তথ্যের প্রধান উৎস হয়ে উঠছে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম : জরিপ

দেশের পরিস্থিতির বিষয়ক তথ্যের প্রধান উৎস হয়ে উঠছে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তরুণ ও শিক্ষিতদের বড় অংশই এখন তথ্য পেতে এই এর ওপর নির্ভরশীল। গ্রামে এবং শহরে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তথ্য সংগ্রহে গ্রাম আর শহরের পার্থক্য খুবই সামান্য। শহরের ৪৬ দশমিক ২ শতাংশ সোশ্যাল হ্যান্ডেল থেকে তথ্য শিকার করলেও গ্রামে এই হার ৩৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ৫৬ শতাংশ মানুষ আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি হচ্ছে বলে মনে করছেন এই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। এখান থেকেই ৪৯ দশমিক এক শতাংশ মানুষ চাঁদাবাজি সম্পর্কে জানতে পারেন। পক্ষান্তরে ২০ শতাংশ বেসরকারি টিভি থেকে, ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ বন্ধু/আত্মীয় স্বজন, ১০ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং মাত্র ৪ দশমিক ১ শতাংশ সংবাদ পত্র থেকে চাঁদাবাজির বিষয় সম্পর্কে জানেন।
রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইনোভিশন কনসাল্টিং প্রকাশিত ‘জনগণের নির্বাচন ভাবনা’ শীর্ষক জরিপের দ্বিতীয় দফার প্রথম পর্বে ২১ সেপ্টেম্বর, রবিবার প্রকাশিত প্রতবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবাইয়াৎ সারওয়ার। ২ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলা থেকে তাদের বাছাই করে সরাসরি মতামত নিয়ে পরিচালিত এই জরিপে দেশের ১০ হাজার ৪১৩ জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের অংশগ্রহণ করে। এই জরিপে অন্তর্র্বতী সরকারের কর্মদক্ষতা, নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা ও নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে জনমত বিশ্লেষণ করা হয়।
বিশ্লেষকদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রশনা ইমাম বলেছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে বলে সোশ্যাল মিডিয়া যখন তথ্যের উৎস হয় সেটা শঙ্কার। কেননা, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া তথ্য ভরা। দেশে প্রচুর চাঁদাবাজি হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এটা ম্যালাইন করতে পারে। এক্ষেত্রে আমাদের এই তথ্য নেয়ার আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রেগুলেশনের দিকে তাকাতে হবে। ভুয়া তথ্যের সমস্যা সমাধানে ফ্যাক্ট চেকিং ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, আমরা চাই বা না চাই ইউটিউব এখন আমাদের মেইন সোর্স অব ইনফরমেশন। ইউটিউবের মাধ্যমেই আমি চ্যানেল দেখি। ওটিটি দেখি। এটি এখন মনস্টার হয়ে গেছে। গ্রামেও এর ব্যাপক ব্যবহার দেখছি। এটি একদিকে খুবই ভালো। অন্যদিকে খারাপও। কেননা, আমরা প্রতিদিন ব্যারেজ অফ মিস ইনফরমেশন দেখিছি। অনেক সিনিয়র জার্নালিস্ট এখানে মনগড়া কথা বলেন। এর সমালোচনা করা হলে ফ্রিডম অব এক্সপ্রেসন বা প্রেসের প্রটেকশন চান। এমন পরিস্থিতিতে ১৪ মাসের সরকারের কাছে নির্বাচন নিয়ে মানুষের থাম্ব লাইক ইতিবাচক।
জরিপের ফলাফল ধরে প্রেস সচিব বলেন, জরিপের পরিসংখ্যানই বলছে সরকারের ওপর জনগণের আস্থা আছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৯৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে চাওয়া মানে সামনের নির্বাচন হবে ইনক্লুসিভ নির্বাচন। সবাই ভোট দিতে এলে ভোট ভালো হতে বাধ্য। আর আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) ব্যবস্থা চালু হবে, নাকি বিদ্যমান পদ্ধতি বহাল থাকবে—সেই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের বক্তব্য কম হওয়া শ্রেয়।
জেরিপের বিশ্লেষণ বলছে, দেশের জেনজি ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে রয়েছে উদাসীনতা ও মনোক্ষুণ্নতা। দেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে দেশের ৯৪ শতাংশই আগ্রহী হলেও এদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হার কম। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে নির্বাচন বিমুখতা। এছাড়াও শিক্ষার হার যত কম তাদের মধ্যে সরকারের প্রতি উদাসীনতার হার তত বেশি। একইভাবে শিক্ষার হার যত বেশি বর্তমান সরকারের প্রতি অসন্তোষ তত বেশি। তারা নির্বাচনের সময় নিয়েও দ্বিমত পোষণ করেছেন। অন্যদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা নিয়ে তুলনামূলকভাবে কম আস্থা রেখেছে। একইভাবে সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি সম্পর্কে ৫৬ শতাংশ মানুষের ধারণা নেই। তবে যারা জানে তাদের মধ্যে এর পক্ষে মত বেশি। আবার শিক্ষিতদের মধ্যেই নির্বাচন বিমুখতা বেশি।
