জাতিসংঘে ডিজিটাল ভবিষ্যৎ বিতর্কে সোচ্চার বাংলাদেশ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস ও ডিজিটাল অধিকার মানবতার দাবি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস ও ডিজিটাল অধিকার মানবতার দাবি
১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ ০৫:০৩  
১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ ০৭:১৬  

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস এবং ডিজিটাল অধিকার—এই তিনটি বিষয়কে মানবতার ভবিষ্যৎ হিসেবে বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি (WSIS)–এর ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে এমন অবস্থান তুলে ধরেন পপররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি উইংয়ের মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মুন্তাসির মামুন।

তিনি বলেন, দুই দশক আগে WSIS যাত্রা শুরুর সময় বিশ্ব কল্পনাও করতে পারেনি আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও বৃহৎ পরিসরের ভাষা মডেলের (LLMs) বিস্ফোরণ। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এআই প্রযুক্তি যেভাবে মানুষের জীবন ও সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে, তা নীতিনির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

ড. মামুন বলেন, বিশেষ করে তরুণ ও জেন-জি প্রজন্মের জন্য ইন্টারনেট এখন প্রায় মৌলিক মানবাধিকারে পরিণত হয়েছে। ফলে ডিজিটাল রূপান্তরকে কেবল প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং অধিকারভিত্তিক ও মানবকেন্দ্রিক উন্নয়নের প্রশ্ন হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আগামী ২৪ থেকে ৩৬ মাসে বিশ্ব প্রযুক্তি ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসছে। এই সময়ের মধ্যেই WSIS, গ্লোবাল ডিজিটাল কমপ্যাক্ট (GDC), AI for Good এবং Pact for the Future—এই চারটি জাতিসংঘ প্রক্রিয়া পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হবে। এই সংযোগগুলো মানবজাতির জন্য একটি অভিন্ন ও ন্যায্য ডিজিটাল মানদণ্ড তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশ আলোচনার সময় একাধিক অনুচ্ছেদে হস্তক্ষেপ করে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছে উল্লেখ করে ড. মামুন বলেন, এসব বক্তব্য শুধু বাংলাদেশের নয়—এগুলো বৈশ্বিক দক্ষিণ কিংবা উন্নয়নশীল দেশের স্বার্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমগ্র মানবতার স্বার্থের কথা বলে।

তার ভাষায়, প্রযুক্তির এই নতুন যুগে পুরোনো ধারণা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন নতুন জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, নতুন নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং এমন একটি ডিজিটাল ভবিষ্যৎ—যেখানে প্রযুক্তি হবে আশা ও যৌথ অগ্রগতির বাহক।

গত দুই দশকের ডিজিটাল উন্নয়ন পর্যালোচনা, ডিজিটাল বিভাজন হ্রাস, এবং ভবিষ্যৎ তথ্য ও জ্ঞান সমাজ গড়ে তোলার জন্য একটি রূপরেখা নিয়ে জেনেভায় ৭-১১ ডিসেম্বর এই উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে এবারে বাংলাদেশের অবস্থান বিশেষ নজর কেড়েছে। 

এ বিষয়ে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জৈষ্ঠ্য সহ-সভাপতি সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক মনে করেন, সভায় দেয়া ড. মুন্তাসির মামুনের বক্তব্য কেবল একটি আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক ভাষণ নয়; বরং এটি বাংলাদেশের ডিজিটাল কূটনীতির অবস্থানপত্র। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ প্রশাসন, সেবা ও অর্থনীতিকে প্রযুক্তিনির্ভর করার চেষ্টা করছে। এখন সেই অভিজ্ঞতাকে আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণী টেবিলে তুলে ধরার সময় এসেছে।

তিনি বলেন, বক্তব্যে উল্লেখিত আগামী ২৪ থেকে ৩৬ মাসকে বিশ্লেষকরা একটি ক্রিটিক্যাল পলিসি উইন্ডো  হিসেবে দেখা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যেই WSIS রিভিউ, গ্লোবাল ডিজিটাল কমপ্যাক্ট (GDC), AI for Good এবং Pact for the Future—এই চারটি জাতিসংঘ প্রক্রিয়া পরস্পরের সঙ্গে ছেদবিন্দুতে পৌঁছাবে। এই সময়েই নির্ধারিত হবে এআই ব্যবহারের নৈতিক ও নীতিগত সীমা; ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (DPI) ও ডিজিটাল পাবলিক গুডস (DPG) কার স্বার্থে কাজ করবে এবং প্রযুক্তি শাসনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কণ্ঠ কতটা প্রতিফলিত হবে। তাই বাংলাদেশ এই ছেদবিন্দুগুলোকে কাজে লাগিয়ে একটি মানবকেন্দ্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল মানদণ্ড তৈরির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে—যা দেশটির কূটনৈতিক পরিপক্বতার ইঙ্গিত।

বিশ্বব্যাপী এআই, ডেটা গভর্নেন্স ও ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যে টানাপোড়েন চলছে, সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বড় উদ্বেগ হলো—প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ যেন কেবল ধনী দেশ ও বড় করপোরেশনের হাতে সীমাবদ্ধ না থাকে। ড. মামুন যখন ইন্টারনেটকে প্রায় মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেন, তখন তিনি কার্যত বৈশ্বিক দক্ষিণের একটি দীর্ঘদিনের দাবিকেই সামনে আনেন। 

ড. মামুনের বক্তব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—তিনি প্রযুক্তি বোঝার জন্য নতুন এপিস্টেমোলজি ও নতুন ব্যাখ্যাগত কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। সহজ ভাষায়, তিনি বলতে চান—পুরোনো উন্নয়ন, নিরাপত্তা বা বাজারভিত্তিক ধারণা দিয়ে এআই ও ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এ থেকে বাংলাদেশ প্রযুক্তিকে কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে নয়, বরং সমাজ, অধিকার ও মানবিক মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত একটি বিষয় হিসেবে দেখছে বলে স্পষ্ট হয়েছে।

ডিবিটেক/আইএইচ/ওআর