিসটেন্সি থেকে এই ইনফারেন্স দাঁড়াচ্ছে।”
প্রশ্নঃ কিন্তু সাবেক সরকারের অনেক নেতারা এসবকে তো এআই দিয়ে তৈরি বলে দাবি করেছে?
উত্তরঃ এগুলো জেনুইন। আর কেউ প্রমাণ করতে চাইলে সহজেই করতে পারবে। সেটার জন্য ডিজিটাল ব্যবস্থা রয়েছে। বিবিসি ও আল জাজিরার বিখ্যাত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিবেদন করার সময় এসব তথ্যউপাত্ত পরীক্ষার জন্য ইয়ার শটস এবং টেক গ্লোবালের সহায়তা নিয়েছে। তারা নিশ্চিত করেছে কল রেকর্ডগুলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে তৈরি না। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠস্বরটি ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান জঙ্গি মামলার সময়ের নির্দেশ। কিন্তু তিনি ফেসবুক থেকে কথাটা ডিলিট করে দেন। এতেও বোঝা যায়, সজীব ওয়াজেদ জয় শেষ পর্যন্ত এই কণ্ঠস্বর জুলাই-আগস্টের আন্দোলন চলাকালীন বলে মেনে নিয়েছেন। আমি মনে করি, বিশ্বের যেকোনো আদালতে যদি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া আলামতগুলো ক্রসচেক করা হয়, আমি নিশ্চিত ফলাফল একই রকম হবে।
প্রশ্নঃ আদালতে পেশ করা চার্জে দাখিলকৃত অভিযোগের প্রমাণ বা যৌক্তিকতা কীভাবে বিশ্লেষণ করেছেন?
জোহাঃ এখানে আমাদের কাজ ছিল মূলত টাইমলাইন বিল্ড করা, রোল এবং কমান্ড রেসপনসিবিলিটি বোঝা এবং কনসিসটেন্সি টেস্ট করা।
টাইমলাইন বিল্ড করতে গিয়ে কোন তারিখে, কোন এলাকায়, কোন টাওয়ারে, কার কোন নম্বর ছিল; সেই সময়ের ছবি/ভিডিও/লাইভস্ট্রিম/সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের সঙ্গে ম্যাচ করা এবং সাক্ষীর বয়ান, মেডিক্যাল/পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট কনফেশন – সব একসাথে রেখে ক্রোনোলজি তৈরি করেছি। এরপরের ধাপে রোল এবং কমান্ড রেসপনসিবিলিটি মিলিয়েছি। এক্ষেত্রে কে সরাসরি অংশ নিয়েছে, কে সংগঠক, কে নির্দেশদাতা – এগুলো কল প্যাটার্ন, মিটিং রেকর্ড, চ্যাট-লগ থেকে বের করা হয়েছে। একই নাম, নম্বর, লোকেশন বারবার একই ধরনের ঘটনার সঙ্গে লিঙ্ক হচ্ছে কিনা দেখা হয়েছে। কনসিসটেন্সি টেস্ট করতে একজন সাক্ষী যা বলছেন, সেটা CDR/লোকেশন/ফুটেজের সাথে মিলে কিনা; ভিকটিম, প্রত্যক্ষদর্শী, মিডিয়া রিপোর্ট আর ডিজিটাল ডাটা – এই চারটি সোর্সের অন্তত তিনটাতে মিল আছে কিনা তা যাচাই করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে অভিযোগগুলোকে “beyond reasonable doubt” স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রশ্নঃ এআই/ডিজিটাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ঝুঁকি থাকলেও কীভাবে ডিজিটাল তথ্যকে দোষ প্রমাণে যথেষ্ট হিসেবে দেখিয়েছেন?
জোহাঃ এটা এখনকার যুগের সবচেয়ে কমন প্রশ্ন, আর ঠিক এই জায়গাটাই আমরা কোর্টে ব্যাখ্যা করেছি। সেখানে আমরা অথেনটিসিটি ভেরিফিকেশন, ফাইলের হ্যাশ, মেটাডেটা, ক্রিয়েশন/মডিফিকেশন টাইম, ডিভাইস আইডি যাচাই প্রতিবেদন, যে সোর্স থেকে ফাইল এসেছে (ফেসবুক/ইমেইল/ডিভাইস), সেটার অফিসিয়াল লগ মিলিয়ে দেখানো; ম্যানিপুলেশন চেক; ইমেজ/ভিডিওতে এডিটিং ট্রেস, ইনকনসিসটেন্ট শ্যাডো, পিক্সেল লেভেল আর্টিফ্যাক্ট, অডিও স্পেকট্রাল অ্যানালাইসিস উপস্থাপন করেছি। প্রয়োজনে বিশেষায়িত ল্যাব বা থার্ড-পার্টি এক্সপার্ট অপিনিয়ন; ডিপফেক/এআই কনটেন্টের রিস্ক ম্যানেজমেন্ট তুলে ধরেছি। শুধুমাত্র একটা ক্লিপ বা একটা ছবি দিয়ে কাউকে দোষী বানানো হয়নি। কই ঘটনা প্রমাণে CDR, লোকেশন, প্রত্যক্ষদর্শী, অন্য ভিডিও, অডিও, ফিজিক্যাল এভিডেন্স – সব একসাথে রাখা হয়েছে। কোর্টকে স্পষ্টভাবে বলেছি- “ডিজিটাল প্রমাণ একা নয়, বরং অন্য স্বাধীন প্রমাণের সঙ্গে মিলেই ওজন তৈরি করছে।” মানে, আমরা ডিজিটাল প্রমাণকে “অলৌকিক কিছু” বানাইনি; বরং সাপোর্টিং এবং কখনও কখনও কোর প্রমাণ হিসেবে, কড়া যাচাইয়ের পর ব্যবহার করেছি।
প্রশ্নঃ ড্রোন থেকে কোনও মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে কিনা?
