সেবা বন্ধ; বেতান-বোনাস কবে?
স্থবির বেসিস; বাধা নেই প্রশাসকে

স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সবচেয়ে গতিশীল বাণিজ্যিক সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)। সহায়ক কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে প্রশাসক পদত্যাগের পর বন্ধ হয়ে গেছে সংগঠনটির সব ধরনের সেবা। সাংগঠনিক অচলাবস্থায় এরই মধ্যে সচিবালয়ের শীর্ষ পদের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চলে গেছেন বেসিস সচিব হাশিম আহম্মদ, জয়েন্ট সেক্রেটারি, এনামুল হাফিজ লতিফী, ডেপুটি ম্যানেজার (এইচ আর এন্ড এডমিন) ফাতেমাতুজ জোহরা আশা এবং হেড অফ আইটি মাসুদুর রহমান। জুন থেকে আর থাকছেন না সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার মেহেদী হাসান জার্জিস।
সংগঠনের অনিশ্চয়তার মুখে তারা চাকরি ছেড়েছেন বলে জানিয়েছেন তারা। আর এখন যারা আছেন তাদের অবস্থা আরো সঙ্গীন হয়ে পড়েছে। বেসিস সচিবালয়ে বর্তমানে কর্মরত ৩৫ জনের মধ্যে ১০ জনেই নারী। এদের মধ্যে ২৫ জনই সংসারের একক উপার্জনক্ষম। তাদের মতো প্রতিবন্ধী পৃত্রিহীন বিবি কুলসুম লিপির ওপর চলে তার ছয় সদস্যের সংসার। এই সংসারে রয়েছে তার এক জন্মাধ ভাইও। এই ৩৫টি পরিবারে এবার ঈদ আসবে; নাকি সব আনন্দই কুরবানি হবে তা এখনো অজানা।
অথচ বেসিস এর অ্যাকাউন্টে টাকা থাকলেও সিগনেটরি না থাকায় অফিস খরচ চালানো পর্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ডিটিওতে দুই দফা চিঠি লিখেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো প্রতিকার মেলেনি। ওদিকে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় নতুন প্রশাসকও বসাতে পারছেন না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠনের দেখভালকারী ডিটিও অনুবিভাগ।
এমন পরিস্থিতে দুই দিন হাসপতালে চিকিৎসাধীন অবস্থা থেকে ফিরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগের (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) মুহাম্মদ রেহান উদ্দিন ডিজিবাংলাটেকডট নিউজকে জানিয়েছেন, উদ্ভূত মানবিক সমস্যার সমাধানে আইনজীবিদের মাধ্যমে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। অন্তত ঈদের আগেই কর্মীদের বেতন-ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। আশা করছেন, এ সপ্তাহ কিংবা আগামী সপ্তাহের প্রথমেই একটা সুখবর দিতে পারবেন।
তিনি বলেছেন, আদালতও মানবিক। আশা করছি, দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হবে। ঈদের আগেই যেন বিষয়টির সুরহা হয় আমরা তার উদ্যোগ নিয়েছি। বেসিস কর্মীদের কাছ থেকে যে চিঠি পেয়েছি, তা আদালতের গোচরে এনেছি।
অবশ্য আদালতের রায়ের কারণে বেসিস-এ প্রশাসক বসানো যাচ্ছে না বলে যে কথা শোনা যাচ্ছে তা ‘ভুলবোঝাবুঝি’ উল্লেখ করে বেসিস সদস্য ও রিটকারী তৌফিকুল করিম সুহৃদ বলেছেন, চেম্বার জাজের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রশাসক বসাতে চাইলে ডিটিও বসাতে পারবেন। এখানে কোনো আইনগত বাধা নেই। কেননা, আগের রায়ের স্টে অর্ডার দিয়েছে, সেখানে আগের খারিজ নোটিশের ওপর রায় হয়েছে। আর আমি নির্বাচিত কমিটিকে বৈধভাবে বসানোর জন্য রিট করেছিলাম।
বেসিস-কে নির্বাচিত প্রতিনিধি আনার ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা ছিলো তা ইতিমধ্যেই কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে উল্লেখ করে বেসিস সাবেক সভাপতি হাবিবুল্লাহ নেয়ামুল করিম বলেছেন, বেসিস এর সাংগঠনিক কাঠামো সংস্কার প্রায় চূড়ান্ত। শুরু হলেও ফাইন্যান্সিয়াল অডিট, মেম্বার অডিট হতে সময় লাগবে। কোর্টের আদেশে অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও আশাকরি ঈদের বন্ধের মধ্যেই সমাধান হবে। এটা না হলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এই খাতটি। তাই প্রশাসনিক ভাবে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করার সুযোগ থাকলে সেটাই ভালো।
