দারাজ ১১.১১: ভোক্তা প্রবণতায় বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত
ভার্চুয়াল কেনাকটায় নতুনত্বের ইঙ্গিত দিয়ে চলতি বছরের দারাজ ১১.১১-এ মোট বিক্রয়ের ২৫ শতাংশ এসেছে নতুন ক্রেতাদের কাছ থেকে। ৬০ শতাংশের বেশি ক্রেতা ভাউচার ব্যবহার করেছেন। অনলাইন শপিং ইভেন্টে কেনাকাটার পছন্দ, জীবনধারা ও আস্থার নতুন দিক নির্দেশ করেছে।
দারাজের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১০ নভেম্বর রাত ৮টায় সেল চালু হওয়া এবারের আয়োজনকে তাই ডিজিটালমুখী ভবিষ্যতের আরও একটি সংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ বছর দারাজের মোট বিক্রয়ের ২৫ শতাংশ এসেছে নতুন ক্রেতাদের কাছ থেকে।
প্রথম তিন দিন ক্রেতাদের কার্টে যুক্ত হওয়া পণ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা গেছে, তাদের কেনাকাটার ধরনে এক ধরনের বিস্তৃত বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী একই সঙ্গে রিয়েলমি স্মার্টফোন ও শীতের জন্য কমফোর্টার অর্ডার করেছেন। ঢাকার এক করপোরেট কর্মী অফিস ব্যবহারের চেয়ার, চিনিগুঁড়া চাল ও ময়েশ্চারাইজার এক কার্টেই নিয়েছেন। বগুড়ার এক গৃহিণী হায়ার ওয়াশিং মেশিনের সঙ্গে দৈনন্দিন বাজারের পণ্য যুক্ত করেছেন। বিভিন্ন অঞ্চলের, বিভিন্ন বয়স ও পেশার ক্রেতাদের এই মিশ্র কেনাকাটা দেখায় ২০২৫ সালে বাংলাদেশে অনলাইন শপিং এখন একই সঙ্গে প্রয়োজন, আরাম ও লক্ষ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তের সমন্বয়।
এই বৈচিত্র্যময় কার্টগুলো ইঙ্গিত দেয়, মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব থাকলেও মানুষের আয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ভোক্তাদের মধ্যে একটি নতুন আস্থা তৈরি করেছে যার প্রতিফলন দেখা গেছে বড় পণ্যের বিক্রিতে। ওয়াশিং মেশিন, গিজার, টেলিভিশন, অডিও-ভিডিও পণ্য, গেমিং ডিভাইস ও ওয়্যারেবলের মতো ইলেকট্রনিকস সামগ্রী বিক্রিতে শীর্ষ অবস্থান দখল করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব পণ্য কেনা নির্দেশ করে যে মানুষ নিজের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের পণ্যে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে।
তবে ইলেকট্রনিকসের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উল্লেখযোগ্য উত্থান এ বছরের ১১.১১-এ অন্যতম বড় পর্যবেক্ষণ। নিভিয়া ময়েশ্চারাইজার থেকে শুরু করে চিনিগুঁড়া চাল দৈনন্দিন ব্যবহারের এ ধরনের পণ্য শীর্ষ বিক্রির তালিকায় উঠে এসেছে। এর মাধ্যমে বোঝা যায় গ্রাহকরা আগের তুলনায় বেশি পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য অনলাইনে কিনছেন। লাইফস্টাইল পণ্যের মধ্যে অফিস চেয়ার, কমফোর্টার ও হোম এসেনশিয়ালসের চাহিদা বৃদ্ধি দেখাচ্ছে অফিস থেকে ফেরার পরও বাসার পরিবেশকে আরামদায়ক রাখাকে মানুষ গুরুত্ব দিচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ফ্রিল্যান্সিং ও স্টার্টআপ সংস্কৃতি, যা বাসায় কাজের সেটআপ তৈরির প্রয়োজনকে আরও বাড়িয়েছে।
ফ্যাশন ক্যাটাগরিতেও উল্লেখযোগ্য সাড়া পাওয়া গেছে। বাটা, অ্যাডিডাসসহ পরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর পণ্যের বিক্রি প্রমাণ করেছে অনলাইনে ফ্যাশন পণ্য কেনার ক্ষেত্রে মানুষের দ্বিধা আগের তুলনায় কমে এসেছে। বিশেষ করে দারাজমল-এর আসল পণ্যের নিশ্চয়তা ও ১৪ দিনের রিটার্ন নীতি ভোক্তা আস্থার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দারাজমলে থাকা শতাধিক ব্র্যান্ড ও লাখো পণ্য নকল প্রমাণে ৩ গুণ ক্যাশব্যাক, সর্বোচ্চ দুই দিনের ডেলিভারি এবং ঝামেলাহীন রিটার্ন সুবিধার কারণে বৃহৎ অংশের ক্রেতার কাছে আস্থার জায়গায় পরিণত হয়েছে। ইলেকট্রনিকসে হায়ার, ফ্যাশনে বাটা, এফএমসিজি-তে ন্যাচারাল কেয়ার এবং লাইফস্টাইলে লোটোর সাফল্য দেখিয়েছে- ব্র্যান্ডের অথেনটিক পণ্যের ক্ষেত্রে গ্রাহক ন্যায্য মূল্য দিতে আগ্রহী।