জোহাঃ এখানে আমি কেস-স্পেসিফিক দাবি করতে পারি না, কারণ এগুলো সংবেদনশীল এবং কোর্ট-সাবজুডিস। নীতিগতভাবে যা বলা যায়:- ড্রোন ফুটেজ বা ড্রোন থেকে অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে কিনা দেখতে হলে আমাদের প্রয়োজন ছিলো ড্রোন রিকভারি বা কন্ট্রোল লগ, ভিডিও/টেলিমেট্রি ডাটা, প্রত্যক্ষদর্শী ও ফিজিক্যাল ড্যামেজের ফরেনসিক মিল। কেননা শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার গুজব বা এডিটেড ভিডিও দিয়ে কোর্টে “ড্রোন অস্ত্র” প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
প্রশ্নঃ অভিযোগ আছে, এনটিএমসি আড়ি পেতে দমন করেছে। তার কোনও প্রমাণ মিলেছে কি?
জোহাঃ এনটিএমসি বা অন্য কোনো সংস্থা “আড়ি পেয়ে দমন করেছে” – এই জাতীয় অভিযোগ প্রমাণ করতে গেলে আইনগত অনুমোদিত ইন্টারসেপশন লগ, অর্ডার কপি, সিস্টেম লেভেল লগ, আর কনসিসটেন্ট প্যাটার্ন দরকার। সাধারণ নীতিগত পজিশন হচ্ছে- আমরা কেবলমাত্র ডকুমেন্টেড, ভেরিফায়েবল প্রমাণের ভিত্তিতেই কিছু বলি; অনুমান বা রাজনৈতিক বক্তব্যের জায়গায় যাই না।
প্রশ্নঃ প্রথম রায়ে ডিজিটাল প্রমাণ বিচার কাজকে কতটা সহযোগিতা করেছে?
জোহাঃ ডিজিটাল প্রমাণ আসলে কোর্টকে তিনভাবে হেল্প করেছে। ক. টাইমলাইন পরিষ্কার করেছে – কে কোথায় ছিল, কোন সময় ফোনে, কখন কথা হয়েছে, কখন ভিডিও বানানো হয়েছে – এগুলো কোর্টকে একটা ক্লিয়ার ন্যারেটিভ দিয়েছে। খ. মিথ্যা অ্যালিবি ভেঙেছে – কেউ যদি দাবি করে “আমি তো ঘটনাস্থলে ছিলাম না”, CDR/লোকেশন/ভিডিও অনেক ক্ষেত্রে উল্টাটা দেখিয়েছে। গ. কমান্ড চেইন বোঝা গেছে – শুধু মাঠের লোক না, কার নির্দেশে, কোন গ্রুপের প্ল্যানিংয়ে কাজ হয়েছে, সে ট্রেস ডিজিটাল ট্রেইল থেকে পাওয়া গেছে। এ কারণে কোর্ট ডিজিটাল প্রমাণকে গুরুত্ব দিয়েছে, তবে সবসময় অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণের সাথে মিলিয়ে।
প্রশ্নঃ আন্তর্জাতিক মানের জন্য কী কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
জোহাঃ আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে মিল রেখে কয়েকটা জিনিসকে গুরুত্ব দিয়েছি। Chain of Custody ডকুমেন্টেশন; কে কখন কোন ডিভাইস জব্দ করেছে, কোথায় রেখেছে, কখন ল্যাবে গেছে, কবে রিপোর্ট বেরিয়েছে – সব লিখিতভাবে, সাইনসহ রেকর্ড; ISO/IEC 27037, 27041 টাইপ গাইডলাইন অনুসরণ; ল্যাব ও টিমের ক্যাপাসিটি বিল্ডিং; প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ, আন্তর্জাতিক এক্সপার্টদের সাথে জ্ঞান-বিনিময়; টুলের লাইসেন্সড ব্যবহার এবং ওপেন সোর্স ও কমার্শিয়াল টুল দুটোই ব্যালেন্স করে ব্যবহার; ডকুমেন্টেশন ও রিপোর্টিং স্টাইল; ফরেনসিক রিপোর্ট এমনভাবে করা, যাতে বিদেশি কোর্ট বা ট্রাইব্যুনালের এক্সপার্টও পড়লে বোঝে কী টেকনিক ব্যবহার হয়েছে। উপরন্তু এনেক্সার, লগ, স্ক্রিনশট, হ্যাশ ভ্যালু – সবকিছু পরিপাটি করে যুক্ত করা; ট্রান্সপারেন্সি ও এক্সপার্ট ক্রস-এক্সামিনেশনের জন্য প্রস্তুতি; কোর্টে দাঁড়িয়ে কোন টুল কেন ব্যবহার করেছি, তার লিমিটেশন কী, সেইগুলোও স্বীকার করার মানসিকতা রাখা এবং যাতে ডিজিটাল প্রমাণ শুধু “ব্ল্যাক বক্স” না থাকে, বরং কোর্টের কাছে টেকনিক্যালি এক্সপ্লেইনড থাকে তার পুরো বন্দবোস্ত নিয়েই হাজির হয়েছিলাম।