জরিপ বলছে, পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে নবীন প্রজন্ম প্রবীণদের তুলনায় বেশি সচেতন ও ইতিবাচক। আর পুলিশ-প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে জেন-জি প্রজন্ম তুলনামূলক কম আস্থাশীল। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করেছেন ৭৮ দশমিক ৭ শতাংশ উত্তরদাতা। তবে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে এ নিয়ে ইতিবাচক মনোভাবের হার কম, বরং তারা চাঁদাবাজি বেড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন।
জরিপের মূল ফলাফল:
অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মদক্ষতা: ৭৮ দশমিক ৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী সরকারের কার্যক্রমকে ‘ভালো’ বা ‘মধ্যম মানের’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। তবে তরুণ, শিক্ষিত ও নগরবাসীদের মধ্যে সন্তুষ্টির হার তুলনামূলকভাবে কম।
নির্বাচন ও ভোট নিরাপত্তা:
৬৯ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম। এছাড়া ৭৭ দশমিক ৫ শতাংশ বিশ্বাস করেন তারা নির্ভয়ে ও নিরাপদে ভোট দিতে পারবেন। তবে পুলিশ ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে তরুণ ও নগরবাসীর সংশয় বেশি। ভোটের সময় পুলিশ-প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রবীণ প্রজন্মের তুলনায় জেন-জি প্রজন্ম কম ইতিবাচক।
চাঁদাবাজি ও আইনশৃঙ্খলা:
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ৫৬ শতাংশ। এদের মধ্যে ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। সাধারণ মানুষের চেয়ে তাদের সংখ্যা ১০ শতাংশ বেশি। চাঁদাবাজি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশকারীদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৩ শতাংশই জেনজি। গত ৬ মাসে চাঁদাবাজি বেড়েছে বলেও তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই ধারণা শহুরে বাসিন্দা, তরুণ প্রজন্ম এবং উচ্চ শিক্ষা ও আয়ের স্তরের লোকেদের মধ্যে বেশি স্পষ্ট। তথ্যের প্রধান উৎস হিসেবে তরুণ ও শিক্ষিতদের বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল।
নির্বাচনের সময়সূচি ও অংশগ্রহণ:
৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত দেন এবং ৯৪ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে শিক্ষার্থী, উচ্চশিক্ষিত এবং কিছু পেশাজীবীদের মধ্যে নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে আপত্তি তুলনামূলক বেশি।
নির্বাচনী সংস্কার:
সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতি সম্পর্কে ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা অবগত নন। তবে যারা এই বিষয়ে জানেন, তাদের মধ্যে এই ব্যবস্থার পক্ষে সমর্থনই বেশি। তরুণ ও উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা এবং সমর্থনের হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
অন্তর্বর্তী সরকার: অন্তর্বর্তী কর্মকাণ্ডকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করেছেন ৭৮ দশমিক ৭ শতাংশ উত্তরদাতা। তবে স্বল্পশিক্ষিত উত্তরদাতাদের তুলনায় উচ্চশিক্ষিতরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে কম সন্তুষ্ট। অন্যদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতার বিষয়ে তুলনামূলক কম ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও যোগাযোগ বিষয়ে শিক্ষক ড. সাইমুম পারভেজ, বিডিজবস ডটকমের প্রধান নির্বাহী এ কে এম ফাহিম মাশরুর, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রশনা ইমাম এবং ব্রেইনের নির্বাহী পরিচালক শফিকুর রহমান।
ইনোভেশন কনসালটিং একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শক, গবেষণা ও কারিগরি সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের উদ্যোগে ‘পিপলস পারসেপশন অন ইলেকশন সার্ভে’ পরিচালিত হচ্ছে, যা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে ভয়েস ফর রিফর্ম ও বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক (ব্রেইন)।