এ বছর দেশের সব ৬৪ জেলা থেকেই অর্ডার এসেছে, যা ই-কমার্সকে আর শহরমুখী নয়, বরং জাতীয় পরিসরের খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাব, ১০০-এর বেশি কালেকশন পয়েন্ট ও ২,৫০০-এর বেশি রাইডারের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্যই নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফলে পাবনার এক বিক্রেতা যেমন সিলেটের ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে পারছেন, রংপুরের ক্রেতাও পাচ্ছেন ঢাকার মতোই পণ্যের বৈচিত্র্য।
সর্বোচ্চ অর্ডার পাওয়া সময় ছিল ১০ নভেম্বর রাত ৮টা এবং ১১ নভেম্বর দুপুর ৩টা, যা দেখায় অফিস শেষের পর কর্মজীবী মানুষ এবং দুপুরে গৃহিণীরা তাদের সুবিধামতো সময়েই অনলাইনে কেনাকাটা করছেন।
ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবহারেও বড় পরিবর্তন এসেছে। অর্ধেকের বেশি লেনদেন হয়েছে ব্যাংক ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে। বিকাশ, নগদ ও বিভিন্ন ব্যাংকের ডিসকাউন্টের কারণে ক্রেতারা দারাজে ডিজিটাল পেমেন্টে আরও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। ০% ইএমআই সুবিধা বড় পণ্য কেনাকাটাকে মধ্যবিত্তের জন্য সহজ করেছে। পাশাপাশি অ্যাফিলিয়েট মার্কেটাররা মোট বিক্রয়ের ২০ শতাংশের বেশি কনভার্ট করেছেন- যা দেখায় ফেসবুক গ্রুপ অ্যাডমিন, ইউটিউব রিভিউয়ার, ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সাররা অনলাইন কমিউনিটির সুপারিশ এখন কেনাকাটার সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
৬০ শতাংশের বেশি ক্রেতা ভাউচার ব্যবহার করেছেন, যা তাদের প্ল্যাটফর্মে অভ্যস্ততা ও মূল্যসচেতনতা নির্দেশ করে। ১ টাকা গেম-এ অংশ নিয়ে অনেক ক্রেতাই রয়্যাল এনফিল্ড হান্টার মোটরসাইকেল, শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ কিংবা ই-বাইকের মতো বড় পুরস্কারের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন। অর্ধেকের বেশি ক্রেতা ফ্রি ডেলিভারি সুবিধা গ্রহণ করেছেন, যা দেখায় ছোট সুবিধাও ক্রয় আচরণে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।
দারাজের চিফ কমার্শিয়াল অফিসার কামরুল হাসান বলেন, “প্রতিটি কার্ট একটি আলাদা গল্প উপস্থাপন করে এবং সেই গল্পগুলো একত্রে দেখলে স্পষ্ট হয় যে দেশের ভোক্তা আচরণ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একই কার্টে ওয়াশিং মেশিন, চাল, অফিস চেয়ার, প্রসাধনী কিংবা স্মার্টফোন, কমফোর্টারের মতো পণ্যের সমন্বয় আজকের ভোক্তার বাস্তববাদী, আবার একই সঙ্গে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনোভাবের প্রতিফলন।”
দারাজ ১১.১১ ক্যাম্পেইন চলবে নভেম্বর মাসজুড়ে। তবে প্রথম কয়েক দিনের প্রবণতাই দেখাচ্ছে- দেশের ই-কমার্স খাতে গড়ে উঠছে একটি কাঠামোগত পরিবর্তন, যা শুধু কেনার ধরন নয়, বরং মানুষের ব্র্যান্ড-অনুভূতি, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ এবং ভবিষ্যৎ ভোক্তা আচরণকেও প্রভাবিত করছে। অনলাইন কার্টগুলো যদিও ভার্চুয়াল, তবে এগুলো যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা বাস্তব ও দীর্ঘস্থায়ী।
ডিবিটেক/পিআর/ইক