এদিকে ২৬ মে বেসিস থেকে বেতন-বোনাস ও নিয়মিত খরচের তালিকা ডিটিওকে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বেসিস এর সিনিয়র ম্যানেজার (ইভেন্টস এন্ড প্রকিউরমেন্ট) মোঃ মনিরুল হক। তিনি জানান, ব্যাংকে টাকা আছে। কিন্তু সিগনেটরি না থাকায় অফিসের খরচ চালানোর টাকাও আমাদের কাছে নেই। এমনকি ওয়েব সাইটের জন্য গুগল’র চার্জ ৬ লাখ ১৫ হাজার টাকা বকেয়া পড়েছে চলতি মাসের ২০ মে। অনেক অনুরোধ করে বকেয়া পরিশোধের জন্য এক মাস বর্ধিত হয়েছে।
বেসিস সদস্যদের প্রদত্ত এর সব ধরনের কাজ এখন বন্ধ জানিয়ে এই মুহূর্তে সংগঠনটির সচিবালয়ের সবচেয়ে জৈষ্ঠ্য কর্মী, হেড অব মেম্বার সার্ভিস চৌধুরী ফাতিমা রোকন তুলি বলেছেন, গত ১ মে বেসিস গভর্নিং বডি ডিসলভ হওয়ার পর থেকে মেম্বার্স সার্ভিস অরিয়েন্ডেড সেবা সবগুলোই পেন্ডিং রয়েছে। এরইমধ্যে ২৫০ নতুন প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ আবেদন ঝুলে রয়েছে। কো-ব্র্যান্ডিং ক্রেডিড কার্ড, ডলার এন্ডোর্সমেন্ট, সদস্যদের ঋণ সহায়তার সুপারিশ, ট্যাক্স-ভ্যাট ছাড়ের চিঠি সহ সব কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে বেসিস এর মতো ডায়নামিক ট্রেডবডি এখন মৃতপ্রায়।
বেসিস এর সর্বশেষ সভাপতির দায়িত্বপালনকারী এম রাশিদুল হাসান, প্রশাসক সাহেবরই দায়িত্ব ছিলো এগিয়ে নেয়ার। প্রেসিডেন্ট ফোরামে আমরা আলোচনা করেছি, যতদ্রুত সম্ভব নির্বাচন করলেই ফের বেসিস মেম্বার সেন্ট্রিক হয়ে যাবে। আমাদের হাত পা এখন বাঁধা। সরকারই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
বেসিস সাধারণ সদস্যরা জানিয়েছেন, মেম্বার্স সার্ভিসেস বন্ধ থাকায় দেশে-বিদেশে ব্যবসায় বাড়ানো, প্রণোদনা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। যত দেরী হবে ততটাই ধ্বংসের দিকে যাবে। আমরা এখন আইনের কাছে বাঁধা। এই আইনের কারণে সেবা বন্ধ থাকায় ব্যাংকগুলোতে পদে পদে বাধার মুখে পড়ছেন। অনেকেরই ব্যবসায় এখন হুমকীর মুখে।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে ‘যত্রদ্রুত সম্ভব হয় প্রশাসক অথবা একজন সিগনেটরি নিয়োগ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করারর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন পদত্যাগী বেসিস সহায়ক কমিটির চেয়ারম্যান ও ইন্টারনেট, স্যাটেলাইটসহ যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবসা খাতের প্রতিষ্ঠান ডিএনএস গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক রাফেল কবির। তিনি বলেছেন, আমি হঠাৎ করে পদত্যাগ করিনি। নানা কারণে এক মাস আগেই পদত্যাগ করবো বলে জানিয়েছি। কিন্তু পদত্যাগ করার পর বেসিস যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়লো। ফলে আবার আমি সবাইকে নিয়ে উদ্ভূত অবস্থার সমাধানে কথা শুরু করেছি। নিজেরা মিলেও সচিবালয় কর্মীদের বেতনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এটা কোনো বাস্তব সম্মত সমাধান নয়। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত অবিলম্বে তাদের বেতনের ব্যবস্থা করা। পরের বিষয়টা ঈদের পরেও করা যবে।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতা অভ্যূত্থানের পর গত বছরের ৪ ডিসেম্বর বেসিসের প্রশাসক হিসেবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক মুহম্মদ মেহেদী হাসানকে নিয়োগ দেয় সরকার। প্রশাসককে সহায়তা করতে ও বেসিসের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাফেল কবিরের নেতৃত্বে বেসিস সহায়ক কমিটি গঠন করা হয়। তবে ৩০ এপ্রিল বেসিস সহায়ক কমিটি থেকে রাফেল কবিরের পদত্যাগ এবং ১ মে রাতে এই সহায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর ৪ মে বেসিসের প্রশাসক পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।