প্রশ্নঃ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জুলাই অভ্যুত্থান সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের ডিজিটাল আলামত হাজির করেছেন। এই আলামত রায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এরমাধ্যমে দেশের আইনি পেশার ইতিহাসের অংশও হয়েছেন। কীভাবে সম্ভব হলো?
জোহাঃ যে কাজটা হয়েছে, সেটা একদিনে হয়নি। জুলাই অভ্যুত্থানের পরপরই একটা জিনিস পরিষ্কার ছিল ডিজিটাল আলামত ছাড়া সত্যকে আদালতের সামনে দাঁড় করানো সম্ভব না। আর এই ধরনের তদন্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সময়, সত্যতা যাচাই এবং চেইন অব কাস্টডি। আমি প্রথম দিন থেকেই দুটো জিনিস ধরে রেখেছি: প্রথমতঃ তথ্যকে তথ্য হিসেবেই দেখা। কে বলল, কোথায় বলল, সামাজিক চাপ কিছুই বিবেচনায় নেই। একটা ভিডিও, একটা অডিও, একটা লোকেশন লোগ সবকিছুর উৎস, মেটাডাটা, টাইমস্ট্যাম্প, ট্রান্সমিশন পাথ সব যাচাই করেছি ফরেনসিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী।
দ্বিতীয়তঃ প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানের উপর দাঁড় করানো। NTMC, টেলিকম অপারেটর, বিভিন্ন সংস্থার সিস্টেম লগ, CDR/IPDR, স্যাটেলাইট ভিজ্যুয়াল, ডিভাইস-লেভেল ট্রেস সবকিছু একটা সুসংগঠিত চেইনে নিয়ে এসেছি। যেটা নাই সেটা বানাইনি, যেটা পাইনি সেটা রায়ে চাপিয়ে দিতে চাইনি। আদালতকে এমন প্রমাণই দিয়েছি যেটা বৈজ্ঞানিকভাবে পুনরাবৃত্তিযোগ্য। এটা সম্ভব হয়েছে কারণ আমি পুরো প্রক্রিয়াটাকে “কাজের চাপ” হিসেবে না দেখে জাতীয় দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছি। রাতে তদন্ত, সকালে আদালত, আর মাঝখানে সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়—এই তিনটা ট্র্যাক একসাথে চালিয়েছি। দলও ছিল, কিন্তু নেতৃত্ব দিতে হয়েছে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে।
সবশেষে, একটা কথা পরিষ্কার—ডিজিটাল প্রমাণ নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। এদের বিকৃতি করা যায় না, ভয় দেখিয়ে দমন করা যায় না। এগুলোই শেষে আদালতে সত্যের পাশে দাঁড়ায়। আমি শুধু সেই সেতুটা তৈরি করেছি—ঘটনার বাস্তবতা আর আদালতের চোখের সামনে থাকা আলামতের মধ্যে। যদি রায়ে এগুলোর অবদান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে সেটা বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা, প্রক্রিয়ার প্রতি সততা এবং দেশকে সত্যটা দেখানোর দায়িত্ববোধ থেকেই এসেছে।
প্রশ্নঃ কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে সময় দেয়ার জন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা-
জোহাঃ আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ। অনেক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আপনি যে প্রশ্ন করেছেন, আশা করি তার সব ঠিক ঠাক জবাব আপনি পেয়েছেন।







